কোভিড অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী সমস্ত ব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও যে তার হাত থেকে রেহাই পায়নি, এটুকু আজ আমরা ঘরে ঘরে জানি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেও অনেক স্তরভেদ আছে। বিশেষত, তার আর্থিক সঙ্গতি ও সংগঠনের মধ্যে।
শহরকেন্দ্রিক স্কুলগুলোর মধ্যে মুখ্যত চারটি ভাগ আছে— সরকার পরিচালিক ও সরকার পোষিত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্থাপিত ও পরিচালিত, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং সোসাইটি বা ট্রাস্টি দ্বারা পরিচালিত।
কোভিড পরিস্থিতিতে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ সমস্যার শিকার হয়েছেন। কারও চাকরি গিয়েছে, কারও বা চাকরি থাকলেও মাসিক বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাগুলি অনেকটাই কমে গিয়েছে। ছোট ও মাঝারি মাপের ব্যবসা হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নাহয় ধুঁকছে। অনেক অভিভাবকই এই পরিস্থিতির শিকার। ফলে তাঁদের পক্ষে ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এই রকম আর্থিক অবস্থায় সমস্ত স্কুলকে কম বেতনে অথবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিনা বেতনেও ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যবস্থাকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে মুক্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলোও এই অসুবিধাকে অনেকাংশে এড়িয়ে যেতে পারে, যে হেতু প্রয়োজনে তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের সাহায্য প্রার্থনা করতে পারে।
বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির পরিচালকেরা এটাকেও বাণিজ্য হিসাবেই দেখেছেন। অন্যান্য বহুবিধ ব্যবসার মতো এই সময়ে একেবারে ডুবে না গেলেও মুনাফা কিছুটা কমেছে, সন্দেহ নেই। ডোবেনি, তার কারণ প্রতিষ্ঠানের ক্রেতার সংখ্যার খুব বেশি তারতম্য ঘটেনি। এই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক ক্ষেত্রে ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন গঠন করে স্কুল চালাচ্ছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্বজ্জন বা শিক্ষানুরাগীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সোসাইটি বা ট্রাস্টি দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলি। তাদের না আছে অর্থবল, না আছে অন্য কোনও রকম সহায়তা। অথচ, একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ রূপায়ণের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ধরনের বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে।
এই রকম আর্থিক সমস্যার মধ্যেও স্কুলের শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের বেতন যথাসময়ে পরিপূর্ণ ভাবে মিটিয়ে দিতে হচ্ছে। তার ফলে এই ধরনের বহু স্কুলও আজ সত্য সত্যই বিপদাপন্ন।
স্কুলগুলির পরিচালন ব্যবস্থার অসুবিধার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রথমত, ক্লাসরুম মিটিং-এ অভ্যস্ত তাঁরা। তাঁদের মধ্যে অনেককেই অনলাইন পড়াশোনার যে যান্ত্রিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হতে হচ্ছে। বিশেষত, বয়স্ক শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই যান্ত্রিক যন্ত্রণায় বিশেষ ভাবে বিব্রত।
এ বার সমস্যা হল, এই অনলাইন ক্লাসগুলোকে কী ভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, তার উপায় নির্ধারণ করা। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের পড়া বুঝছে কি না, সেটা বোঝার উপায় এ ক্ষেত্রে সীমিত। তার উপর পরীক্ষা নেওয়ার পর সেই খাতা পরীক্ষা করা অনেক বেশি শ্রমসাধ্য।
যাঁরা ভাবেন, শিক্ষকেরা তো ঘরে বসে বেশ আয়েশ করেই পড়াচ্ছেন এবং বেতনও পাচ্ছেন যথারীতি, সম্ভবত তাঁরা জানেন না যে, এ ভাবে পড়ানোটা ঠিক অতটা আরামের নয়।
খুব ছোটদের জন্য অনলাইন ক্লাস মোটেই উপযুক্ত নয়। বয়সে বড় ছেলেমেয়েরা তবু অনেকখানি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে এই ব্যবস্থায়। মফস্সল শহর বা আধা-শহরে অধিকাংশ অভিভাবকদের আর্থিক সঙ্গতি বেশ কম। তা ছাড়া, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও আছে। অনেকেরই স্মার্টফোন নেই। আবার, অনেক বাড়িতে একটাই ফোন, যেটা বাবা বা মা কাজে বেরোলে আর পাওয়া যায় না। ক্লাসগুলি যে সময়ে হয়, তখন বাড়ির ফোন বাড়িতে থাকে না। সে জন্য বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনলাইন ক্লাসের ভিডিয়ো তৈরি করে সেগুলো ছাত্রছাত্রীদের বাবা বা মায়ের ফোনে পাঠান, যাতে সন্ধেবেলা কাজ বা অফিসের পরে সেই ফোন থেকে ছেলেমেয়েরা ক্লাসের পড়া দেখে নিতে পারে। গ্রামগঞ্জের স্কুলগুলোর কথা আর না-ই বা বললাম। সেটা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়। তবে সেখানে কোভিডের পরিস্থিতি এতটা খারাপ নয়। মুক্তাঙ্গন শিক্ষার কথা ভাবাই যেতে পারত। তবে তার জন্য অন্য রকম পরিকল্পনার দরকার ছিল।
বলাই যায় যে, এই অতিমারিতে সবচেয়ে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হল ছাত্রছাত্রীরা। প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলের বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের যে সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্কুলকে, সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের— সে সময়ে প্রায় গৃহবন্দি জীবনযাপন করতে হল তাদের। এর চেয়ে বড় শাস্তি এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে আর কী হতে পারে? স্কুল নেই। পাড়া-প্রতিবেশী ও সেখানকার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশাতেও বিধিনিষেধের বেড়া। সমবয়সি সকলেই প্রায় গৃহবন্দি।
খুব ছোটদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রকৃতি এমন ভাবে আমাদের সৃষ্টি করেছে, যেখানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো গড়ে ওঠার জন্য তাদের নিয়মিত সঞ্চালন একান্ত জরুরি। সে জন্য ছোট বয়সে দৌড়তে ভাল লাগে, খেলতে ভাল লাগে, যাতে তার সুষম শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ঘটে। এই নিউরো-মোটর সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ না করলে ভাবনাচিন্তা ও তার প্রয়োগের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই দুইয়ের কো-অর্ডিনেশন ব্যবস্থাটাই ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। একটি জীবনে তার পরিণতি কী ভয়ঙ্কর, সেটা সহজেই অনুমেয়। জানি না, এই সমস্যা সমাধানের কোনও চাবিকাঠি আছে কি না। অথচ, এই মুহূর্তে আপাতদৃষ্টিতে এর কোনও বিকল্পও নেই। সরকারের উচিত ছিল, অতিমারিতে স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষাকেও অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসাবে গণ্য করা। বিবিধ সংগঠন, অভিভাবক-অভিভাবিকা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা’সহ স্কুলগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একটা প্রচেষ্টা অন্তত শুরু করা যেত।
এখন তো শুধু শিক্ষার খোলস ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকল না। এই অবস্থার পরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী রূপ নিয়ে সমাজে আত্মপ্রকাশ করবে, একমাত্র সময়ই তার উত্তর দিতে পারবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy