প্রতীকী ছবি।
পরীক্ষায় কে কত শতাংশ নম্বর পেল, তা কি ছাত্রদের গুণমানের মাপকাঠি হতে পারে? শব্দসংখ্যার নিরিখে ছোট থেকে আরও সঙ্কুচিত হয়ে আসা উত্তরনামায় কি ধরা পড়ে শিক্ষার্থীর মেধা বা তার্কিক দক্ষতা? তা হলে চোখ-কান বুজে বা আদাজল খেয়ে এই তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ইঁদুর দৌড়ের অর্থ কী? এই পুরনো প্রশ্ন করা যেতে পারে ২০২০-র জাতীয় শিক্ষা নীতির এক বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে, আপাতদৃষ্টিতে যা মুখস্থ বিদ্যাবিমুখ, যা প্রাধান্য দিতে চাইছে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা, উপযোগিতা ও দক্ষতাকে। নিঃসন্দেহে ভাল কথা। কিন্তু তা বাস্তবায়নের গতিপথ যদি বিশ্লেষণমূলক উত্তরকে তোয়াক্কা না দিয়ে, অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর ও বহু-বৈকল্পিক প্রশ্নকে (এমসিকিউ) প্রাধান্য দেয়, তা পথ চলা শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর ও এমসিকিউ আমাদের চিন্তাধারা প্রসারিত করে না, বরং বাধ্য করে চিন্তাশক্তিকে সঙ্কুচিত করে মাত্র একটি বিকল্প বেছে নিতে। এমসিকিউ যতই ব্যবহারিক হোক না কেন, তার মধ্যে সৃষ্টিশীল ও সমালোচনামূলক কোনও উপাদান নেই। এরা চরিত্রগত ভাবে ‘একনিষ্ঠ’, এদের ভিত্তিই হল বিবিধ সম্ভাবনাকে নির্মম ভাবে ছেঁটে ফেলা।
ভুলে গেলে চলবে না, সমাজবিজ্ঞান-সহ অনেক বিষয় প্রতিষ্ঠিত ‘বহু’র দৃষ্টিকোণের উপর। সেখানে সত্যি-মিথ্যা, ঠিক-ভুলের সীমিত দ্বৈত-ধারণা ভ্রান্তির সমতুল্য। একাধিক পরস্পরবিরোধী সত্যের সমন্বয়ে সেখানে গড়ে ওঠে যুক্তি, তক্ক, গপ্পো— ডিসকোর্স। সেখানে মতাদর্শের ফারাকে এক জনের স্বাধীনতা-সংগ্রামী অন্যের জঙ্গি হয়ে ওঠে, শাসকের লেখা ইতিহাসের সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের আখ্যান মেলে না। পুরুষতন্ত্রের চোখে দেখা প্রথাগত সমাজরীতি ভস্ম হয় নারীবাদী প্রতিবাদে। এমসিকিউ-এ চারটের মধ্যে একটা বিকল্প বেছে নিয়ে বাবরি মসজিদ পতনের ঠিক তারিখ বলা সম্ভব, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সামাজিক মূল্যায়ন সম্ভব কি? বিস্তারিত পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণের কোনও জায়গা সেখানে নেই। ঠিক-ভুল নিয়ে সে এতই নিমজ্জিত, ঠিক উত্তর দাগাতে এমনই উদ্গ্রীব যে, দৃষ্টিভঙ্গি বা ব্যাখ্যার মূল্যায়ন তার কাছে নিরর্থক।
বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান নির্বিশেষে যে কোনও ছাত্রছাত্রীর সক্ষমতা রয়েছে নানা উপায়ে তর্ক তোলার, যুক্তি সাজানোর, পর্যবেক্ষণ পেশ করে বিশ্লেষণে যাওয়ার ও সারাংশে উপনীত হওয়ার। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর ও এমসিকিউ এই ভিন্নতাকে নাকচ করে তার মূলে আঘাত হানে। তাতে মানুষের ভাবনার পরিধিকে অপমান ও অবজ্ঞা করা হয়। তিনটে বা চারটে বিকল্পে ‘ঠিক’কে বেঁধে ফেললে অন্য সম্ভাবনাগুলিকে অস্বীকার করা হয়। সংক্ষিপ্ত উত্তর ও এমসিকিউ ধারণাগত ভাবে বিবিধতা ও গবেষণা-বিরোধী। ধরাবাঁধা শব্দসংখ্যার পরীক্ষামুখী প্রতিযোগিতা ও স্কুলের প্রজেক্ট প্রেরণা জোগায় মুখস্থবিদ্যাকে, আশকারা দেয় টুকে পাশ করাকে, তাতে প্রশ্রয় পায় কপি-পেস্টিং প্রবণতা। আমরা বুঝতে ও বোঝাতে ব্যর্থ হই, গুগলে যাবতীয় তথ্যসম্ভার থাকলেও, তথ্য ঘেঁটে যুক্তি সাজানোর মধ্যেই নিহিত মৌলিকতা। তথ্য সংগ্রহ এবং পাঠ অভিজ্ঞতা ও পাঠ সমালোচনা আসলে আলাদা, উত্তরের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ উত্তরে এসে পৌঁছনোর কৌশল। অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর ও এমসিকিউ-এর অবস্থান এর ঠিক বিপরীত মেরুতে।
স্কুলে ঠিক-ভুলের দ্বৈত মূল্যায়নের বদলে তার্কিক পদ্ধতি ও যৌক্তিক প্রণালীর উপর জোর দেওয়া হলে পরীক্ষার ত্রাসও উধাও হয়ে যায়। কোন পাতার কোথা থেকে কতটা মুখস্থ করে লিখব, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ— কতটা আত্মস্থ করা গিয়েছে। মুখস্থ করে ওগরানোর প্রথা বিশ্বের উন্নত দেশগুলির শিক্ষানীতিতে বর্জিত, কারণ তা অর্থহীন। ও ভাবে চিন্তার প্রসার ঘটে না, সমালোচনা করার আত্মবিশ্বাস জন্মায় না, বইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে কোনও নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয় না। পশ্চাদ্গামী ও স্মৃতিনির্ভর এই ব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের ‘নম্বর তোলা’ দিয়ে ভুলিয়ে রেখে এক নিস্পৃহ ও অনুগামী সমাজ গড়ে তোলে।
কোভিড আজ শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে একটা বাধ্যতামূলক আড়াল বা দূরত্ব তৈরি করেছে, এখন আরও বেশি করে প্রয়োজন জ্ঞানকে সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে উন্মুক্ত করে আরও বেশি ক্রিয়াশীল, প্রয়োগমূলক ও গবেষণাভিত্তিক করে তোলা। আজ পরীক্ষা ঘিরে নানা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, বহু পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে, বাতিল হচ্ছে। গবেষণা ও সমালোচনামূলক শিক্ষানীতি প্রয়োগের এটাই কিন্তু সুবর্ণ সুযোগ। অতিমারি আমাদের সুযোগ ও সময় দিয়েছে শিক্ষানীতি খতিয়ে দেখার। কিন্তু সেই সুযোগ দূরে ঠেলে আমরা আজও আটকে আছি নির্ধারিত শব্দের মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ মুখস্থ আওড়ানোয়, বা ভাবনাকে আরও সঙ্কুচিত করে এমসিকিউ-সর্বস্ব মূল্যায়নে। গণমাধ্যমে ‘টপার’দের সাফল্য উদ্যাপনের ঠেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সেই পড়ুয়াটি, যে অঙ্কে একশো পাওয়ার শৈলী রপ্ত করতে না পারলেও, হয়তো অঙ্কের যুক্তিটা পিছনের বেঞ্চের আর এক পড়ুয়াকে দিব্যি বুঝিয়ে দিতে পারে। ‘কী’ বা ‘কত’-সম্বলিত প্রশ্নগুলোর মূল্যে আমরা এখনও অবজ্ঞা করে চলেছি ‘কেন’, ‘কী ভাবে’-র মতো জিজ্ঞাসাদের। পুঁথির বোঝা কাঁধে ও মাথায় বয়ে মগজাস্ত্রে শাণ দেওয়া অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy