ছাগলে কী না খায়— এ কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। হ য ব র ল অনুযায়ী শিশি, বোতল, সাবান সব কিছু খেলেও ছাগল বিষাক্ত গাছের পাতা খায় না। কিন্তু ২০০৭ সালে ওড়িশার বোলাঙ্গিরে ৯৩টি ছাগল তুলোগাছের পাতায় বিষ থাকতে পারে, তা বুঝতেও পারেনি। সেই গাছ ছিল জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম— জিন বদলানো ফসল) বিটি তুলোর গাছ।
বিটি মানে ব্যাসিলাস থুরিঞ্জিয়াসিস নামে এক ধরনের ব্যাকটিরিয়া, যা পোকা মারতে ব্যবহার করা হয়। তুলোগাছ এবং পরে বেগুনগাছের জিনে এই ব্যাকটিরিয়ার জিন জুড়ে এমন বীজ বানিয়েছে কিছু বীজ কোম্পানি, যাতে এই বীজ থেকে গাছ নিজেই হবে বিষাক্ত। তাই তাকে আর পোকায় খাবে না, পোকা মারা বিষ দেওয়ারও দরকার হবে না। আপাত ভাবে শুনতে ভাল হলেও জিন বদলানো খাবারের নানা অস্বাস্থ্যকর প্রভাব যেমন— অ্যালার্জি, প্রজনন স্বাস্থ্য, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা শুরু থেকেই সতর্ক করে আসছেন।
পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে, জিন বদলানো ভুট্টা, মটরশুঁটি, চাল, সয়াবিন খাইয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী, প্রধানত ইঁদুরের শরীরের নানা বিচিত্র পরিবর্তন। জিনের বদল বা কখনও কখনও এই জিনের সঙ্গে ওই জিন মিশে যাওয়া প্রকৃতিতে হয় না, তা নয়। তবে দুটো প্রজাতির মধ্যে মিলমিশ বেশ বিরল। তার মধ্যে কেউ থাকে, কেউ হারিয়ে যায়। যারা থাকে, তারা নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষতিকর দিক ঝেড়ে ফেলে স্থিতিশীল হয় হাজার বছর ধরে। ল্যাবরেটরিতে তৈরি তাড়াহুড়োর জিন প্রতিস্থাপনে সেই সুযোগ কোথায়? তা ছাড়া যখন এই জিন বদলানো ফসলের সঙ্গে উৎপাদন বাড়ার কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই, তা হলে কেন এই ফসল? ভারতে ৩৫৬৮ রকম বেগুন ফলে, যার মধ্যে কোনও কোনও জাতে এমনিতেই পোকা লাগে না। এ সব উপেক্ষা করে নতুন কৃত্রিম বেগুন কেন?
বিটি তুলো চাষের খরচ প্রচুর বেড়ে যাওয়া ও তার সঙ্গে বহু কৃষকের ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পরে বিটি বেগুন আনার প্রচেষ্টায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ২০১০ সালে স্থগিতাদেশ জারি করতে বাধ্য হয়। জিন বদলানো সর্ষেও এখনও অবধি বাজারে আনা যায়নি। জিএম ফসল ফলানো কোনও না কোনও ভাবে আটকে যাচ্ছে বলে জিন বদলানো ফসল এখন সরাসরি খাবারের ছদ্মবেশে আমাদের থালায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার, খাদ্য সুরক্ষা দফতরের নতুন প্রকাশিতব্য বিধিমালার হাত ধরে।
২০০৬ সালের মে ও জুলাই মাসে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প মন্ত্রণালয় খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে যে বিল আনে, তার বিতর্কে অংশ নেওয়া সাংসদরা স্পষ্ট ভাবে জিএম খাবার এবং আমাদের খাদ্যব্যবস্থার কর্পোরেটাইজ়েশন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই বিতর্কের পটভূমিকায় এই বিল পাশ হয়ে আইন হয়। এই বিধিমালার প্রয়োজন কি পড়ছে নিয়ন্ত্রণের নামে অবৈধ আমদানিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য? প্রথমত মেনে নেওয়া করা দরকার যে, জিএম খাবারগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে কারণ, তারা স্বাস্থ্যের (এবং পরিবেশের) জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষকদের বীজ সার্বভৌমত্ব, খাবার সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার এবং খাবার সম্পর্কে জানার অধিকারও। স্বাস্থ্যকর ব্যক্তির তুলনায় অপুষ্ট মানুষের খাবারে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি। আমাদের দেশের অপুষ্ট জনসাধারণের কথা মাথায় রেখে অতএব এফএসএসএআই-এর একটি সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থান থাকা উচিত। এটাও মাথায় রাখা দরকার, লেবেলে লিখে ক্রেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, আমাদের বেশির ভাগ খাবার প্যাক বা লেবেল যুক্ত নয়। আর ইংরেজি খুদে অক্ষরে লেখা পড়ছেই বা কে!
খসড়া বিধিমালায় বলা আছে, অন্য দেশে অনুমোদিত যে কোনও জিএম খাদ্য ভারতে অনুমোদিত হতে পারে। অথচ, আমেরিকায় জিন বদলানো খাবারের লেবেলিং-এর ব্যাপারটি অতি শিথিল। ফলে কে কতটা জিএম খাবার খাচ্ছেন, খেয়ে তার কতটা ক্ষতি হচ্ছে, বোঝার প্রায় কোনও উপায় নেই। অথচ, যে সময় থেকে এই ধরনের খাবার বাজারে এসেছে, তার কাছাকাছি সময় থেকে আমেরিকানদের স্বাস্থ্যের অবনতি চোখে পড়ার মতো। আশঙ্কা, পাশ্চাত্যের এই শিথিলতার সুযোগে অনেক জিএম খাবার আমরাও খাচ্ছি। তার ক্ষতিকর প্রভাব খতিয়ে দেখার কোনও রাস্তাই প্রায় নেই।
এ দেশে যে ভাবে পরীক্ষা হবে, সে নিয়মকানুনও তথৈবচ। এফএসএসএআই-এর মধ্যে এক কর্তৃপক্ষ-এর কথা বলা আছে যা কিনা কোনও আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। কোথাও বলা নেই এই কর্তৃপক্ষে কোনও খাদ্য সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ থাকবেন কি না! ভিড় করার জন্য থাকবেন শিল্প, খুচরো বিক্রেতা, কৃষক, উপভোক্তা এমনকি মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিরাও। সেই হট্টমালার কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের পরীক্ষা বা মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে আবেদন অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করবেন, সে ব্যাপারেও বিধিমালা নীরব। যে হেতু মানুষের শরীরে জিএম খাবারের প্রভাব নিয়ে কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার সুযোগ হয়নি, তাই জিএম খাবার অনুমোদনের পর কী প্রভাব হতে পারে, সে বিষয়েও সক্রিয় নজরদারির আলোচনা এতে করা হয়নি। শিশুখাদ্যে জিএম নিষিদ্ধ হলে, তা বড়দের জন্যও বিষ, পশুদের জন্যও, বিশেষত যখন পশুখাদ্য মারফত সেই বিষ আমাদের শরীরে চলে আসতে পারে।
বিশ্বের ৩৮টি দেশ (তার মধ্যে ১৯টি ইউরোপীয়) জিন বদলানো ফসল চাষের বিরোধী। আমাদের দেশেও আইনত এখনও চাষ করা যায় না। কিন্তু খাবারের আমদানি, প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে দিয়ে জিএম আনতে চাওয়ার প্রচেষ্টায় বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে, আমাদের পছন্দের অধিকারের ব্যাপারে স্ব-অধীন হয়ে উঠতে পারিনি। বাজারি দাঁড়িপাল্লার কাঁটা এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy