একটি দ্বীপ। পর্বতশিখর আছে, অতলঝাঁপানও। খরস্রোত নদী আছে, বহমানতাও। রং আছে, শ্যামলিমায় দ্বাপর স্বপ্নপ্রেমিকে নীরন্ধ্র-বিজড়িত। প্রেম আছে, চির-অস্থির। ভিড়গন্ধ একাকিত্ব অনূদিত। সঙ্গীত তিন-সপ্তক-ভ্রমণের জাদুবাস্তবতা। স্বর সে দ্বীপে গুরুগুরু মেঘগর্জন ঘটিয়েই গুনগুন ভ্রমরগুঞ্জন, ‘ক্রুনিং’। নির্জন দ্বীপের বয়স ১২৫।
কৃষ্ণময়তা। ঠাকুমা প্রসন্নময়ী অদ্বৈত-বংশের। জন্ম নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। রাধাভাবে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। মধ্যবয়সের বন্ধুর নামও ‘কৃষ্ণপ্রেম’, পূর্বাশ্রমে যিনি রোনাল্ড হেনরি নিক্সন। সর্বার্থেই ‘কৃষ্ণনাগরিক’ দিলীপকুমার রায়। সুবিখ্যাত বাবা দ্বিজেন্দ্রলালের বিভায় শৈশব-কৈশোর পেরোনো। রবীন্দ্রনাথের ‘স্নেহের মন্টু’। সুভাষচন্দ্রের চেয়ে এক দিনের বড়, সহপাঠীও। শরৎচন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, নজরুলের চোখের মণি। গান্ধী, রোঁলা, রাসেল তাঁর লেখা-গান-পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ। তিনি শ্রীঅরবিন্দের মানসসন্তানও। এমন মানুষের শত্রু থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু দিলীপকুমারের ছিল। তাঁর শত্রু তিনি স্বয়ং।
নিজের মাংসই হরিণের শত্রু। দিলীপকুমারের গানজীবনও সুস্বাদু। তবে, হরিণের সঙ্গে ফারাক আপাত-কোমলতায়। দিলীপকুমার তাঁর সুস্বাদু গান বেঁধেছেন নিজের তুমুল পাণ্ডিত্যের মাপেই। কিন্তু তা শোনার জন্য সমসময় তৈরি থাকলেও ভবিষ্যৎ এত পরম্পরাহীন হয়ে উঠতে সফল হবে, কল্পনা করেননি। এবং তাঁর মাপে উঠতে না পারলে তাঁকে গাওয়া যে ‘মুশকিল’ই নয়, ‘না মুমকিন’ও, সেটাও বড় কারণ। আরও একটি কারণ, তাঁর গানে প্রেম-ভক্তির মিলন। কীর্তন-বিস্মৃত বাঙালি ঝগড়া-মিলন দ্বন্দ্বসমাসের সেই পরমান্ন পাবেই বা কোন দুঃখে!
বাবাকে দিলীপকুমার পেয়েছেন সতেরো বছর। বাবা সতর্ক করলেও প্রথম জীবনে গানের ‘তানবাজি’র মোহে পড়েন দিলীপকুমার। লিখেছেন— “আমার তানবাজির প্রতিভার জন্যে বহুলোকের কাছে স্তুতি পেয়ে বেশ একটু অহংকারী হয়ে উঠি।” এবং বাংলা গানের প্রতি তাঁর ‘অবজ্ঞা’ বাড়তে থাকে। প্রথম জীবনে বাবার গানকেও বিশেষ পাত্তা দিতেন না তিনি। কিন্তু ছেলেকে তাঁর প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে গিয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর বা রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালি ভুলবে না: “আমাকে কি রবিবাবুকে ভুলে যাবে না। আর কেন যাবে না জানিস?— এই জন্যে যে, আমরা রেখে যাচ্ছি যা বাঙালির প্রাণের জিনিস— সুরে বাঁধা গান। আমি যে কী সব গান বেঁধে গেলাম, সেদিন তুইও বুঝবিই বুঝবি।” দিলীপকুমার বুঝেছিলেন। তাই বাবার মৃত্যুর পর তাঁর প্রয়াসকেই কর্তব্য মনে করলেন। সে কর্তব্য বাংলা গান বাঁধা। মার্গসঙ্গীতের বলয়ে কাজ শুরু। পরে পাশ্চাত্য সঙ্গীতশিক্ষার সূত্রে প্রাচ্য-প্রতীচীর সুরসম্মিলন। তা আগেই করেছেন রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র। দিলীপকুমারও ব্রতী হলেন, তবে ভিন্নপথে। সে পথের জনয়িতা তাঁরই জীবনচলন।
জীবনচলন বাউন্ডুলের। বাবা ইংরেজি সাহিত্য পড়ে কৃষিবিদ্যা পড়তে বিলেতে এবং পাশ্চাত্য সুর আহরণ করে দেশে ফিরে ম্যাজিস্ট্রেট। দিলীপকুমারও গণিতে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে। ফেরা পাশ্চাত্য সুরসঞ্চয় নিয়ে। বাবার ষোলো বছরের দাম্পত্য। দিলীপকুমার সংসার সীমান্তের ধার মাড়ান না। দেশবিদেশ চক্কর সুরসংগ্রহে। সে কালের নামকরা হিন্দুস্থানি গাইয়েদের কাছে শিখছেন গান। শিখছেন বাইজিদের কাছে। সখ্য হয়েছে বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে। বাবার গান গাইছেন। অতুলপ্রসাদের, নজরুলের গান গাইছেন। চলছে মহাবিশ্বের প্রায় সব বিষয়েই তর্ক, যার তুঙ্গ মাত্রা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নানা মতান্তরে। রবীন্দ্রনাথ-শ্রীঅরবিন্দ বিষয়টিকে পরম স্নেহে বিবেচনা করেছেন। তর্ককে প্রতর্ক হিসাবে নিয়েছেন, আলোচনার দরজা বন্ধ করেননি কখনও।
এই দিলীপকুমার, মোটের উপর, পূর্বাশ্রমের। পরের তিনি অন্য মানুষ। এর মধ্যে শ্রীঅরবিন্দের পুদুচেরির আশ্রমে যোগ। আশ্রমে পারিবারিক সম্পত্তি বেচা সর্বার্থ দান। গান গেয়ে টাকা তোলা আশ্রমের জন্য। শ্রীঅরবিন্দের মৃত্যুর পর আশ্রমত্যাগ, ইন্দিরাদেবীর সঙ্গে পুণের হরিকৃষ্ণ মন্দির স্থাপন। এই দিলীপকুমার সর্বত্যাগী। এই সময়কালেই তিনি বাংলার গানের ইতিহাসে বহুবর্ণ মাইলফলক বসিয়ে যাচ্ছেন। তা প্রধানত কীর্তননির্মিত। রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমারকেই লিখে যাচ্ছেন— “তোমার সুকণ্ঠে হিন্দি, গৌড়ীয় এবং কীর্তন বাউল ধারার ত্রিবেণীসঙ্গম হয়েছে।”
কীর্তন বাংলার একার সম্পত্তি নয়। কিন্তু দিলীপকুমারের কীর্তন মূলত বাংলার। কীর্তনে নানা বিভঙ্গ, তাল-রাগরাগিণীর বিস্তার। আমরা যে-কীর্তনের সঙ্গে রবীন্দ্রসূত্রে আত্মীয়, তা আধুনিক সহজিয়া রূপ। তার আগেও শাস্ত্রীয় কীর্তনের চর্চা ছিল। শ্রীচৈতন্য-সূত্রে সঙ্কীর্তন জনপ্রিয়তা পেলেও তা শ্রীচৈতন্যেই শুরু নয়, গৌরাঙ্গের জন্মসময়ের বিবরণে সঙ্কীর্তনের তথ্য মেলে। শ্রীচৈতন্য সহজিয়া রূপটিকেই নিলেন, পরে যেমন রবীন্দ্রনাথ। কীর্তন দিলীপকুমারও নিলেন, তবে সহজ সূত্রে নয়। মাখলেন উপমহাদেশের মার্গগানের চলনচন্দন, জুড়লেন পাশ্চাত্য সুরতালের আঙ্গিকও। বিষয়টি ভারী হয়ে উঠল। রামপ্রসাদের সুর সহজিয়া কীর্তনই। দিলীপকুমারের রামপ্রসাদি আলাদা। তাঁর লোকায়ত বয়ানেও এক ছবি। ‘পূজা আমার সাঙ্গ হল’ গানে মাঝির হাল ওঠা-নামার শব্দই মেলে, তবে কবীর সুমন চিহ্নিত ‘সমস্ত সুর হন্তদন্ত’ অবস্থায়। এই ‘হন্তদন্ত’ গতিই দিলীপকুমারের স্বাক্ষর। ক্রমশ তা কঠিনতর অঙ্কগণিত হয়ে উঠেছে। কারণ, তিনি গানের ‘ব্যক্তিস্বরূপ’ নিয়ে ভাবিত। সে ব্যক্তিস্বরূপ ‘নিজের স্বভাবে স্বভাবস্থ’ হওয়া। শঙ্খ ঘোষের ভাবনা: “ব্যক্তিস্বরূপটা তৈরি হবে কোথায়? দিলীপকুমার ভেবেছিলেন সেটা তৈরি হবে রূপকারের গলায়, আর রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন সেটা তৈরি হয়ে আছে সুরকারের সৃষ্টিতে।” সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় অবিশ্বাসী বলেই নিজের গানই বহু বার ভেঙেছেন ‘রূপকার’ দিলীপকুমার।
এক কালে তিনি পদ-বিশারদ খগেন্দ্রনাথ মিত্রকে নস্যাৎ করে বলতেন, কীর্তনে পদের সাহিত্যমূল্য থাকলেও ‘ওস্তাদি তানালাপের সঙ্গে’ তুলনীয় নয়। পরে লিখছেন, “সে-সময়ে উচ্চাঙ্গ কীর্তন আমি শুনিনি, কাজেই খগেনকাকার এ-কথায় কান দিইনি।” এই তিনিই রেবতীমোহন সেন, গণেশ দাসের কীর্তনে আপ্লুত। ‘খগেনকাকা’ই নিয়ে যান তাঁর গুরু নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসীর কাছে। ব্রজবাসীর কাছে দিলীপকুমার কীর্তনের মায়াভিকর্ষে এলেন। কী পেলেন? লিখছেন, “হৃদয়ের সঙ্গে কণ্ঠের মিতালি, সুরের জাদুতে স্বতোবিরোধী ভাবাবেগের সমন্বয়, সর্বোপরি, নাট্যসঙ্গীতের স্থাপত্য-পরিকল্পনা।” দিলীপকুমারের সুরও ‘স্বতোবিরোধী’ স্বর-কাঠামোর রসায়নাগার। তাঁর গায়কিও ‘নাট্যসঙ্গীতের স্থাপত্য-পরিকল্পনা’। ‘বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম’ গানটি নামকীর্তন এবং লীলাকীর্তনের মধ্যে দ্বিতীয় ভাগের। কিন্তু নিছক তত্ত্বভাষের লীলাকীর্তন নয়। বরং লীলাস্মৃতিনির্মিতি। আখরের পাশাপাশি প্রস্তুত নাট্যমূহূর্তও— ‘ওরা হাসে/ জানে না, তাই হাসে/ওরা মানে না, তাই হাসে/ আমি মানি, তাই জানি/আমি অন্তরে তোমার বাঁশরি শুনেছি/ তাই বঁধু আমি জানি’। যেন, গানের মধ্যে কোনও এক অবিশ্বাসী ‘ওরা’র সঙ্গে বিশ্বাসী সঙ্গীতকারের ছদ্মপ্রতর্ক চলছে। দু’পর্বের অপেরা যেন। প্রথমে আপাত-নিস্তেজ গতি আধোঘুমের জাদুজগৎ বুনছে। উচ্চারণেও আধো-আধো ভাব, ঘুমজড়ানো গলা যেন। কিন্তু তার মধ্যেও ‘তারা-ঝিকিমিকি’র ছটা আকাশপর্দা ছুঁয়ে যাচ্ছে। ক্রমে সেই গান প্রত্যয়পথে অবতীর্ণ। ‘চিররঙিনের রঙে রাঙানো’ এমন গান ‘এ-পৃথিবী একবার পায়’!
এত ব্যতিক্রমী গায়কি, কঠিনও এত, তবু তাঁকে পেলে জনসমুদ্রে জোয়ার নামত কেন? অমিতশক্তির জাদু। ইতিহাসের সাক্ষী থাকাও প্রাপ্তি। সমসময়ের বাঙালি বুঝেছিল, দিলীপকুমার মানেই বেড়া ভাঙার শব্দ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রধান তর্ক, গানে শিল্পীর স্বাধীনতা, যাকে পরে নিজের ভুল বলে মেনেওছিলেন, সেই স্বাধীনতা তিনি শুধু নিজের গানেই নেননি, অন্যের গানেও নিয়েছেন। বাবার ‘ধনধান্যপুষ্প ভরা’ গেয়েছেন ‘ধনধান্যে-পুষ্পে ভরা’। কিন্তু সে গানের মাধুরী আর কার শ্রীকণ্ঠে এমন মায়াশিল্প? সে গানের ‘কোথাও খুঁজে’ অংশের ‘কোথাও’ এই প্রতিস্পর্ধী, তো ওই আদুরে। একই ভাবে, ‘লচক লচক বিজুলি ঝলক’ আহ্বানের আগেই আগমন সুনিশ্চিত করে মনমোহনের। ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে’র ‘শিখাময়ী’ উচ্চারণ আগ্নেয়গিরিমুখে শলাকাসংযোগ। গানে ‘ম’, ‘ন’ বা কোমল বর্গের ধ্বনি থাকলে, তা তাঁর ভক্ষ্য। তার হাড়মজ্জা চেটেপুটে না-খেয়ে ছাড়েন না। উচ্চারণের বারুদেই ‘চুম্বনে আজ আগুন লাগে তাই তো আমার গানে’।
দিলীপকুমারের গানের ভক্তিমার্গ প্রেমপথ। যা লিখেছেন-গেয়েছেন, নিশিকান্তকে দিয়ে লিখিয়েছেন যা, উমা বসুকে দিয়ে যে-সব ‘শিহরধারা’ বইয়েছেন, সব প্রেমই। রুদ্ধ বাঁধজলের মুক্তির আকুতি। ‘রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে’ গানে সে গর্জন। সে আর্তি ‘যুগ-যুগ’ আছে ‘পথ চাহিয়া’। সে সন্ধান ‘কোন সে-অতলতলে প্রেমের মানিক জ্বলে, তার। সে কামনা চাতকের ‘ঊষর জীবনে করুণার বারি’র।
“অতি-জটিল বুননের কারণে যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পরে পাঠকের কাছে আর গ্রহণযোগ্য রইল না, দিলীপকুমার রায়ের সুরের কারুকৃতি তাঁর নিজকণ্ঠে অপূর্ব স্বর্গ উপহার দিলেও অন্যের পক্ষে সে-গায়নরীতি আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। তাই পরম্পরা রইল না।” এ কথা জয় গোস্বামীর, যিনি ওই অদ্বৈত-বংশেরই ত্রয়োদশ প্রজন্ম। ‘বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম’ গানের জাদুবাস্তবতায় অবিশ্বাসীর মনেও ‘কৃষ্ণকাহিনি’ আর ‘কল্পনা-কবিকথন’ থাকে না। কিন্তু আশঙ্কা হয়, দ্রুত হয়তো সুরসুধাকর নিজেই ‘কল্পনা-কবিকথন’ হয়ে উঠবেন নতুন প্রজন্মের কাছে। হয়তো সে-সর্বনাশ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy