‘স্বর্ণ-শিল্পী’দের সুর বেজে ওঠে একলা বাঙালির নিঝুম ঘরের কোণে, বা বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপে।
বাতাসে বারুদের গন্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল। অস্থির সময়েও, একটি বছরে সতেরোটি গানের রেকর্ডের আত্মপ্রকাশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও বাঙালির পুজোর গানের দৌড় চলল নিজের গতিতেই।
যা-ই ঘটুক, বঙ্গের আকাশে ‘সাদা মেঘের আলস্য’-র আমেজটি যে ব্যতিক্রমী। সে আমেজেই বেজে ওঠে পুজোর গান। তত্ত্বতালাশ করলে নজরে পড়ে গ্রামোফোন কোম্পানি, হিন্দুস্থান, মেগাফোন প্রভৃতি সংস্থার পুজোর গান নিয়ে প্রকাশিত ‘শারদীয় অর্ঘ্য’, ‘প্রণমামি শ্রীদুর্গে’, ‘শরৎ বন্দনা’ শীর্ষক পুস্তিকা। দু’পিঠে দু’টি গানের রেকর্ড, চারটি গানের এলপি, বারোটি গানের এলপি— বাজার করতে এসে পুজোর গান আর পুস্তিকাগুলির ভান্ডার উপচে পড়ে বাবু-গিন্নিদের ব্যাগপত্রে।
উপচে পড়া ‘স্বর্ণ-শিল্পী’দের সুর বেজে ওঠে একলা বাঙালির নিঝুম ঘরের কোণে, বা বারোয়ারি পুজোর মণ্ডপে। এই আবহের একটা মঞ্চ যেন তৈরি করে ‘আকাশবাণী’, নতুন গানের সাজি নিয়ে। আর তা নিয়ে ঘরে-বাইরে তুফান ওঠে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মেয়েবেলার স্মৃতি হাতড়ে জানাচ্ছেন বাচিক-শিল্পী ঊর্মিমালা বসু। শ্যামল, মানবেন্দ্র, আরতি, দ্বিজেন, সন্ধ্যা... বাঙালির পুজোর গানের ভান্ডার উপচে পড়েছে।
এই পুজোর গান ব্যাপারটা কী? সঙ্গীতপ্রেমী, রেকর্ডিং সংস্থার কর্তা বিমান ঘোষকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, “‘পুজোর গান’ হল শারদোৎসবে বাঙালির মন রঙিন-করা, স্মৃতি উদ্বেল-করা রেকর্ড সঙ্গীত।... পুজোর গানের প্রস্তুতি রেকর্ড কোম্পানিতে চলে প্রায় সারা বছর।”
এই প্রস্তুতিপর্বেই দেখা যায় সুরকার পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবর খানকে। ১৯৮৫-তে। গায়ক, হৈমন্তী শুক্ল। কখনও আবার লতা মঙ্গেশকরের গানে সুর সংযোজন করেন কিশোরকুমার, কখনও উল্টোটা! বঙ্গ-জীবনের সঙ্গে শারদ-গানের এই সম্পর্কটি যেন নিবিড় হয় রবিশঙ্করের কথায়: “গানও পুজোই। আমার জীবনের সংস্কারেও পুজো মিশে আছে।” সংস্কারের সূত্রটি লগ্ন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। চৈতন্যভাগবত-এ লেখা, “মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সব ঘরে।/ দুর্গোৎসব কালে বাদ্য বাজাবার তরে।”
কিন্তু শুধু গান নয়, এই সময়টা ‘সাহিত্যের বার্ষিক উৎসব’ও। সে উৎসবের কারিগরদের অন্দরমহলটি কেমন থাকে? আনন্দবাজার পত্রিকা-য় যোগ দেওয়ার পরে, মতি নন্দী নিজে পুজোর লেখায় ব্যস্ত। রাত ৮টা। আনন্দবাজার অফিস। মতি যাচ্ছেন আনন্দমেলা-র লেখা জমা দিতে। দেখলেন, দেশ পত্রিকার কাচঘেরা ঘরে এক লেখক একা বসে। টেবিলে খোলা প্যাড। বাঁ হাতে সিগারেট। ডান হাতে কলম। জানালেন, দেশ-এর লেখাটা লিখছেন। লেখা জমা দিয়ে ফিরতি পথে মতি দেখলেন, লেখকটি লিখছেন। মনে হল, “এখন বন্যার জলে ওর কোমর ডুবে গেলেও লেখা বন্ধ হবে না।”
কী ভাবে এমন দানবের মতো লেখেন ওই লেখক? ব্যাখ্যা দিলেন মতি। লেখকের আদ্যক্ষর, ইংরেজিতে এস জি, বাংলায় সু গা। মতির প্রশ্ন, “আর কারুর নাম মনে পড়ে? এক দানব ব্যাট দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি রান তুলেছে আর একজন কলম দিয়ে রাশি রাশি শব্দ ছড়িয়েছে, স্রেফ ওই আদ্যক্ষরের মিল থাকায়!” সুনীল গাওস্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এক আসনে বসালেন তিনি। ঘটনাচক্রে, উপন্যাস-শিল্পী হিসেবে সুনীল (আত্মপ্রকাশ) ও আর এক লেখক নবনীতা দেব সেনের (আমি, অনুপম) ‘ডেবিউ’ পুজোসংখ্যাতেই।
কিন্তু এই পর্বে লেখকের ছুটির আকালপনাও থাকে। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাই সমরেশ বসু একটি চিঠিতে লিখছেন, “এ সময়টা লেখকদের অবস্থা অনেকটা ঋণশোধ-এর বালক উপনন্দের মতো। বাইরে কাঁচা সোনার রোদ, ঘরের ভিতর বসে উপনন্দ লিখে চলেছে।... তার ছুটিও এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে।”
হয়তো ছুটির সঙ্গে পুজোর সৃষ্টির সহাবস্থানে এক ধরনের তৃপ্তি আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন রোগশয্যায়। ছেলে রথীন্দ্রনাথ সদ্য প্রকাশিত শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা এনেছেন। চিকিৎসকের নিষেধ। তবুও তাতে প্রকাশিত ‘ল্যাবরেটরি’-তে চোখ বোলালেন রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু এই পর্বটি সম্পাদকদের কাছে ‘রস-কষ হীন’। সঙ্গে আবার যদি প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকেরা থাকেন! লেখার খবর নিতে প্রেমেন্দ্রর বাড়ি গিয়েছেন দেশ-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। প্রেমেন্দ্র মিত্রের জিজ্ঞাসা, পূর্ব দিকের জানলাটা দেখেছে কি না। হ্যাঁ বলতেই প্রেমেন্দ্র বললেন, “মামলায় সাক্ষী দিতে হবে।” লেখার প্রসঙ্গ তুলতেই চিৎকার। পড়শির সঙ্গে জানলা-দেওয়ালের মামলার সময় লেখা চাওয়া!
সবাই এমন নন। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, দুই লেখক-বন্ধু যেন প্রতিদ্বন্দ্বী। এক মজলিশে নরেন্দ্রনাথের পুজোর লেখার সংখ্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। ঢুকেই নরেন্দ্রনাথের আক্ষেপ: “আমার লেখার বায়না রয়েছে অষ্টমী পর্যন্ত। আর নারানের বিসর্জনের দিন পর্যন্ত!”
বস্তুত, বাঙালি পাঠকের পুজোর সাহিত্যে আবাহন ঘটেছে বঙ্গবাণী, দিগন্ত, প্রসাদ, নারায়ণ, বিজলী, প্রবাসী, যমুনা, ভারতী, বসুমতী, এক্ষণ-সহ নানা পত্রিকার পুজোসংখ্যার পাতায়।
পুজোসংখ্যার পাতা ওল্টানোর ফাঁকে শারদ-আড্ডাও সগৌরবে চলছে। আড্ডাবাজ বাঙালির কাছে এমনিতে রবিবার আড্ডার দিন। কিন্তু সে আড্ডা যেন ধারাবাহিক উপন্যাসে ‘ক্রমশ’ দিয়ে রসভঙ্গ! আর পুজোর ক’দিনের আড্ডা পুজোসংখ্যার সম্পূর্ণ উপন্যাস! বলেছেন সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী।
উপন্যাস-সম আড্ডা শুধু পাড়ার প্যান্ডেলে, অষ্টমীর অঞ্জলিতে দৃষ্টি বিনিময়েই ভাষা পায়, তা নয়। আসে পুজোর থিয়েটারের প্রসঙ্গও। তেমনই এক আড্ডায় বাচিক-শিল্পী জগন্নাথ বসু জানান, পুজোয় অভিনেতাদের নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকত না, মঞ্চাভিনয়ের জন্য। অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এক বার দরিদ্র নারীর চরিত্রে অভিনয় করছেন। কিন্তু আক্ষেপ, নতুন শাড়ি পুজোয় ভাঙা হচ্ছে না। চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয় যে। কিন্তু এক দিন দেখা গেল, নতুন শাড়ি পরেই মঞ্চে উঠেছেন। কারণ, ‘পুজোর লক্ষণ’টা থাকা দরকার!
এই ‘পুজোর লক্ষণ’ তথা পুজোর আড্ডা গার্হস্থ-জীবনের সঙ্গেও লগ্ন। সাক্ষ্য নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। এক সময় পুজোর দিনগুলিতে ব্রিজের আড্ডায় মাততেন। কিন্তু এক বার পুজোয়, ‘ছেলেপুলের মা’ নানা জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা পাড়লেন। সায় নেই লেখকের। শেষে লেখক বলেন, “দ্যাখো... অনেক দিন তো আমায় ভাল করে খাওয়াওনি। বেশ আচ্ছা করে আজ সর্ষে-ইলিশ রাঁধো তো। খেয়ে একটা ঘুম লাগাই।”
শঙ্খ ঘোষের স্মৃতির পুজোতেও রয়েছে এক শান্ত গার্হস্থ-আড্ডার শৈশব-ছবি। সেখানে ঢুঁ দিলে কবি দেখান— দালানের বারান্দায় বাবা-কাকাদের সঙ্গে দাদুর কথাবার্তা। ভিতরের ঘরে হারিকেনের টিমটিমে আলোয় মা-কাকিমারা বসে আছেন। আর বাড়ির খুদেদের আড্ডায় জোর আলোচনা, কাল ভোরে কে কেথায় ফুল তুলবে!
আট থেকে আশি, বঙ্গ-জীবনের উৎসবের বাজার গান, লেখা আর আড্ডাতেই তো ওম পায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy