কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি এ বার লোকসভা জয়ের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে চারশোটি আসন। বিজেপি এই সংখ্যার যত কাছে থাকবে ভারতের গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের সঙ্কট তত বাড়বে। দেশের সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘুর অনিশ্চয়তার কথা মাথার রেখে বেশ কিছু রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, এ বার তা মুছে ফেলা হবে কি না তা নিয়ে অনেকেই আশঙ্কিত। গত দশ বছরের শাসনকালে সংসদের ভিতরে মুসলমান-স্বার্থের পরিপন্থী কিছু আইন ও পদক্ষেপ করা হয়েছে, অথচ দেশের নীতি নির্ধারণে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের অভাবে তাদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে।
নীতি নির্ধারণে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের কথা উঠলেই একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে— পরিচিতি বা ধর্মীয় জনজাতিগত মাপকাঠিতে সব কিছু বিচার করা কি সত্যিই দরকার? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আবার আলাদা করে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দরকার কেন? আইন দিয়ে হয়তো সব কিছু সমস্যার সমাধান করা যায় না, গণতান্ত্রিক নিয়মেই তো মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে পারত। অথচ, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পর দেখা গেল শাসনক্ষমতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই, যেমন সংসদ, আইন প্রণয়নকারী ও বিচার ব্যবস্থায়, প্রশাসনের প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব আণুবীক্ষণিক। দেশের সংখ্যায় সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘুর ‘লক্ষণীয় অনুপস্থিতি’র সরকারি সিলমোহর পড়ে সাচার কমিটি রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে।
দেশের সতেরোতম লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৫ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে, তা তাদের জনসংখ্যা ভাগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। দেশভাগের ফলে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের এক অংশ দেশ ত্যাগ করতে প্রায় বাধ্য হয়, ফলে মুসলমান সমাজে নেতৃত্বহীনতা ও বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে মুসলমানদের বিরাট অনুপস্থিতি দেখা দেয়। ব্যতিক্রম মাত্র দু’টি সংসদীয় নির্বাচন (১৯৮০ এবং ১৯৮৪), যেখানে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যা ভাগের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল (৯.২০ শতাংশ)। ১৯৭০ এবং ৮০-র দশকে, ইন্দিরা গান্ধীর রাজনীতির ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম রাজনীতিবিদদেরও প্রতিনিধিত্ব দিতে বাধ্য হয়।
এর পর মুসলিম রাজনীতিবিদরা কার্যত অদৃশ্য হয়ে পড়েন। আঞ্চলিক দলগুলি, বিশেষ করে উত্তর ভারতে কিছু মুসলমানকে বাহুবলী হিসাবে ব্যবহার করে, কিংবা মুসলিম নেতার দমনক্ষমতা বা সামাজিক প্রতাপকে তাঁর স্থানীয় এলাকার মধ্যেই আটকে রেখে দলগত ভাবে তার সুবিধাটা নেওয়া হয়। সন্দেশখালির ‘শাহজাহান’ এই পরম্পরার সংযোজন।
স্বাধীনতার পর থেকে জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া মুসলিম মুখ্যমন্ত্রীদের নাম এ প্রজন্মের অনেকেই বলতে পারবেন না। বরকতুল্লা খান (রাজস্থান), আব্দুল গফুর (বিহার), আনোয়ারা তৈমুর (অসম), এ আর আন্তুলে (মহারাষ্ট্র), এম আলিমুদ্দিন (মণিপুর), এম ও এইচ ফারুক (পুদুচেরি)। এঁরা ক্ষমতায় বসেন যখন ইন্দিরা গান্ধী তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মধ্যগগনে। মোট লোকসভা সদস্যের মধ্যে মুসলমান সাংসদও সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই সময়েই।
জনসংখ্যার কারণে সংসদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের সবচেয়ে বড় অংশ আসত অসম, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে। অসম ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সংসদে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব কমতে থাকে। বিদায়ী লোকসভায় মাত্র ২২ জন সাংসদ মুসলমান। প্রধান বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ কমে আসছে। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, এনসিপি এবং সিপিআই(এম) মিলিয়ে এ বার ৭৮ জন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনীত হয়েছেন, ২০১৯-এ ১১৫ জন এই সুযোগ পেয়েছিলেন। সংবিধানে সংরক্ষণের সুবিধা থাকায় তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা বা পঞ্চায়েতগুলিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, মুসলামদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ হয়নি।
কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব জরুরি— এ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যান ফিলিপস ‘ধারণার রাজনীতি’র থেকে ‘উপস্থিতির রাজনীতি’ (পলিটিক্স অব প্রেজ়েন্স)-কে আলাদা করে দেখিয়েছেন। ‘ধারণার রাজনীতি’র সমর্থকরা দাবি করেন নীতির প্রতি দায়বদ্ধতাই প্রধান বিষয়, কে বলছে তার উপর কী বলা হচ্ছে, নির্ভর করে না। অ্যান ফিলিপস মনে করেন, ‘উপস্থিতির রাজনীতি’ নারী, সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে।
‘উপস্থিতির রাজনীতি’র সবচেয়ে জোরের জায়গা সমাজের সিদ্ধান্ত ও নীতি নির্ধারক সংস্থাগুলিতে নিশ্চিত উপস্থিতির মাধ্যমে তাদের মতামত এবং স্বার্থ রক্ষা করা। প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়লে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী কেবল নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে এমন নয়, এর ফলে বৈচিত্রের সঙ্গে যুক্ত বিপুল অভিজ্ঞতারও সদ্ব্যবহার হবে।
ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুরুবাদ রাজনীতি উত্থানের ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো গভীর ভাবে বোঝা শাসকদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ছে। এর কারণগুলো হল, মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে দূরত্ব, এবং তাদের সমস্যা বোঝার জন্য যে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন তার বড় অভাব এবং ইসলাম-বিদ্বেষ। মুসলমান সম্প্রদায় আসলে কী চায়, এ বিষয়ে শাসকরা জানতেই চান না।
ধর্মীয় পরিচিতি বাদ দিয়ে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে তাদের নেতৃত্বদানের যোগ্য করে তোলার প্রয়োজন ছিল। কার্যকর প্রতিনিধিত্বের অভাবেই তাদের দুর্দশার কথা সঠিক প্ল্যাটফর্মে উঠে আসে না। তার কথা বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের যোগ দান নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy