Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Indian Rupee

ডলারের তুলনায় টাকার দামের পতন কি অর্থনীতির দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে?

ডলারের নিরিখে ভারতীয় টাকার দাম ক্রমশ কমেছে। এই ছবিটি কি ভারতীয় অর্থনীতির এক বিপর্যয়কে তুলে ধরে? নাকি এর দ্বারা অন্য কিছু বোঝায়?

টাকার দাম কমা দেশের পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক

টাকার দাম কমা দেশের পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২২ ১২:৪২
Share: Save:

যে সময়ে পি চিদম্বরম দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর মতো এক সর্বংসহ রজনীতিকও কিছু বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘টাকার দাম নতুন করে নিম্নগামী’ অথবা ‘টাকার মূল্যের রেকর্ড পরিমাণ অধোগতি’ গোছের সংবাদ শিরোনাম। টাকার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টিকে চিদম্বরম তাঁর নিজের কাজের প্রতিফলন হিসেবে দেখতেন। এমন সব শিরোনামের বিপরীতে তাঁর একটি বক্তব্য ছিল। সেটি এই যে, প্রতিটি পতনকে (এমনকি, সেটি সামান্য কয়েক পয়সার হলেও) ‘রেকর্ড পরিমাণ অবনমন’ বলে মনে হতে পারে। সংবাদ শিরোনাম এবং তার প্রতি অর্থমন্ত্রীর সংবেদ, উভয়েই এক দুর্বল মুদ্রামানের বিপক্ষে এক মানসিক পক্ষপাতকে হাজির করে। এবং কার্যত মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধির থেকে অনেক বেশি নজর কাড়ে সেই মানের অধোগতি।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই পুরনো কাসুন্দি কোন প্রসঙ্গে ঘাঁটলাম? কারণ, সংবাদ শিরোনাম আরও এক বার জানাচ্ছে যে, আমেরিকান ডলারের নিরিখে ভারতীয় টাকার দাম ‘নতুন করে’ কমছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলি যে কথাটি জানায় না (সেটি নির্মলা সীতারমন গত বৃহস্পতিবার দেখিয়াছেন) সেটি হল এই যে, আমেরিকান ডলারের নিরিখে পৃথিবীর প্রায় সব মুদ্রার মানেরই অবনমন ঘটছে। ভারতীয় টাকা সর্বনিম্ন মানে পোঁছায়নি বটে, তবে অবনমনের মাত্রা কিছু কম নয়। ২০২২-এর প্রথমার্ধে তা প্রায় ৬ শতাংশ। এর সঙ্গে তুলনা টানলে দেখা যাবে, ইউরোর মানের অবনমন ঘটেছে ১১.৬ শতাংশ, ইয়েনের ক্ষেত্রে ১৯.২ শতাংশ আর পাউন্ডের বেলায় তা দাঁড়িয়েছে ১৩.২ শতাংশে। চিনের ইউয়ানের মানের মধ্যে অবনমনের চিহ্ন কমই দেখা যায় (৩.৬ শতাংশ)। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পাকিস্তানে সম্প্রতি আরও অনেক কমেছে। এমন ক্ষেত্রে সংবাদের আরও উপযুক্ত শিরোনাম এই মর্মে আশা করা গিয়েছিল যে, বাকি সব মুদ্রার তুলনায় ভারতীয় টাকার দাম ঊর্ধ্বগামী। কিন্তু তেমন খবর হয়নি।

তাতে কি কিছু আসে-যায়? উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ। অনেক কিছুই আসে-যায়। কারণ, এমন শিরোনাম নীতিকে ভুল দিশায় চালিত করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল এক ‘শক্তিশালী মুদ্রামান’ সংক্রান্ত নীতির পক্ষে সওয়াল করেই। এই নীতির উদ্ভাবকেরা যে বিষয়টি উপেক্ষা করেছিলেন, সেটি এই— দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ইতিহাসসমৃদ্ধ প্রায় সব দেশেই (চিন ও জাপান এর সব চেয়ে ভাল উদাহরণ) রফতানি বাজারকে ধরার জন্য ‘দুর্বল মুদ্রা’-র নীতি অনুসরণের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। এর পিছনে ক্রিয়াশীল কারণটি কিন্তু সরল— যদি কোনও দেশ প্রাথমিক ভাবে দামের ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নামে, যে হেতু সে দেশের পক্ষে অন্যদের সঙ্গে উৎপাদন-প্রযুক্তি এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অসম্ভব, এমন ক্ষেত্রে দুর্বল মুদ্রামান সাহায্য করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, যখন রফতানি বাণিজ্য যথেষ্ট গতি লাভ করেছে, অর্থনীতিতে বাহ্যিক দক্ষতা প্রতিফলিত হচ্ছে, ঠিক তখনই মুদ্রার মূল্যমান হ্রাসের খেলাটি সম্পূর্ণ বদলে যায়।

বহু মানুষই দেশ ও মুদ্রার এই দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারণ সম্পর্কের তত্ত্বে অনেক ত্রুটি দেখতে পান। শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকা একটি দেশের অর্থনীতি যে পুঁজি সরবরাহ দ্বারা পুষ্ট হয়ে সবল মুদ্রামান অর্জন করবে, এমনই সাধারণত ভাবা হয়ে থাকে। এই কারণ নির্ণয়ের বিষয়টি কিন্তু অন্য দিক থেকে দেখলে সম্ভবই নয়। এমন দেশ, যাদের অর্থনীতি দুর্বল অথবা যেখানে মুদ্রস্ফীতির হার ভয়াবহ, তেমন ক্ষেত্রে কিন্তু তত ক্ষণ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় না, যত ক্ষণ না তাকে কৃত্রিম ভাবে চাঙ্গা করা হচ্ছে বা তাকে কোনও ঠেকনা দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হচ্ছে।

এমন নীতি অবশ্যই দীর্ঘ কাল ধরে চলতে পারে না। এমন ক্ষেত্রে পুঁজি হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, চার দশকেরও বেশি সময়কাল জুড়ে (নেহরুর ‘আত্মনির্ভরতা’-র বছরগুলিকে ধরে) ভারত তার টাকার মূল্যমানকে বেশি মাত্রাতেই দেখেছে। সুতরাং, যেখানে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি তাদের বাণিজ্যকে উজ্জীবিত রেখেছে, সেখানে বিশ্ববাণিজ্যে ভারতের অংশগ্রহণের মাত্রা সামগ্রিক ভাবে প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ১৯৪৭ সালে কমবেশি ২.৫ শতাংশ থেকে তা কমে ০.৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।

দু’টি বিপরীতমুখী তুলনা বিষয়টির সমর্থনে পেশ করা যায়। ভারতীয় টাকার দাম পাকিস্তানের টাকার চাইতে এই মুহূর্তে বেশি (পাক মুদ্রার মান আমেরিকার নিরিখে ১ ডলার=২০৫ টাকা)) কারণ, পাকিস্তানের অর্থনীতি এক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই মাপকাঠির অন্য মেরুতে তাইল্যান্ডের ভাট এক সময়ে ভারতীয় টাকার থেকে ১০ শতাংশ বেশি মূল্যমান অর্জন করতে পেরেছিল। কিন্তু এখন তার মূল্য ভারতীয় নিরিখে ২ টাকা ২০ পয়সা। শক্তিশালী মুদ্রামান নিয়েও তাইল্যান্ড তার বাৎসরিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত লক্ষ করছে। ১৯৯১-এর পরে যখন তার মুদ্রা ও অন্যান্য নীতি আরও বেশি বাজারমুখী করে তোলা হয়, তখন ভারতের বাণিজ্য এবং মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ডে উন্নতির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও টাকার মূল্যমানের ক্রমাগত অবনমনের ফলে এই মুহূর্তে বাণিজ্য ঘাটতি বেশ লক্ষণীয়। এ কথা স্পষ্ট যে, এখনও পর্যন্ত যে পরিমাণ সংস্কার সম্ভব হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।

যদি ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা টাকাকে অধিকতর শক্তিশালী মানে দেখতে চান, তা হলে অর্থনীতি পরিচালনার বিষয়ে তাঁদের আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদনশীলতা বিবর্ধন ইত্যাদির প্রতি নজর দিতে হবে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গেলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককেই লক্ষ লক্ষ ডলার ঢালতে হবে— এই মনোবৃত্তি আদ্যন্ত ভুল পন্থায় চালিত করে। বাস্তবের চিত্রটি এই প্রকার— সাম্প্রতিকতম সময় বাদ দিলে ভারতে মুদ্রাস্ফীতি তার গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলির তুলনায় বেশিই থেকেছে। সে দিক থেকে দেখলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভারতীয় টাকার ক্রয়ক্ষমতা তার তুলনামূলক ভাবে কম বিনিময়মূল্যে প্রতিফলিত হবে, এমন ঘটনা স্বাভাবিক। কর্মক্ষমতার গতিছন্দের বদল ঘটানো গেলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারতীয় টাকা স্বাবলম্বী হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Rupee Devaluation economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE