বীরভূমের পঞ্চায়েত এলাকায়, শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র চৌদ্দ কিমি দূরের এই গ্রামে বসবাস— বছর দুই হল। তফসিলি জাতি ও জনজাতি, বর্ণহিন্দু, মুসলিম মিলিয়ে কয়েক হাজার লোকের বাস। তিনটি স্কুল, খেলার মাঠ, চাষের খেত, পুকুর, আমবাগান, গরুর গাড়ি, খড়ের গোলা, সব মিলিয়ে আদর্শ গ্রামের ছবি— ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি আছে আমাদের পাড়াখানি’। গ্রামে থাকতে এসে সেই মায়াটুকু গেল মুছে।
পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজ় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, ছোটবেলার মালগুডি ডেজ়-ও মনে গাঁথা ছিল। প্রথমটির পটভূমি উত্তরপ্রদেশের গ্রাম, বঙ্গবাসীর কাছে অনুন্নত ‘কাউডাং বেল্ট’। কিন্তু শিক্ষিত, আত্মশ্লাঘায় ভোগা বাঙালি ক’টা গ্রামে কত দিন কাটিয়েছে? ‘প্রধানজি’র মোবাইলে ফোন এলে গান বাজত ‘রিংকি কে পাপা...’ বাংলার এই গ্রামেও রিংকি আছে। তার বাবা-মা, দুটো মোষও আছে, শুধু এই রিংকির ‘পাপা’ আর একটি বিয়ে করে আলাদা থাকেন। কিন্তু মদ খেতে আসেন এ বাড়িতেই। রিংকির মা আর ঠাকুমা রোজ বানান এই মদ।
প্রথমে চাল সেদ্ধ করে নিয়ে তার জল শুকিয়ে ফেলা, সেই ভাত মেলে শুকিয়ে তাতে বাকড়গুঁড়ো মিশিয়ে, জল দিয়ে মাটির হাঁড়িতে মুখ বন্ধ করে বস্তায় বেঁধে রাখা। দু’দিন পর তৈরি হাড়িয়া। যে উনুনে সত্যনারায়ণের ভোগ, রোজের রান্না, তাতেই হাড়িয়াও হয়। মদ তৈরির এই কেমিক্যাল বাকড় রোজ পাড়ায় ঠেলাগাড়ি করে বিক্রি হয়। বাড়ির মেয়েদের কাজে আর এক সংযোজন: মদ বানাও।
গ্রামে এসে অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল। পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্য লাইব্রেরি, ফুটবল, বিনা বেতনে পড়ানোও। ক্লাস সেভেনের রিংকিকে দিয়ে গেলেন তার ঠাকুমা, আশা: সে বড় হয়ে চাকরি পাবে। রিংকির বইয়ের পাতায় পাতায় নানা তারিখ, যেন নিয়মিত পড়াশোনার প্রমাণ। আদতে গ্রামে ক্লাস সেভেনের বেশির ভাগ রিংকিরা বাংলা পড়তেই স্বচ্ছন্দ নয়। বানান করে শব্দ উচ্চারণেও সক্ষম নয় অনেকেই। অক্ষরপরিচয় পর্বেই লুকিয়ে সমস্যা। রিংকি লিখতে পারে কিন্তু সেই লেখা পড়ে কোন শিক্ষক কী ভাবে তার মূল্যায়ন করবেন, অজানা। মানসিক ও শারীরিক ধকলের কথা ভেবে রিংকিকে না বলতে হল।
ইচ্ছে ছিল চাষ করব গ্রামে। এ দেশ মহিলা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি দুই-ই দেখেছে, এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মহিলা, কিন্তু বীরভূমের এই গ্রামে আমার একমাত্র পরিচয় ‘মেয়েছেলে’— কাজকর্ম, বোধবুদ্ধি সবেতেই এই স্টিকার সেঁটে দেওয়া রীতি। জনজাতিরা মাদল বাজায়, নাচে, গায়, অনাড়ম্বর ও সহজ জীবন তাদের— এই ধারণায় জল ঢেলে দিল বাস্তব অভিজ্ঞতা: পুরুষেরা নেশাখোর ও অলস, মেয়েরা ভোররাত থেকে কাজ শুরু করে, সূর্য অস্ত গেলেও তাদের ছুটি হয় না। সংসার তারাই চালায়, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান, অধিকার, একটু যত্ন, দুরাশা।
এক বিকেলে বাড়িতে বিষধর সাপ ঢুকে যাওয়ায় ভয়ে ছুটে গেলাম পাশের বাড়ি, সাহায্যের আশায়। বাড়ির মালিক বছর চৌত্রিশের পুরুষটি স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন, তাঁর নির্লিপ্ত উত্তর “সময় নেই, মাতালশাল যাব।” প্রতিবেশীর নির্লিপ্ততা আমাকে শেখাল সাপ তাড়াতে। আসল গ্রাম কি এখন এমনই, বিপদে পাশে না দাঁড়ানো গ্রামেরও নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে? অবশ্য নিরন্তর সহজ সরল হয়ে থাকার দায় তো গ্রামেরও নয়।
জাতপাত, হিন্দু-মুসলিম এ সবের বাড়বাড়ন্ত বিজেপির হাত ধরে। চৌত্রিশ বছর বাম শাসনের পর পরিবর্তন এসেছে, গ্রামে সবাই শাসক দলের সমর্থক। এ দিকে মুসলিম গৃহসহায়িকা রাখায় আপত্তি ও বিপত্তি। এ গ্রামে মুসলিমরা একটি পাড়ায় থাকে, সব পাড়ায় তাদের বাড়ি করার অধিকার নেই। মুসলিম পাড়ায় অনেকগুলো পরিবারের বসবাস প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের। নিচু জাতের হিন্দু বা মুসলিম কেউ উঁচু জাতের কারও বাড়িতে এলে তাকে মাটিতে বসার ইশারাই গ্রামের দস্তুর। অর্থবান উঁচু জাতের হিন্দুরা আবেগে আক্ষেপে ‘ছোট জাত’-এর বাড়বাড়ন্তকে অভিসম্পাত দেন নিয়মিত।
সরকারি শৌচালয় প্রকল্পের করুণ দশা, সাক্ষী পুকুরপাড় আর খেতের ধার। ভোরে দেখা যায়, গ্রামের ছেলের দল সানগ্লাস পরে কানে হেডফোন গুঁজে স্মার্টফোন হাতে ঝোপে প্রাতঃকৃত্য সারছে। গ্রামের এক কিশোর স্কুল ছেড়ে জনমজুরি করছে। তার স্মার্টফোন চাই, স্বপ্ন: টিকটক ভিডিয়ো বানাবে।
দিদি গর্ভবতী, টুকটুকি তাই রোজ জামাইবাবুর সঙ্গে শশাখেতে কাজ করে। ক্রমে জামাইবাবু ও শ্যালিকার প্রেম। জামাইবাবাজি ঘরজামাই—শ্বশুরের দুই মেয়ে, বাড়িতে একটা ছেলে দরকার, নইলে মুখাগ্নি কে করবে? জামাইয়ের জেদ, দিনকয়েক মান-অভিমানের পর সে এখন দুই মেয়েরই স্বামী, এক বাড়িতেই থাকে। সিরিয়ালে হয়, বাস্তবেই বা হবে না কেন?
কত বার তাই মনে হয়েছে, এই গ্রামটাও যদি ‘রিংকি কে পাপা’র গ্রামের মতো হত! যেখানে মন্দ কিছু ঘটলে সব ভুলে সবাই সবার পাশে দাঁড়াত! জীবন থেকে উঠে আসা গল্প যদি বাস্তব হয়ে উঠত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy