ফাইল চিত্র।
আর্থিক অসাম্য যেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বণ্টনে প্রভাব না ফেলে, সরকারকেই তা নিশ্চিত করতে হবে, বললেন কৌশিক বসু
প্রশ্ন: দিনকয়েক আগে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ় বলেছিলেন যে, কোভিডের ফলে স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হল, তা অচিরেই সামলে নেওয়া যাবে; এমনকি অর্থব্যবস্থার ক্ষতিও সম্ভবত মেরামত হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে অতিমারি আর লকডাউনের যে প্রভাব পড়ল, তা একটা গোটা প্রজন্মের ছেলেমেয়ের সারা জীবনকে প্রভাবিত করবে। আপনি এই কথাটার সঙ্গে কতখানি একমত?
কৌশিক বসু: অতিমারিতে অর্থব্যবস্থার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। সেটা সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে আবার একটা বড় ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু, এটা ঠিকই যে, সেই ক্ষতিও পূরণ করে ফেলা সম্ভব। এই যে ছেলেমেয়েরা দেড়-দু’বছর স্কুলে গেল না, সে ক্ষতি সত্যিই ভয়ঙ্কর। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে কানেক্টিভিটি আছে, স্কুলে না গেলেও জ়ুমে ক্লাস করে নিতে পারে ছেলেমেয়েরা, বাড়িতেও দেখিয়ে দেওয়ার লোক আছে। কিন্তু, দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের এই সুযোগগুলো নেই। আমরা যখন দিল্লিতে থাকতাম, তখন এক মহিলা আমাদের গৃহসহায়িকার কাজ করতেন। এখনও তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয়। তাঁর মেয়েটি দু’বছর ধরে বাড়িতে বসে রয়েছে। কিচ্ছু শেখেনি এই দু’বছরে। ‘নানৃতম’ নামে একটি অসরকারি সংস্থার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ, তারা পুরুলিয়ার পাড়ায় একটা স্কুল চালায়। ওরাও আমায় বলছিল যে, নিয়মিত জ়ুমে ক্লাস হওয়ার পরও বহু ছেলেমেয়ের শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে অনেক। ওরা সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। কিন্তু, বেশির ভাগ জায়গাতেই তো সেই চেষ্টাটুকুও হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি যে, লকডাউনের ফলে শিক্ষার যে ক্ষতি হল, সেটা এক প্রজন্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এখন যারা ঠিক মতো লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেল না, তাদেরই কেউ কেউ ভবিষ্যতে শিক্ষক হবে— তাদের কাছে তখন যারা পড়বে, তাদেরও শিক্ষায় ঘাটতি থাকার আশঙ্কা।
আমি একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই— এই নিরিখে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। ইউনেস্কো-র পরিসংখ্যান অনুসারে, কোভিড-১৯’এর কারণে গোটা দুনিয়ায় দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে স্কুল বন্ধ ছিল ভারতে, ৮২ সপ্তাহ। এর চেয়ে বেশি দিন স্কুল বন্ধ ছিল একমাত্র উগান্ডায়, ৮৩ সপ্তাহ। বিশ্বে এই গড় ৩৮ সপ্তাহ।
লকডাউনের ফলে যাদের লেখাপড়ায় ক্ষতি হল, যারা ড্রপআউট হল, তাদের সারা জীবনের মতো আর্থিক সম্ভাবনা খাটো হয়ে গেল। সেই ঘাটতির প্রভাব তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপরেও পড়বে। আবার, গোটা দেশের কথা যদি ধরি, এখন বারে বারেই বলা হচ্ছে যে, মানবসম্পদ যে কোনও দেশের আর্থিক উন্নয়নের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। এই দু’বছরে সেই সম্পদেরও বিপুল ক্ষতি হল। আর একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি— অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব বলে যে, দেশের আর্থিক উন্নতি বহুলাংশে নির্ভর করে বিনিয়োগের উপর। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেই যেমন, বিনিয়োগ আর বৃদ্ধি হাত ধরে চলেছে। ভারতে বিনিয়োগের অনুপাত নেহাত কম নয়। কিন্তু, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ সম্বন্ধে সেই কথা বলা যাবে না। শিক্ষায় যদি লগ্নি না হয়, তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
প্র: দেশের বা রাজ্যের সরকার কি এই ক্ষতির পুরো চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে?
উ: না। তার কারণ হল, এটা মূলত অদৃশ্য ক্ষতি। যে ক্ষতিগুলো চোখের সামনে দেখা যায়, সরকার সেগুলোর ক্ষেত্রে অনেক তৎপর। মূল্যস্ফীতি ঘটলে তৎক্ষণাৎ মানুষের গায়ে তার আঁচ লাগে, ফলে সরকারও সেটা সামলাতে তৎপর হয়। বেকারত্বের সমস্যাও মাসখানেকের মধ্যেই পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি হচ্ছে, তার ফল টের পেতে দীর্ঘ দিন সময় লাগবে। আপাতত যেটুকু চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে, তা হল, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে না। সরকার যেটুকু চেষ্টা করছে, সেটা এই ক্ষতি সামলানোর জন্যই।
প্র: পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার চেষ্টা করেছে ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোন, ডেটা প্যাক ইত্যাদি দিতে। কিন্তু, সেটা কি যথেষ্ট?
উ: স্মার্টফোন, ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেও অনেক ছেলেমেয়েই যথেষ্ট শিখছে না, এই সমস্যাটা শুধু ভারতের নয়, গোটা দুনিয়াতেই একই ছবি। কিন্তু, এই উপকরণগুলো হাতে থাকলে অন্তত স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগটুকু থাকছে, না হলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাতে বড়লোকের সঙ্গে গরিব মানুষের যে ব্যবধান— ভারতে যা এমনিতেই বিপুল— তা আরও বেড়ে যাবে।
প্র: সাম্প্রতিক কালে ‘এডটেক’ অর্থাৎ শিক্ষাপ্রযুক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে, সংস্থাগুলির বাজারও বাড়ছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইড এবং অসাম্য আরও বাড়াবে?
উ: হ্যাঁ, এতে ডিজিটাল ডিভাইড বাড়বে। কিন্তু গোটা দুনিয়াতেই শিক্ষাব্যবস্থা বদলে গিয়েছে। আমেরিকায় যেমন এখন বিভিন্ন কনফারেন্সে আর বক্তাদের সশরীর উপস্থিত থাকার দরকার হয় না, অনেকেই অনলাইন বক্তৃতা করেন। তাতে সুবিধাও তো হয়েছে— অনেক সহজে জ্ঞানীগুণী মানুষদের নাগাল পাওয়া যায়। কাজেই, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। এইখানেই সরকারের ভূমিকা— ডিজিটাল ডিভাইড যাতে না বাড়ে, গরিব মানুষের হাতেও যাতে স্মার্ট ডিভাইস থাকে, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি বলব, এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশংসা করতে হবে— এখানে খানিকটা হলেও চেষ্টা হচ্ছে, যাতে ডিজিটাল ডিভাইডটা ভয়ঙ্কর বেশি না হয়ে যায়।
প্র: আপনি মানবসম্পদে লগ্নির কথা বলছিলেন। আশঙ্কা থেকে যায় যে, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যেমন সরকারি পরিকাঠামো তৈরির বদলে বিমার ব্যবস্থা করার পথে হেঁটেছে— যেখানে মানুষকে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকেই পরিষেবা কিনে নিতে হবে, বনিয়াদি শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকার সেই পথে চলতে পারে। ছাত্রদের ভাউচার দিয়ে বলা হতে পারে যে, বাজার থেকে শিক্ষা কিনে নাও। এটা তো একটা বিপজ্জনক ঘটনা হবে।
উ: একেবারেই। এই ক্ষেত্রে আমি আমেরিকার স্বাস্থ্য বিমার কথা বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে আমার যথেষ্ট বিমা রয়েছে, কেউ কোনও বড় সংস্থায় ভাল চাকরি করলে তাঁরও যথেষ্ট বিমা আছে। কিন্তু, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যে ভাবে বিমা পরিচালনা করা হয়, সেটা লজ্জাজনক। ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে সেই লজ্জা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আমেরিকা তো তবু ধনী দেশ। কোনও গরিব দেশে বিমানির্ভর ব্যবস্থা তৈরি করলে তার ফল খুবই খারাপ হতে পারে। সরকারকে সব কিছুই করতে হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। সরকার যদি এরোপ্লেন না চালায়, ঠিক আছে। কিন্তু স্বাস্থ্য আর শিক্ষা, এই দুটো ক্ষেত্রে সরকারের প্রভূত দায়িত্ব রয়েছে। বাজারের হাতে সেই দায়িত্ব ছেড়ে সরকার সরে দাঁড়াতে পারে না। ঘটনা হল, সব অসাম্য দূর করা কঠিন। কিন্তু, ভারতে, বা দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশেই এখন যতটা অসাম্য আছে, সেটা ভয়ঙ্কর— সেটা মেনে নেওয়া যায় না। বাহ্যিক সম্পদের ক্ষেত্রে খানিকটা অসাম্য সহ্য করা যায়। কিন্তু, মৌলিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে নাগরিকদের মধ্যে যে কোনও অসাম্যই অসহনীয়। এই দু’টি ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ না করলে অসাম্য থাকবেই।
এই ক্ষেত্রগুলিতে অসাম্য কিন্তু অনিবার্য নয়। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলি তার উদাহরণ। ১৯৩৮ সালে সুইডেনে যখন সালটজোবাডেন চুক্তি হল, তখন সরকার, শ্রমিক সংগঠন, এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলি এক সঙ্গে বসে স্থির করেছিল যে, কল্যাণরাষ্ট্রের চেহারাটা ঠিক কী রকম হওয়া উচিত। ভারতে কেরল শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে অসাম্য দূর করার পথে খানিকটা হলেও এগিয়েছে। এবং, এই ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার কথা উল্লেখযোগ্য। এখন সে দেশের ভয়াবহ অবস্থা, কিন্তু এক সময় শ্রীলঙ্কাকে উন্নয়ন তত্ত্বের কেস স্টাডি হিসাবে ব্যবহার করা হত। ভারতের মতোই গরিব দেশ, কিন্তু সেখানে প্রত্যাশিত গড় আয়ু অনেক বেশি, জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত— তার কারণ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সে দেশে অসাম্য অনেক কম। সেই অবস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার পতন হল কেন, তার একটা উত্তর হল, সে দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে। খুঁজলে এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেখানে গণতন্ত্র নেই, কিন্তু প্রভূত মানব-উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু, গণতন্ত্রের গুরুত্ব হল যে, সেখানে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ফলে শাসকরা সব সময় চাপে থাকেন। ভারতে বর্তমানে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ চলছে। আশা করব, বেশি দেরি হওয়ার আগেই মানুষ এই বিপদটা টের পাবে। দুনিয়ায় অজস্র উদাহরণ রয়েছে, যাতে দেখা যায় যে, গণতন্ত্রের ক্ষতি হলে অর্থব্যবস্থাতেও ধস নামে। ভারত যেন সে পথে না যায়।
প্র: কৃত্রিম মেধা যে ভাবে কাজের জগৎটাকে পাল্টে দিচ্ছে, তাতে আমাদের পরিচিত কাজগুলোর অনেকটাই আর অদূর ভবিষ্যতে থাকবে না। তা হলে কী ভাবে তৈরি হওয়া উচিত?
উ: যে কাজগুলো যন্ত্র পারে, সেগুলো যে যন্ত্র দিয়েই করিয়ে নেওয়া হবে, এটা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। পরিসংখ্যান বলছে যে, ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে উন্নত দেশগুলিতে জিডিপি-তে শ্রমিকদের মজুরির অনুপাত ক্রমে কমতে আরম্ভ করে। ঘটনা হল, ভারতের মতো দেশে মজুরির হার এতই কম যে, হয়তো আগামী কিছু বছর এখানে কাজের তেমন অভাব হবে না। কিন্তু, একটা সময় আসবেই— এবং, অদূর ভবিষ্যতেই আসবে— যখন ভারতেও যন্ত্রই বেশির ভাগ প্রথাগত এবং যান্ত্রিক কাজ করবে। অতএব, ভবিষ্যতে আমাদের এমন কাজের জন্য তৈরি হতে হবে, যে কাজ কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে সহজে করা যাবে না। তার জন্য ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দক্ষিণ কোরিয়া করছে, ভিয়েতনাম মোটামুটি ভারতের মতো গরিব দেশ হয়েও সেই কাজ করছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ করে উগরে দেওয়ার উপর বড় বেশি জোর দেয়। সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মনে কৌতূহল তৈরি করতে হবে, শেখাটাকে একটা আনন্দময় জার্নি করে তুলতে হবে। শিক্ষার প্রধান চালিকাশক্তি যদি কৌতূহল হয়, একমাত্র তা হলেই ভবিষ্যতে কাজের অভাব হবে না। আমি সদ্য পুরুলিয়ায় চার দিন কাটিয়ে এলাম। ‘নানৃতম’ নামে অসরকারি সংস্থাটির স্কুলে দেখলাম, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ সব ধর্মের, সব জাতির ছেলেমেয়েদের বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। আদিবাসী পরিবারের শিশুরা অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে অঙ্ক কষছে, জ্যামিতি শিখছে, কবিতা পড়ছে দেখে আমি আশাবাদী যে, ভারতের সর্বত্র, সবার জন্য সৃষ্টিশীল শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। সত্যিই তা করা হলে তার প্রভাব বিপুল হবে।
প্র: কিন্তু, এই বেকারত্বের তো একটা রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কার উদাহরণে দেখেছি, দেশের চাকরি এশিয়ায় চলে যাচ্ছে, এই ধুয়ো তুলে প্রবল রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী রাজনীতি শক্তিশালী হল, উগ্র জাতীয়তাবাদী বয়ান তৈরি হল।
উ: একেবারেই। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রচুর ট্রোল প্রয়োজন হয়। দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি হলে সেই ট্রোল পাওয়াও সহজ— অল্প টাকার বিনিময়ে, এমনকি টাকা ছাড়াই তারা কাজ করে। আর একটা জিনিস খেয়াল করার মতো— যাদের জন্য এই মানুষগুলোর দুর্ভোগ, রাগ কিন্তু তাদের উপর গিয়ে পড়ে না। আর্থিক অসাম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের খারাপ থাকার উল্টো দিকে তো রয়েছে কতিপয় ধনীর আরও ধনী হয়ে ওঠা। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি কিন্তু সেই ধনীদেরই হাত শক্ত করে। ভারতেও হয়তো অনেকে ভাবেন, যে দু’জন অতি ধনী ব্যবসায়ী এখন কার্যত গোটা দেশের দখল নিয়েছেন, তাঁদের হাত শক্ত করতে পারলেই দেশে চাকরি তৈরি হবে, অনেকের কর্মসংস্থান হবে। এটা একটা ধাঁধা যে, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এবং অর্থনীতি যাঁদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি দক্ষিণপন্থার সমর্থক।
প্র: ভারতের যে ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’, অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাধিক্যের সুবিধা ছিল, সেটা মোটের উপর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। বাজারে চাহিদা নেই, ফলে চাকরিও নেই। এই অবস্থায় কর্মসংস্থানের কী হবে?
উ: মূল্যস্ফীতির প্রশ্নটা বাদ দিলে এটাই এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখন ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ— অর্থাৎ, কাজ খুঁজছেন, এমন প্রতি চার জন তরুণের মধ্যে এক জন বেকার। মধ্য এশিয়ার কিছু বিধ্বস্ত দেশ ছাড়া আর কোথাও এত চড়া বেকারত্বের হার নেই। যে দেশগুলির সঙ্গে ভারতের তুলনা হয়, ভারত নিজেকে যে দেশগুলোর পঙ্ক্তিভুক্ত মনে করে, তার সর্বত্রই তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশের নীচে। মুশকিল হল, কোভিড আসার আগেই ভারতের অর্থব্যবস্থার মস্ত ক্ষতি করেছে পর পর দুটো ধাক্কা— ডিমনিটাইজ়েশন আর জিএসটি। প্রথমটা একেবারেই অর্থহীন একটা সিদ্ধান্ত; জিএসটি এমনিতে দরকারি ব্যবস্থা, কিন্তু সেটা চালু করতে গিয়ে সরকার এমন তাড়াহুড়ো করল যে, অর্থব্যবস্থার ক্ষতি হল। বিশেষত, ভারতে যেখানে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়, সেই অসংগঠিত ক্ষেত্র একেবারে শুয়ে পড়ল। ২০১৬ সাল থেকে পর পর পাঁচ বছর— মানে, কোভিড আরম্ভ হওয়ার আগে অবধি— ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। তার উপর অতিমারি। এই অবস্থায় কর্মসংস্থান কী ভাবে করা সম্ভব হবে, সেটা অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন। অসম্ভব, তা বলছি না— বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু, যদি কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর স্বার্থের বদলে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং এই সমস্যাটিকে একটা বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নিয়ে দেখা হয়, গোটা দুনিয়া থেকে সেরা ভাবনাচিন্তা আহরণ করা হয়— আমার মনে হয়, তা হলে আমরা শুধু এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলাই করতে পারব না, উন্নততর জায়গায় পৌঁছে যেতে পারব। কিন্তু, এই কাজগুলোয় কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোর অনীহা। ফলে, কী হবে, তার উপর বাজি ধরতে আমি রাজি নই!
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy