অতঃপর রামচন্দ্র আছাড়িপিছাড়ি কাঁদলেন। পৃথিবী দেবী তত ক্ষণে তাঁর দুখিনী কন্যাকে কোলের সিংহাসনে বসিয়ে অন্তর্হিত। রামচন্দ্র সীতার চুল টেনে পতালপ্রবেশ রোধের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাবণবিজয়ী বীর ব্যর্থ। কৃত্তিবাসের বর্ণনায়, “পাতালে যেতে রাম ধরেন তাঁর চুলে/ হস্তে চুলমুঠা রৈল সীতা গেল তলে।” জানকী এ বার বৈকুণ্ঠে নিজ রূপে, লক্ষ্মী হয়ে বসবেন, সবাই জানে। বাল্মীকির রাম অবশ্য বৌ উধাও হওয়ার পর একটু ক্ষাত্রতেজ দেখিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীকে হুমকি দিলেন, “তুমি সীতাকে শীঘ্র ফিরিয়ে দাও। নইলে পর্বত আর অরণ্যসহ তোমাকে বিনষ্ট করব। দরকারে পৃথিবী জলময় হয়ে যাক!” বৌ পালালে সকলেরই পুরুষকার বাড়ে, রামচন্দ্রেরও!
সম্প্রতি দিবাকর ভট্টের কাশ্মীরি রামায়ণ পড়তে গিয়ে তাই ধাক্কা খেলাম। কাশ্মীরি রামায়ণ সীতার পাতালপ্রবেশের পরও কিছু বলেছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই ত্রিমূর্তি স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ঢুঁড়ে ফেললেন, কিন্তু লাভ হল না। ব্যর্থমনোরথ তাঁরা এ বার বাল্মীকির শরণাপন্ন হলেন। ঋষি জানালেন, কুলগাম থেকে এক ক্রোশ দূরে শঙ্করপুরে জানকী পাকাপাকি ভূগর্ভে চলে গিয়েছেন। সেখানে তিনি দেখেছেন প্রবল বেগে এক ঝর্না বেরিয়ে আসছে। দেবতারাও গিয়ে সেই জলধারা প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ গ্রিয়ারসন যখন এই কাশ্মীরি রামায়ণ-এর ছেঁড়াখোঁড়া পুঁথি খুঁজে পাচ্ছেন, ঝর্নাটার অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নন। বলছেন, জায়গাটা সম্ভবত অনন্তনাগের কাছে। তিনি শুনেছেন, আগে সেখানে সাধুসন্তরা থাকতেন, এখন শুধু মুসলমানেরা।
একুশ শতকে ওই ঝর্না আর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। শ্রীনগর উপত্যকা, কুলগাম মানেই যেন সন্দেহজনক এলাকা, মাঝে মাঝেই জঙ্গি আর নিরাপত্তারক্ষীদের গুলির লড়াই। ওই অঞ্চলে ভেরিনাগ, কৌসরনাগ ইত্যাদি বড় বড় ঝর্না আছে। সে যাক! অযোধ্যায় সরকারি আনুকূল্যে রামমন্দির হবে, বিতর্কিত ভাবে জমির দাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেড়ে যাবে ইত্যাদি রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক পরম্পরা থাকবেই। কিন্তু আঞ্চলিক রামকথাগুলিও এ ভাবে হারিয়ে যাবে! লাঙলের ফালে ওঠা ভূমিকন্যা যদি গর্জনে ফুঁসে-ওঠা পাহাড়ি ঝর্নার অন্দরে হারিয়ে যান, রামচন্দ্র আর পৃথিবীকে জলমগ্ন করবেন কী ভাবে?
কাশ্মীরি রামায়ণ এ ভাবে বাল্মীকিকে মেনেও মাঝে-মাঝে অন্য চমক নিয়ে আসে। আমাদের চেনা রামায়ণে তপোবনে সীতার যমজ পুত্র হয়। বড় কুশ, ছোট লব। আদিকবি ডিটেল দিয়েছেন, শত্রুঘ্ন রামের আদেশে লবণাসুরকে বধ করতে যাওয়ার পথে আশ্রমে আশ্রয় নেন, সে রাতেই ওই যমজরা জন্মায়। দিবাকর ভট্টের গল্পটি একটু অন্য রকম। প্রথমে লবের জন্ম, সে আর পাঁচটা শিশুর মতো হাত পা ছোড়ে, ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে। সীতা তাকে ঋষির তত্ত্বাবধানে রেখে নানা কাজে যান। এক দিন ভাবলেন, বাচ্চাটা রোজ কাঁদে, বাল্মীকির ধ্যানে নিশ্চয় নানা ব্যাঘাত ঘটে! লবকে কোলে নিয়ে জল আনতে তিনি জঙ্গলের ঝর্নায় গেলেন।
কিন্তু আদিকবির ধ্যানটা সে দিন ঠিকঠাক জমল না। পাশে শিশুর কান্না ও কলতান নেই যে! তাকিয়ে দেখলেন, লব নেই। তা হলে কি তাঁর ধ্যানের সুযোগে কোনও বন্য জন্তু এসে শিশুটিকে তুলে নিয়ে গেল, তিনি টের পেলেন না! ঋষি কুশঘাস দিয়ে লবের অনুরূপ এক শিশু তৈরি করে তার মধ্যে প্রাণ দিলেন। সীতা লবকে নিয়ে ফিরে এসে দেখলেন, আর একটি লব হাত পা ছুড়ে কাঁদছে। তিনি আর বাল্মীকিকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে কুশঘাস নির্মিত সেই জীবন্ত শিশুকে কোলে তুলে নিলেন। বাল্মীকিও আড়চোখে দেখলেন, কিছু না বলে ফের ধ্যানে ডুবে গেলেন। সময় এবং ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও এই বাৎসল্য রস তুলসীদাসকে মনে পড়ায়। কৌশল্যা শিশু রামকে ঝুলায় রেখে গিয়েছেন, এসে দেখলেন সেখানে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিশাল এক পুরুষ। সভয়ে মিনতি জানালেন তিনি, “প্রভু, তুমি আবার আমার কোলের শিশু হয়ে যাও।” খানিক বাদে দেখলেন, শিশু রামলালা আগের মতোই খিলখিলিয়ে হাসছেন।
লবকুশের গল্পের পরের অংশটা আমাদের চেনা কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতো। দুই আশ্রমবালক রাম-লক্ষ্মণদের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকাবেন, মজা পেয়ে হনুমান ও জাম্ববানকে বেঁধে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে, “দুর্জয় দুইটি জন্তু এনেছি বান্ধিয়া/ দ্বারে না আইসে মাগো, দেখহ আসিয়া।” বাল্মীকিতে এই গল্প নেই। কাশ্মীর এবং বাংলা সে ক্ষেত্রে এক ভাবে ভেবেছিল। বাল্মীকি ছাড়াও জৈমিনি এবং আরও অনেক রামায়ণকে অনুসরণ করে তারা পুত্রের হাতে পিতার পরাজয় দেখিয়েছিল।
সূক্ষ্ম তফাত অবশ্য আছে। কৃত্তিবাসের বাল্মীকি ধ্যানে জানলেন, তপোবনকুণ্ডে আছে মৃতজীবী জল। সেই জল গায়ে ছেটাতেই লবকুশের বাণে মৃত রাম-লক্ষ্মণ থেকে বানরসৈন্যরা সকলে জীবন ফিরে পেলেন। কাশ্মীরি রামায়ণে তপোবনকুণ্ডের কথা নেই। সেখানে বাল্মীকি শিবের কাছে প্রার্থনায় বসেন, আকাশ থেকে অমৃতবর্ষণ হয়, মৃতরা জীবন ফিরে পায়। পড়তে পড়তে মনে হয়, তাই তো! কাশ্মীর যে সোমানন্দ থেকে অভিনবগুপ্ত অবধি সব শৈব দর্শনের চারণভূমি। ফলে বাল্মীকি সদাশিবের কাছেই প্রার্থনায় বসবেন। কৃত্তিবাসে যেমন বাল্মীকিকে এড়িয়ে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধ থেকে মহীরাবণের দেবীপুজো অনেক নতুন গল্প ঢুকেছে!
এই কাশ্মীরি রামায়ণ পড়তে পড়তে নবনীতা দেবসেনের কথা খুব মনে পড়ে। তাঁর তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসেই আমার রামায়ণ থেকে ইলিয়াড শিক্ষা। নবনীতা ময়মনসিংহের হারিয়ে-যাওয়া চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ পড়িয়েছিলেন। সেখানে সীতা মন্দোদরীর কন্যা। দেবতাদের অমরত্ব বিনষ্ট করতে চেয়ে রাবণ একটি পাত্রে তপস্বীদের বুকের রক্ত সংগ্রহ করেছিল। স্বর্গ থেকে অপহরণ করে আনা দেবকন্যাদের সঙ্গে সে তখন প্রেমলীলায় মত্ত। উপেক্ষিতা মন্দোদরী তখন আত্মহত্যা করতে চেয়ে সেই রক্ত পান করেন। তপস্বীদের রক্ত বিষবৎ।
কিন্তু মন্দোদরী মরলেন না, একটি ডিমের জন্ম দিলেন। গনতকারেরা বললেন, এই ডিম থেকে যে কন্যা জন্মাবে, সে স্বর্ণলঙ্কা ধ্বংসের কারণ হবে। অগত্যা মন্দোদরী সোনার কৌটোয় ভরে ডিমটি ভাসিয়ে দেন। সেই কৌটো জনকের মিথিলা রাজ্যে এসে ঠেকে।
কাশ্মীরি রামায়ণেও চন্দ্রাবতী আখ্যানের মতো সীতা মন্দোদরীর মেয়ে। তবে ঋষিদের বুকের রক্তের গল্পটা নেই। সেখানে মন্দোদরী স্বর্গের পরি বা অপ্সরা। রাবণের ধ্বংসকল্পে পরি নারীর রূপ ধরে, মেয়ের জন্ম হয়। অতঃপর ভবিষ্যদ্বাণী, বাবার স্বর্ণলঙ্কা এই মেয়ে থেকেই ধ্বংস হবে। মন্দোদরী মেয়ের গলায় পাথর বেঁধে ভাসিয়ে দেন, কন্যা জনকরাজার মিথিলায় এসে পৌঁছয়। বস্তুত, সংস্কৃত ‘অদ্ভুত রামায়ণ’-এও সীতা মন্দোদরীর কন্যা।
তবে চন্দ্রাবতীর কাব্যে মন্দোদরীর সঙ্গে সীতার আর দেখা হয়নি। দিবাকর ভট্ট অবশ্য জানাচ্ছেন, রাবণ সীতাকে লঙ্কায় নিয়ে গেলে মন্দোদরী কন্যাকে চিনতে পারেন। কিন্তু লজ্জায় কাউকে জানাননি।
চন্দ্রাবতীর সঙ্গে কাশ্মীরি রামায়ণের আরও অনেক চমকপ্রদ মিল। দুই জায়গাতেই সীতার ঈর্ষাকাতর ননদ, কৈকেয়ীকন্যা কুকুয়ার উপস্থিতি। গর্ভিণী সীতাকে এক দুপুরে সে গল্পে গল্পে রাবণের ছবি এঁকে দেখাতে বলে। সীতা আঁকেন, ননদিনি রায়বাঘিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটি নিয়ে রামের কাছে পৌঁছে যান। অতঃপর কানপাতলা, ঈর্ষাতুর স্বামীদের যা হয়! তার পরই সীতা বিসর্জনের নির্দেশ। কাশ্মীরি রামায়ণে ননদিনির নাম নেই, কিন্তু গল্পটা এক।
তবে কাশ্মীরি রামায়ণের আরও চমকপ্রদ বিষয়, বাল্মীকির আশ্রম থেকে সীতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রামের ব্যর্থ সাধাসাধি। বাল্মীকির অমৃতবর্ষণে জীবন ফিরে পেয়ে রাম সীতাকে পুত্র-সহ অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। জানকী নারাজ। তাঁর দরজা বন্ধ। রাম সারা রাত বাইরে দাঁড়িয়ে কাকুতিমিনতি করেন। আর বন্ধ দরজার ও-পারে সীতা দেবী পার্বতীকে দুঃখের কথা বলেন। জানান, জন্মের পর মা তাঁকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামী অগ্নিপরীক্ষা নিয়েও ননদের কথা মেনে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। গর্ভিণী অবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণ না করে জঙ্গলে ছেড়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। বাল্মীকি এ বার এসে বৃদ্ধ বাবার মতো বোঝান। কিন্তু সীতার এক গোঁ, রাম নররূপী নারায়ণ হতে পারেন, তাঁর কাছে সুখদুঃখ প্রেম-অপ্রেম সব এক হতে পারে। কিন্তু তিনি তা নন। “রাম যখন আমাকে পরিত্যাগ করেছেন, ডাকলেই যাব কেন?” অতঃপর বাল্মীকির অনুরোধ-উপরোধে প্রায় নিমরাজি হয়ে যজ্ঞক্ষেত্রে গেলেন।
চন্দ্রাবতী রামায়ণ নিয়ে নবনীতা প্রায়ই একটি কথা বলতেন। টেক্সটের কণ্ঠরোধ! চন্দ্রাবতীর রামায়ণ ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উল্টো দিক দেখায় বলে, পুরুষতন্ত্রের বদলে সীতাকে গুরুত্ব দেয় বলেই কি এই খণ্ডকাব্য হারিয়ে গেল? শিক্ষকের দেখানো পথে আজ মনে হয়, অষ্টাদশ শতকে দিবাকর ভট্টের রামায়ণও কি সেই কারণেই পরিচিতি পেল না? কাব্যের শেষে বশিষ্ঠ, বাল্মীকি, অগস্ত্য প্রমুখ ঋষিরা জানান, সীতা পবিত্র, কিন্তু ওটিই তাঁর ললাটলিপি। রামচন্দ্র স্বয়ং এই অন্তর্ধানের জন্য দায়ী।
মহাকাব্য শুধু রাম-লক্ষ্মণকে নয়, সীতাকেও বারংবার ফিরে দেখেছে। দিবাকর ভট্টের কাশ্মীরি রামায়ণের সেখানেই উজ্জ্বল উদ্ধার। নরচন্দ্রমার দাপটে আজও প্রতিবাদী সীতা ‘জনমদুখিনী’ হননি, পিরপঞ্জাল পর্বতের রামকথায় নারীর কণ্ঠরোধ হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy