আজকের যন্ত্রমুখর পৃথিবীর ধমনীতে যে তরল দৌড়চ্ছে তার নাম পেট্রল। তাকে যে শাসন করতে পারবে, তার উৎসে না হোক চলাচলের রাস্তায় নিজের ছায়া ফেলে দাঁড়াতে পারবে, সে কার্যত শাসন করবে বিস্তীর্ণ ভূগোল। নদীর প্রবাহ এক কালে কোল দিয়েছে সভ্যতাকে, আজকের নদীর রূপ নিয়েছে পেট্রলের প্রবাহ। তার সঙ্গে গত শতাব্দী থেকে জাহাজে তোলা কন্টেনারে পণ্য সরবরাহের বাড়বাড়ন্তও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে ‘লজিস্টিক্স নগরী’গুলোকে, দুবাই যার অন্যতম উদাহরণ। সমুদ্রপথে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুগুলোর গভীরে থাবা গেড়ে বসার প্রতিযোগিতাও তীব্র হয়েছে সেই সূত্রে।
এ ভাবনাটা অমিতাভ ঘোষ তাঁর বই দ্য নাটমেগ’স কার্স-এ বিশদে তুলে এনেছেন। এশিয়া থেকে আনা মশলার বাণিজ্য ঘিরে প্রতিযোগিতার সূত্রে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ভারত মহাসাগর শাসন, আর আজকের পেট্রল-গর্বিত শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা নির্মম ভাবে স্পষ্ট তাঁর লেখায়। ভারত মহাসাগরে বণিক ও রাষ্ট্রশক্তির পেশি আস্ফালনের বৃত্তান্ত যে অনেক প্রাচীন তা রয়েছে অশীন দাশগুপ্তর লেখাতেও।
এই ইতিহাসের একটা নতুন পৃষ্ঠায় নিজের নাম বসাতে চাইছে ভারত সরকার। কিন্তু তার জন্য যে বেপরোয়া ভঙ্গিতে সমস্ত স্বীকৃত নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে আব্রু রাখার ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে, সে দিকে খুব বেশি মানুষের নজর পড়েনি এখনও। গত ২২ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে (“আন্দামানে ‘উন্নয়ন’, জবাব তলব কোর্টের”) কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেটাই মনে হল।
সমুদ্রে আধিপত্যের নিরিখে মলাক্কা প্রণালী কয়েক শতাব্দী ধরেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তার উত্তর মাথা থেকে দু’শো কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে রয়েছে ভারতের দক্ষিণতম ভূমি, গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। এই দ্বীপটির মোট আয়তনের ১৮ শতাংশ গিলে ফেলে তৈরি হতে চলেছে এক বিশাল বন্দর এবং সংলগ্ন নগরী, যার প্রাথমিক ব্যয়বরাদ্দ ৭২,০০০ কোটি টাকা। জানা যাচ্ছে, এখনই সেই বরাদ্দ বেড়ে ৮১,০০০ কোটির ঘর ছুঁয়েছে। প্রকল্পে গড়া হবে কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্টের ঘাঁটি, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৪৫০ মেগাভোল্ট-অ্যাম্পিয়ার ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং এক বৃহৎ নগরী, যেখানে গিয়ে উঠবেন সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ। দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা আট হাজারের কিছু বেশি। কেবল পানীয় জলের চাহিদার কথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।
প্রকল্পটা গোড়া থেকেই অবাস্তবতায় মোড়া। প্রথমত, যে এলাকাটি বেছে নেওয়া হয়েছে তা ভূতাত্ত্বিক ভাবে অস্থির। ২০০৪-এর সুনামিতে গোটা আন্দামান-নিকোবরের ভিত্তি টলে গেছে, কোনও কোনও অংশ উঁচিয়ে উঠেছে, ও দিকে গ্রেট নিকোবরের দক্ষিণ মাথা বসে গেছে ১৫-১৬ ফুট। মোটামুটি দক্ষিণতম বিন্দুতে ইন্দিরা পয়েন্টের যে লাইটহাউসটি সর্বদা জোয়ারের সীমার উপরে থাকত, তার নীচের অংশ কয়েক ফুট অবধি সর্বক্ষণ জলের নীচে চলে গেছে। ভবিষ্যতের কোনও সুনামি বা ভূমিকম্পের ফলাফল কী হবে, আঁচ করা সহজ।
গ্রেট নিকোবরে রয়েছে ঘন ক্রান্তীয় অরণ্য। উপযুক্ত আয়তনের দ্বীপভূমিতে বিবর্তন জন্ম দেয় অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির, এদের বলে ‘এনডেমিক’ প্রজাতি। গ্রেট নিকোবরও ব্যতিক্রম নয়, এই অরণ্য ইউনেস্কোর বায়োডাইভার্সিটি হেরিটেজ স্বীকৃতি পেয়েছে। তার এনডেমিক প্রজাতির মধ্যে আছে অন্তত ১১ রকম স্তন্যপায়ী, ৩২ রকম পাখি, সাত সরীসৃপ এবং চার উভচর। পৃথিবীর আর কোথাও এদের পাওয়া যায় না। গ্রেট নিকোবরে মোট ৭১টি পাখি প্রজাতির মধ্যে ৩২টিই এনডেমিক, অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ! অন্য প্রাণীর বেলায় শতাংশের হিসাবে এনডেমিক প্রজাতির হিসাব এর বেশি হওয়া উচিত, কারণ পাখিরা স্থানান্তর করতে পারে সহজে (বাস্তবিক ১৪টি স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে ১১টি এনডেমিক)।
সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক, দুর্গম বলেই গ্রেট নিকোবরে কী জীবসম্পদ আছে তার হদিস ঠিকঠাক বার করা যায়নি এখন অবধি। যে কোনও প্রকল্পকেই ছাড়পত্র দেওয়ার আগে পরিবেশগত অভিঘাতের হিসাব পেশ করতে হয়। লজ্জার কথা, এই প্রকল্পের বেলায় দু’-দুটো প্রথিতযশা গবেষণা সংস্থা সে কাজ করেছে এবং সমস্ত যুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এখানে কাজ শুরু করায় সায় দিয়েছে। অথচ তারা নিজেদের রিপোর্টেই লিখেছে, জঙ্গল এত ঘন যে তারা তেমন সমীক্ষার কাজ করতেই পারেনি।
প্রকল্প গিলে নেবে গ্যালাথিয়া উপসাগরের একাংশ ও তার সন্নিহিত তটভূমি, যেখানে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার উপকূল থেকে ডিম পাড়তে আসে জায়ান্ট লেদারব্যাক টার্টল, এক ধরনের সামুদ্রিক কচ্ছপ। প্রকল্পে এদের জন্য একটা সরু অংশ ছেড়ে রাখার কথা বলা হয়েছে, যেন তারা রাস্তার সাইনবোর্ড দেখে ঠিক সেই জায়গা দিয়েই আসা-যাওয়া করবে, চতুর্দিকের জাহাজ, জেটি, তেল, কোলাহল, মানুষের ভিড়ে এতটুকু বিচলিত না হয়ে! বন্দরের পরিবেশগত অভিঘাত সমীক্ষার ভারপ্রাপ্ত ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া-র কাছে তথ্যের অধিকারসূত্রে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জায়ান্ট লেদারব্যাক টার্টল নিয়ে সুপারিশের সপক্ষে তাদের গবেষণার কোনও নমুনা আছে কি না। সংস্থাটি জানায়, লেদারব্যাক টার্টল নিয়ে তাদের তিলমাত্র পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। অথচ তারাই ছাড় দিয়েছে এই প্রকল্পে!
ঘটনা হল, ১৯৯৭ থেকে ওই অঞ্চলের ১১.৪৪ বর্গকিমি এলাকা জায়ান্ট লেদারব্যাক সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই ‘গ্যালাথিয়া বে ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতেও পরিবেশ, অরণ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রক তাদের ন্যাশনাল মেরিন টার্টল অ্যাকশন প্ল্যানে গ্যালাথিয়া উপসাগরকে দেখাচ্ছে ‘ভারতে সামুদ্রিক কচ্ছপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান’ হিসাবে। হাস্যকর ঘটনা হল, দফতর খোঁজও রাখেনি, এই অ্যাকশন প্ল্যান প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ আগে এই স্যাংচুয়ারির ‘সংরক্ষিত’ মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কারণ সেখানে বন্দর বানানো হবে!
সরকারি হিসাবই বলছে, এই বন্দরনগরী বানানোর জন্য অন্তত দশ লক্ষ প্রাচীন গাছ কাটা পড়বে। তাদের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল প্রাণী, বিশেষ করে এনডেমিক পেঁচা প্রজাতিগুলোর কী হবে! আরও হাস্যকর, প্রকল্পে নির্ধারিত হয়েছে, কাটা-পড়া রেনফরেস্টের গাছগুলোর বিনিময়ে দশ লক্ষ গাছ বোনা হবে হরিয়ানায়। ভাবা যায়! নিকোবরেই রয়েছে এক বিস্ময়কর পাখি, নিকোবর মেগাপড। মুরগির মতো বড়সড় এই পাখি ডিম পাড়ে মাটিতে ঝরা পাতা কুড়িয়ে এনে তৈরি করা বিরাট স্তূপের নীচে। পচতে থাকা পাতার উত্তাপ ডিমে তা দেওয়ার কাজ করে। জৈবভূগোলের নিরিখে বিখ্যাত ‘ওয়ালেস লাইন’-এর পুবে বেশ ক’টি প্রজাতির মেগাপড থাকলেও, পশ্চিমে এই একটিই প্রজাতি পাওয়া যায়। এরা এমনিতেই সঙ্কটাপন্ন, আগামী পরিস্থিতি অকল্পনীয়।
আরও বড় দুর্দশা ঘনাতে চলেছে এখানকার দু’টি জনজাতি, শমপেন ও নিকোবারিজ় মানুষদের জীবনে। সরকারি বিচারে এঁরা বিশেষ রকমে সঙ্কটাপন্ন (‘পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ’)। ২০০৪-এর সুনামির ফলে এঁদের একটি অংশকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দ্বীপের প্রশাসনিক মূলকেন্দ্র ক্যাম্পবেল বে-র কয়েকটি জনপদে। বারংবার আবেদন সত্ত্বেও জন্মভূমিতে ফিরতে দেওয়া হয়নি এঁদের। প্রকৃতির বুকে স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত ওঁরা এখন থাকছেন খুপরি ঘরে, মুটে-মজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন দুই দশক ধরে। আর এখন, তাঁদের ছেড়ে আসা ভূমিই গিলে ফেলতে চলেছে বন্দর প্রকল্প। ‘ডিজ়াস্টার ক্যাপিটালিজ়ম’-এর উদাহরণ হিসাবে একে দেখছেন অমিতাভ ঘোষ, বিপর্যয় ভাঙিয়ে সুবিধা লোটার ন্যক্কারজনক চেষ্টা। সরকারি ভাষ্যে অবশ্য এর নাম হয়েছে ‘হোলিস্টিক ডেভলপমেন্ট অব গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ড’।
কলকাতায় এসেছিলেন মুম্বই আইআইটি-র অধ্যাপক, পরিবেশকর্মী পঙ্কজ শেখসারিয়া, এক সভায় নিকোবরের বিপর্যয় সম্পর্কে তাঁর কথা শুনে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত। দ্য গ্রেট নিকোবর বিট্রেয়াল: পুশিং আ ভালনারেবল আইল্যান্ড নোয়িংলি ইনটু ডিজ়াস্টার নামে একটি বইতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের নিবন্ধ সঙ্কলন করে তিনি এই ঘৃণ্য ও বেপরোয়া কাজের কথা সকলকে জানাতে চেয়েছেন।
প্রকল্পের অসম্ভাব্যতা বিচার করে অভিযোগ জানানো হয়েছিল ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে। আশ্চর্য, কলকাতায় তাদের ইস্টার্ন জোনাল বেঞ্চ সেই অভিযোগ নস্যাৎ করে এবং প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেয় ২০২৩-এর ১২ মে। সে বছর মার্চেই আদানি, বসকালিস, জে এস ডব্লিউ ইনফ্রাস্ট্রাকচার-সহ দশটি সংস্থা নির্মাণকাজে আগ্রহ প্রকাশ করে। মূল প্রকল্পের কাজ এগোনোর সুবিধার্থে ক্যাম্পবেল বে-তে কিছু নির্মাণ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
কলকাতা হাই কোর্টে অন্তত দু’টি আবেদন পেশ হয়েছিল: একটি ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্ট লঙ্ঘনের সূত্রে, অপরটি বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষতির ঝুঁকি সত্ত্বেও গ্যালাথিয়া ন্যাশনাল পার্ককে কী যুক্তিতে সংরক্ষণের আওতা থেকে বার করে দেওয়া হল তা নিয়ে। মে নাগাদ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। আদালতে কী নিষ্পত্তি হবে তা ভবিষ্যৎই বলবে, কিন্তু এই প্রকল্পের পরিণামে পরিবেশ ও জনজাতি জীবনের বিপর্যয় আটকানো না গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)