আমি আওয়াম। আমাকে চেনা যায় আমার সহনে— আরও সহজ করে বললে, অপমান গায়ে না মাখার অভ্যাসে। গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়ে আছি। দল এসে বলল, চল মিছিলে। চললাম। বলল, চাঁদা দিতে হবে— তা দিলাম, দেনা করেই দিলাম। কেননা, আমি আওয়াম। বাসা বদল করছি, ট্রাক থেকে জিনিস নামতে দেবে না, যত ক্ষণ না টাকা দিই। পাতা তুলতে বনে গেছি, ফরেস্টের লোক আমাকে চুরনি বলে গাল দিল। রাস্তায় আনাজের গাড়ি নিয়ে ঘুরছি, পুলিশ এসে বলে, আইন ভেঙেছ, দাও জরিমানা। দিলাম, কেননা, আমি আওয়াম। খাটতে এসেছি মুর্শিদাবাদের গাঁ থেকে, মজুরি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দল হাজির: দে টাকা। দিতে হল, শহরে এসে মজুরি রোজগার করলে নাকি ওদের টাকা দিতে হবে, ওটাই দস্তুর। গাড়ি রেখে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার ধারে। দল এল— এখানে গাড়ি রাখা চলবে না, এখনই সরিয়ে নাও, রাখতে চাইলে টাকা দাও। দল নিশ্চিত জানে, রাস্তা আমার পিতার নয়; আমি নিশ্চিত জানি যে, ওটা দলের পিতারও নয়— কিন্তু বলতে পারি না। আমি আওয়াম। দল বলে দিয়েছে যে, দলের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া চলবে না।
তাই আমিও মাঝে মাঝে দলে ভিড়ে যাই। এই যেমন, আমি আওয়াম কলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে ধাক্কা খেতে খেতে মোট মাথায় নিয়ে ট্রেনে উঠলাম, রোজ যেমন উঠি। দেখি, সেখানে একটা লোক এসে বসে আছে। যে জায়গায় আমি আমার দলের সঙ্গে বছরের পর বছর বসে আসছি— ট্রেনের দেওয়ালে ওই জায়গায় লিখে রেখেছি, ডেলি প্যাসেঞ্জার— সেখানে উটকো একটা লোক বসে কী করে? সে বেচারা বাধ্য হয় অন্য জায়গা খুঁজতে— হয়তো পায়, হয়তো পায় না। এ ভাবেই অপমানের বোঝা পিঠে নিয়ে সে বাড়ি ফেরে। আমিও তাই।
অপমান চঞ্চলা— তাকে থিতু রাখা যায় না, চালান করে দিতে হয়। সবাই পারে না, সবার চালান করার জায়গা নেই। এই যেমন আমি সারা দিন মনুষ্যত্ব খুইয়ে, মূর্তিমান অপমান হয়ে বাড়ি ফিরি, দেখি ছেলে পড়তে না বসে খেলতে গেছে, রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে, ছেলে মার খায়, তার মা-ও খায়। এক জন হাত পা ছড়িয়ে কাঁদে, মাটিতে লাথি মারে; কিন্তু অন্য জনের সে উপায় নেই। ডুকরে কাঁদার সুযোগটুকুও তার নেই। মনের ক্ষোভ মনেই উগরে দেয়— কেন দিয়েছিলে বিধি মানব জনম।
সব আওয়ামেরই কখনও না কখনও এ কথাটা মনে হয়— কারও কম, কারও বেশি। দলে থাকার সুবিধে যার যত কম, মানুষ হিসেবে জন্মানোর গ্লানিও তার তত বেশি। শুধু তো দলে থাকলে হবে না, দলে থেকেও তো তাকে অহরহ মান খোয়াতে হয়। এই যে আমি, দলের কর্মী— একে ঠেঙাই, ওকে ধমকাই, তাকে চমকাই; আবার দলের বড় মাতব্বরের কাছে থাপ্পড় খেয়ে চুপ থাকি, কথা বললে মিটার চড়বে। আবার সে মাতব্বরও থাপ্পড় খায়, আওয়ামের সামনে বড় মাতব্বর ছোট মাতব্বরের কান মলে দেয়, সে থমথমে মুখ করে মঞ্চ থেকে নেমে আসে, আর সামনে আমাকে পেয়ে জোরসে এক লাথি কষায়। আমিও সেটা চালান করে দিই। এ ভাবে লাথি নামতে থাকে উপর থেকে নীচে, আরও নীচে। লাথি আমার রুজি— লাথি মেরে টাকা কামাই, লাথি খেয়ে টাকা কামাই। কখনও আবার রেগে গিয়ে মনের রাগ ঝেড়ে ফেলি, সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে মাফ চাই, পায়ে পড়ে ক্ষমাভিক্ষা করি। এবং সেই ক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়ি আওয়ামের উপর। হম্বি করি, তম্বি করি, তাকে যতটা পারি লজ্জা দিই, একেবারে আওয়ামের মাঝে বিবস্ত্র করে ছাড়ি। পীড়নের প্রাচীন অ-মানুষী দক্ষতায় মনুষ্যত্ব খুইয়ে আমিও নীচে নামি। নামতেই থাকি।
নীচে নামানোতেই দলপতিদের আনন্দ— আওয়ামকে যত নীচে নামাবে, তার মন থেকে যত বেশি বেশি করে ছাল-চামড়া চেঁছে নিতে পারবে, ততই তার সুখ। আওয়াম আমোদ করুক, হুল্লোড় করুক, যত খুশি করুক, কিন্তু কথা যেন না বলে। আওয়াম যদি বলে ফেলে, কেন মারো, কেন করো অপমান, আমি কি মানুষ নই? প্রশ্নটা শুনতে সোজা, কিন্তু আদতে বেয়াড়া। মানুষকে মানুষ মানলে দল চলে না। আমি যদি আমার মর্যাদার কথা ভাবি, তা হলে, আমাকে তো আর এক জনের মর্যাদার কথা ভাবতে হবে। সে তো মহা মুশকিল। তখন আর দল থাকবে না, মানুষে মানুষে মিলে যাবে, মানুষ মানুষে মিশে যাবে। তখন যে বাবু একশো দিনের কাজ চাইতে আসা মজুরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে, যে কর্মচারী বুড়ো-থুড়ো মানুষগুলোকে ভ্যাকসিনের জন্য সারা দিন ঘোল খাইয়ে ছাড়ে, অথবা যে লোকটা হাসপাতালে বেড বিক্রি করে— এরাও ভাবতে শিখে যাবে, কেন, এবং কী ভাবে, মানুষকে মানুষ ভাবতে হয়। যে মানুষ জন্ম-জন্মান্তর ধরে আর এক মানুষকে অপমান করতে শিখে এসেছে, জেনে এসেছে, পরপীড়নেই তার অস্তিত্ব, অন্যকে হেনস্থা করেই তার বেঁচে থাকা, প্রশ্ন শুনলে সে মানুষ তো ঘাবড়ে যাবেই। যাদের প্রশ্ন শোনার অভ্যাস নেই, তাদের ভাবার অভ্যাসও নেই। কিন্তু, সহসা প্রশ্নের মুখে পড়লে? শেষমেশ তাকেও ভাবতে হবে, সে-ও এক আওয়াম।
আওয়ামের স্বপ্নে দলপতি হাসে। সব মানুষ নিজেকে মানুষ ভাববে? তাই কি হয়? টাকা তাদের আলাদা রাখে, খুচরো খুচরো ক্ষমতা তাদের আলাদা রাখে, যুগ যুগ ধরে চাষ করে আসা ঈর্ষা, ঘৃণা, বিদ্বেষ তাদের আলাদা রাখে। মানুষকে মানুষ না ভাবার, মানুষকে ঘৃণা করার, তার কাছ থেকে তার মান কেড়ে নেওয়ার কৌশল শেখানো হয় ইস্কুলে, কলেজে, দৈনন্দিন সংস্কৃতিতে। তাকে শেখানো হয়, যে লোকটা যত খাটে, ফসল ফলায়, মাটি কাটে, রাস্তায় জিনিস ফেরি করে, পরের বাড়ি বাসন মাজে, সেই লোকটা ততটাই কম মানুষ। যে লোকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, যার শিশু অপুষ্টিতে প্রাণ হারায় প্রথম জন্মদিনের আগে, যার পুত্র-কন্যা লেখাপড়ার সুযোগ পায় না, সে ততটাই ঊনমানব। আর যে যত কৌশলী ধড়িবাজ, প্রকৃতি ও আওয়ামকে লুণ্ঠনে পটু সে তত বেশি-মানুষ।
দলপতি হাসতেই পারে। তার দল আছে, বল আছে। তা হলেও আওয়াম স্বপ্ন দেখে, আজ যে লোকটা দলে আছে, কাল সে-ই আওয়াম হয়ে উঠবে। আজ যে আওয়াম, কাল সে দলের লোক নয়, মানুষের পড়শি হয়ে উঠবে। আওয়াম স্বপ্ন দেখে, কেননা, মাঝে মাঝেই, ইতিহাস দলপতিদের ধুলোয় গড়াগড়ি খাওয়ায়। আর আওয়াম মানুষই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy