Advertisement
০৯ জানুয়ারি ২০২৫
Donald Trump

বিদ্বেষের গর্বিত প্রবক্তা

এমন এক নেতাকে আমেরিকার জনগণ হোয়াইট হাউসে আবার জাঁকিয়ে বসার অধিকার দিলেন, এই দুই সঙ্কট সম্পর্কেই যাঁর মনোভাব সম্পূর্ণ বেলাগাম, নিয়ন্ত্রণহীন, বেপরোয়া।

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৪
Share: Save:

তা  হলে এক জন ‘অপরাধী’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয় বারের জন্যে নির্বাচিত হলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু এক জন অভিযুক্ত নন, আদালতের বিচারে দোষী প্রমাণিত ও দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধী। কোটি কোটি ডলার আত্মসাৎ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক দুর্নীতির দায়ে তাঁর বিচার হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে তাঁর অশালীন বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা মানুষ শুনেছেন। অতিমারি কালে তাঁর বিজ্ঞানবিরোধী, বেপরোয়া কথাবার্তা এবং অমানবিক কাজের পরিণতি হিসাবে এই মহাশক্তিধর দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি— প্রায় বারো লক্ষ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমাদেরই পরিচিত বন্ধুদের নিথর দেহ রেফ্রিজারেটর ট্রাকে পড়ে থেকেছে মাসখানেক ধরে, অন্ত্যেষ্টির অপেক্ষায়। আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি আমরা। টিকা নেই, সবচেয়ে ধনী দেশের প্রেসিডেন্ট নিদান দিচ্ছেন ব্লিচ ইনজেকশনের। এ দিকে, আমাদের নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে নার্সরা গাউনের অভাবে গার্বেজ ব্যাগ পরে কাজ করেছেন। প্রতি দিন মৃত্যু হয়েছে কয়েকশো মানুষের— শুধু কুইন্সের হাসপাতালে। একেও বলা চলে গণহত্যা।

নোম চমস্কির মতে, আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই সঙ্কট হল জলবায়ু বিপর্যয় এবং পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা। এমন এক নেতাকে আমেরিকার জনগণ হোয়াইট হাউসে আবার জাঁকিয়ে বসার অধিকার দিলেন, এই দুই সঙ্কট সম্পর্কেই যাঁর মনোভাব সম্পূর্ণ বেলাগাম, নিয়ন্ত্রণহীন, বেপরোয়া। প্রকাশ্যে বহু বার তিনি বলেছেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ইজ় আ হোক্স’। ট্রাম্পের প্রথম চার বছরের রাজত্বকালে আমেরিকার মাটিতে কু ক্লাক্স ক্ল্যান অন্তত চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দুকবাজি, পুলিশি অত্যাচার আকাশছোঁয়া। কৃষ্ণাঙ্গ, অভিবাসী এবং সমকামীদের উপর আক্রমণ তীব্র ভাবে বেড়ে গিয়েছে। অভিবাসী ও ক্রীতদাসদের শ্রমে গড়ে ওঠা আমেরিকা অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার বিষয়ে যদি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থাকে, ট্রাম্পের জঙ্গি মিলিশিয়ার ক্যাপিটল হিল আক্রমণ ও দখলের ঘটনায় তা আবার পিছিয়ে গিয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে।

এ বারের নির্বাচনে তাঁর প্রচারের কয়েকটা উক্তি আগে কখনও শুনিনি। ঠিক ভারতের ধর্মান্ধ, জাতিবিদ্বেষী শক্তির মতোই সংবিধানকে ঢেলে সাজানো বা রামরাজ্যের প্রতিশ্রুতির মতো আমেরিকাকে আবার ‘গ্রেট’ করে তোলার কথা। ট্রাম্প-ভ্যান্সের গোপন নথি ‘প্রোজেক্ট ২০২৫’ আসলে ফ্যাসিবাদের নীল নকশা, এমনই মনে হচ্ছে।

তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ধনী-শ্রেষ্ঠ বণিকরা— তাঁর প্রধান দুই বাজিগর ইলন মাস্ক, যিনি প্রত্যেক দিন ট্রাম্প-ভোটারদের লটারির মতো এক মিলিয়ন ডলার করে চেক লিখে দিয়েছেন, এবং বাণিজ্যসম্রাট জেফ বেজ়োস, যিনি তাঁর ক্রীত বিগ মিডিয়া ওয়াশিংটন পোস্ট-এ কমলা হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন প্রত্যাখ্যান করেছেন। আজ আর পুতুলনাচের বাজিগররা আড়ালে লুকিয়ে থাকে না। থাকার দরকার হয় না।

যে হিন্দু ও মুসলমানরা ইজ়রায়েলকে সমর্থন অথবা বিরোধিতা— এই দুই কারণে এ বারে তাঁকে ভোট দিলেন আশ্চর্য রকম উৎসাহে— তাঁরা কতটা অবহিত জানা নেই যে, ইসলাম এবং হিন্দুধর্ম দুই সম্পর্কেই ট্রাম্প ও তাঁর অতি-দক্ষিণ ঘেঁষা রিপাবলিকান পার্টির ধ্যানধারণা স্বল্প। অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদের একমাত্র ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ সোশ্যাল সিকিয়োরিটি ব্যবস্থাও ভেঙে ফেলার ডাক
দিয়েছে ট্রাম্পের দল। এই হল ট্রাম্পকথিত শান্তির নীল নকশা।

অন্য দিকে, ভাবা দরকার, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হারল কেন। কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের সঙ্গে নারীবিদ্বেষ ও বর্ণবিদ্বেষের সম্পর্ক আছে, তবে সেটা গৌণ। ক্লিন্টন, ওবামা, ন্যান্সি পেলোসিদের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জনগণের কাছ থেকে আজ বিচ্ছিন্ন। আমেরিকার প্রধান বাণিজ্য অস্ত্র নির্মাণ ও রফতানি। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে কর্পোরেট আমেরিকার কাছে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে এই পার্টি। ঠিক যেমন ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি আইজ়েনহাওয়ার অথবা আব্রাহাম লিঙ্কনের রিপাবলিকান পার্টি আর নেই, ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও আজ রুজ়ভেল্ট অথবা কেনেডি-র পার্টি নয়। দুই দলই আমেরিকার আজকের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্বাস্থ্য সঙ্কট, অশিক্ষা এবং ঘৃণা হিংসার পুনরুত্থানের জন্য দায়ী। প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে আমেরিকার অবস্থান আজ সবচেয়ে নীচে। প্রতি ছয় জন আমেরিকানের মধ্যে এক জন দারিদ্রসীমার নীচে। মাদক এবং দেহব্যবসা আমেরিকার সমাজকে পাতালে টেনে নিয়ে গিয়েছে গত ত্রিশ বছরে। জিনিসপত্রের দাম গত চার বছরে লাফিয়ে বেড়েছে।

২০২০ সালে ভোটে হেরে যাওয়ার পর থেকে ট্রাম্প ফিরে আসার প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু কমলা হ্যারিসকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি মানুষের সঙ্গে। এই সে দিন বাইডেনের স্বেচ্ছা-অবসরের ঘোষণার পর থেকে কমলার সঙ্গে আমেরিকার আলাপ। এ ভাবে প্রেসিডেন্ট ভোটে জেতা যায় না।

দ্বিতীয় বার ট্রাম্পকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে এই কর্পোরেট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তাদের ভিতরের
বার্নি স্যান্ডার্স, রাল্ফ নেডার, প্রমীলা জয়পাল, ওকাসিয়ো কর্টেজ-দের প্রগতিশীল শক্তিকে আরও শক্তিহীন করে ফেলল। গরিব মানুষের হয়ে কথা বলার আর তেমন কেউ রইল না আমেরিকার রাজনীতিতে। একই সঙ্গে বহু দেশেই ফ্যাসিবাদ ও ঘৃণা হিংসার অন্ধকারের বাসিন্দারা বন্দুক আর ত্রিশূল হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল আরও এক বার।

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump america
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy