কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ১৭ দফা পরামর্শ দেখে আঁতকে ওঠার আগে দু’টি আইনের কথা স্মরণ করা ভাল। প্রথমটি সর্বভারতীয়, দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের— ১৯৪৮-এর ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট এবং ১৯৬৩-র শপস অ্যান্ড এস্ট্যাব্লিশমেন্টস অ্যাক্ট। কর্মক্ষেত্রে মহিলা-সহ সকল কর্মীর কাজের সময়, ছুটির দিন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, মজুরি ও বেতন-সহ মহিলাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, নিয়োগ ইত্যাদির নির্ধারক এই আইন দু’টির বয়স হল যথাক্রমে পঁচাত্তর ও একষট্টি। ভাবতে অবাক লাগে, ভারতের অন্তত তিনটি প্রজন্ম তাদের কর্মজীবন কাটিয়ে ফেলল, অথচ আইনের মূলগত বক্তব্য ও অবস্থান আটকে রইল একই জায়গায়। ২০২০ সালে জাতীয় শ্রমবিধির অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড এসে প্রথম আইনটির জায়গা নিয়েছে বটে, কিন্তু মেয়েদের অবস্থান থেকে দেখলে, পরিস্থিতি বিশেষ পাল্টায়নি।
১৯৪৮-এর কেন্দ্রীয় ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্টের ধারা ২৭, ৬৬(১), ৬৬(২) এবং ৮৭(বি)-তে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের ব্যাপারে যে শর্ত ও বিধিনিষেধ জারি হয়েছিল, ১৯৬৩-র রাজ্যভিত্তিক শপস অ্যান্ড এস্ট্যাব্লিশমেন্টস অ্যাক্ট-এর ১০(এ), ১০(বি) ধারায় দোকান বা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে রাত আটটার পর, এবং সিনেমা থিয়েটার ব্যতিরেকে অন্য সব বিনোদনমূলক কর্মক্ষেত্রে সন্ধ্যা ছ’টার পর মেয়েদের কাজ করার উপর যে নিষেধাজ্ঞা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, পৌনে এক শতক পরেও তার আইনি ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ। অথচ গত পঁচাত্তর বছরে পৃথিবী আমূল পাল্টে গেছে। পেশিশক্তি-নির্ভর শ্রমবাজার ক্রমশ বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণ কাজের বাজার উন্মুক্ত করেছে। অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, সামাজিক অগ্রগতি ও ‘ইনক্লুসিভিটি’-র যুগে মহিলারা ক্রমে আরও বেশি করে শ্রমবাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ময়দান থেকে মহাকাশ, এভারেস্ট থেকে অলিম্পিক্স, পার্লামেন্ট থেকে আদালত, পুলিশ, রোজকার অফিসকর্মী, বাসচালক, খেতমজুর, ব্যাঙ্ক, প্রযুক্তি, সর্বত্র তাঁদের পদচিহ্ন। আইনের গায়ে সে আলোর প্রতিফলন হয় না কিছুতেই।
কথাটা পশ্চিমবঙ্গের জন্য বেশি সত্য। মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্নাটক, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, ওড়িশা, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ-সহ বেশ কিছু রাজ্য, ফ্যাক্টরিজ় আইনের ৬৬(১)(বি) ধারা, যা মেয়েদের কাজের সময় সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি সীমিত করে— তার পরিবর্তন করে নিয়েছে রাজ্য স্তরে। নতুন শ্রমবিধিও বলেছে, মেয়েদের সম্মতিসাপেক্ষে এই সময়সীমার বাইরেও তাঁদের কাজে নিয়োগ করা যাবে। ফলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলে এই রাজ্যগুলিতে মেয়েদের রাত্রিকালীন কাজে বাধা নেই। মেয়েদের রাত্রিকালীন কাজের দাবিতে অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, কেরল ইত্যাদি রাজ্যে গত পঁচিশ বছরে বেশ কিছু মামলা হয়, যার রায়ে রাজ্যের হাই কোর্টগুলি ফ্যাক্টরিজ় আইনের ৬৬(১)(বি) ধারাকে প্রাচীন, আধুনিক যুগে অপ্রাসঙ্গিক, বৈষম্যমূলক, অসাংবিধানিক বলে জানায়। ন্যাশনাল টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন বনাম পি আর রামকৃষ্ণন মামলায় (১৯৮৩) সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি বলেন: “পরিবর্তিত সময় ও সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে আইনকে পরিবর্তিত হতেই হয়। গাছের ছালকে হয় গাছের সঙ্গেই বাড়তে হয় বা তা খসিয়ে ফেলতে হয়; দেশের আইনকেও পরিবর্তিত সামাজিক প্রয়োজনের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে হয়। নইলে তা সমাজের শ্বাসরোধ করে।”
পশ্চিমবঙ্গে সে পরিবর্তন হয়নি। সময়ে সময়ে সরকারি নির্দেশিকাগুলি এদেরই ভিত্তিতে গড়ে উঠছে। যেমনটা হল সম্প্রতি কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর। সরকার মেয়েদের যে সুরক্ষা কবচের নিদান দিল, তার অন্তত তিনটি ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের শুধু সুযোগই কমাবে না, তাঁদের সার্বিক অধিকারও খর্ব করবে: এক, সরকারি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ ও হস্টেলের রাত্রিকালীন কাজ বা নাইট ডিউটি থেকে মহিলাদের যথাসম্ভব বিরত রাখতে হবে; দুই, কর্মস্থলে মহিলাদের দিয়ে কোনও ভাবেই একটানা বারো ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না, এমনকি চিকিৎসাক্ষেত্রেও নয়; এবং তিন, একান্তই যদি মহিলাদের দিয়ে রাতে কাজ করাতে হয়, তা হলে তা করাতে হবে দলগত ভাবে, যে দলের প্রতি মহিলা একে অন্যের গতিবিধি নজর রাখবেন।
স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে— এ তো মাথাব্যথা হলে মাথাটাই কেটে ফেলার নিদান! কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের উপর ঘটে চলা নির্যাতনের জেরে উল্টে মহিলাদেরই কর্মক্ষেত্রে কাজের সময় কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাত্রিকালীন নির্যাতন মোকাবিলায় মহিলাদেরই রাতের ডিউটি না করে ঘরের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে বলা হচ্ছে। দলগত ভাবে বা একে অন্যের উপর নজরদারি রেখে কাজ করিয়ে, তাঁদের সর্বদা অভিভাবক পরিবৃত হয়ে থাকতে বলা হচ্ছে। মহিলাদের সম-অধিকারের দাবি খর্ব করা এই নির্দেশিকা কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সুরক্ষা ও উন্নতির বিপরীত নিদান।
পাশাপাশি এই শঙ্কাও হয়, এমন নির্দেশিকা মহিলাদের শ্রমবাজার সঙ্কীর্ণতর করে তুলবে। বিশ্বের কোনও লাভমুখী সংস্থা কাজের সময় কমিয়ে, শুধু মহিলা বলে তাঁদের পুরুষের সম-বেতন দেবেন না, দেওয়ার কথাও নয়। ফলে দীর্ঘকাল চলে আসা লিঙ্গভিত্তিক অসম মজুরির সমস্যা আরও প্রোথিত হবে। অন্য দিকে, শিফট বা পর্যায়ক্রমিক কাজের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলি মহিলা-কর্মী নিতে পিছপা হবে, কারণ মহিলার বদলে পুরুষ-কর্মী নিলে তাঁদের দিয়ে উভয় শিফটে কাজ করানো যাবে। ফলে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা কমবে। তা ছাড়া মহিলাদের দিয়ে দলগত ভাবে কাজ করানোর অর্থ, একই দিনে একই সময়ে ও একই জায়গায় বেশ কিছু মহিলাকে এক সঙ্গে কাজে রাখা। অসংগঠিত ছোট বা মাঝারি-সহ (পশ্চিমবঙ্গে এর সংখ্যাই বেশি) আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বড় সংস্থাগুলিও এখন সীমিত সংখ্যক কর্মী দিয়েই কাজ চালায়। মহিলা-শ্রমিক নিয়োগ করতে তাদের যদি দলবদ্ধ ভাবে অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়, তারা করবে কেন?
যদি আইন করে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ন্যূনতম শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়, তবে? এমন ভাবনায় সাময়িক উপকার হলেও হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। উৎপাদনে লোকসান ঘটায় এমন কোনও উৎপাদন পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদে বাজারে টেকে না। আরও বড় সমস্যা, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সময় কমিয়ে দেওয়ার অর্থ গার্হস্থ শ্রম তথা অবৈতনিক কাজে তাঁদের সময় বেড়ে যাওয়া। বাইরে বেশি সময় কাজ করা পুরুষটি স্বভাবতই আশা করবেন, তাঁর স্ত্রী কর্মরতা হলেও যে-হেতু তাঁকে কর্মক্ষেত্রে কম সময় দিতে হচ্ছে, তাই সংসারে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময়টুকু তিনিই দেবেন। কর্মক্ষেত্রে অসমানুপাতিক হারে মেয়েদের কাজের সময় কমলে এ ভাবেই তাঁদের বেতনহীন শ্রমভূমিকাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে, যেখানে সামাজিক পরম্পরায় গার্হস্থের কাজ মেয়েদের দায়িত্ব।
সব কিছুর উপরে মেয়েদের স্বাধীনতার প্রশ্ন। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় লিঙ্গনির্বিশেষে এ দেশের সব নাগরিকের যে সম-অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তার প্রশ্ন। এই সময়ের প্রতিটি মেয়ের মনের প্রশ্ন। যা বলে, আমি কখন কাজ করব, কত ক্ষণ কাজ করব, তুমি তা বলার কে? আমি একা কাজ করলেও, তুমি আটকানোর কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy