বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবতে গেলে কোয়ান্টাম নিয়ে চিন্তা করতে হবেই। —প্রতীকী চিত্র।
মোগল ইতিহাস বাদ, চার্লস রবার্ট ডারউইন বাদ, অথচ ঘোষণা হয়ে গেল ছ’হাজার কোটি টাকার ন্যাশনাল কোয়ান্টাম মিশন। ধন্য ভারতীয় জনতা পার্টি! এ কেবল আমাদের আজকের কেন্দ্রীয় শাসকের পক্ষেই সম্ভব। এক দিকে প্রাচীনপন্থার উদ্বাহু উদ্যাপন— ‘সব কিছু ব্যাদে আছে’। আর অন্য দিকে এই নতুন দিনের বিজ্ঞান গবেষণা— এ দুটোকে আলাদা বা সংযুক্ত ভাবে না দেখে এক করে দেওয়া, এ শুধু প্রবল ক্ষমতাসীনের পক্ষেই ভাবা এবং করতে চাওয়া সম্ভব।
হ্যাঁ, কোয়ান্টামকে বলাই যেতে পারে নতুন দিনের বিজ্ঞান। কেন বলছি এ কথা? তা হলে আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা বলতে হয়। নিন্দুকেরা বলেন, আইনস্টাইন শেষ ত্রিশটা বছর মাছ ধরে কাটালেও ভাল করতেন। অভিযোগ মন্দ নয়। ১৯০৫ সালে স্পেশাল রিলেটিভিটি আর ১৯১৫ সালে জেনারেল রিলেটিভিটি আবিষ্কার করার পর তিনি কোয়ান্টামের বিরোধিতা করেই কাটালেন। লাভ কিছু হল না, উল্টে তিনি বদনামের ভাগী হয়ে রইলেন।
বিজ্ঞানী এবং প্রখ্যাত বিজ্ঞান-লেখক জেরেমি বার্নস্টাইন একটা বই লিখেছেন, সিক্রেটস অব দি ওল্ড ওয়ান। ওই বইতে তিনি লিখেছেন আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম-বিরোধিতার কথা। যে গল্পটা শুনিয়েছিলেন বার্নস্টাইনের মাস্টারমশাই এবং আইনস্টাইনের জীবনীকার ফিলিপ ফ্রাঙ্ক। প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনস্টাইন যে ঘরে কাজ করতেন, সেখান থেকে দেখা যেত একটা পার্ক। সেখানে সকালে ঘুরতেন মহিলারা, বিকালে ঘুরতেন পুরুষরা। সকালে ও বিকালে পার্কে ভ্রমণরত মানুষদের দেখতে দেখতে আইনস্টাইন ফ্রাঙ্ককে বলেছিলেন, ওরা সুখী, কোয়ান্টাম নিয়ে ভাবে না।
অর্থাৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে ভাবতে গেলে কোয়ান্টাম নিয়ে চিন্তা করতে হবেই। আপেক্ষিকতা হল মাধ্যাকর্ষণের আধুনিক সংস্করণ। প্রকাণ্ড বস্তুর ক্ষেত্রে খাটে। গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি। এ সব নিয়ে আপেক্ষিকতার সংসার। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের জগৎ চলে কোয়ান্টামের নিয়মে। অণু-পরমাণু। দুই রাজ্যে দুই নিয়ম কেন?
কোয়ান্টামের নিয়মকানুন অদ্ভুতুড়ে। যেমন, একটা কণা। কত জোরে ছুটছে, বা কোথায় দাঁড়িয়ে, এ দুটোই নিশ্চিত জানা যায় না। এটা যন্ত্রের ত্রুটি নয়, জানাই যায় না। আর, কণা যখন দেখা গেল, তখনই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। তার আগে? তা শুধুই একটা সম্ভাবনা। এই জন্য বিজ্ঞানী জন আর্চিবল্ড হুইলার বলেছিলেন, “নো ফেনোমেনন ইজ় আ ফেনোমেনন, আনলেস ইট ইজ় আ রেকর্ডেড ফেনোমেনন।” আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর এক সতীর্থকে বলেছিলেন, “তুমিও কি বিশ্বাস করো যে, আমি তাকিয়ে না দেখলে চাঁদটা আকাশে নেই?”
নাহ্, এতেই শেষ নয় কোয়ান্টামের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা। সবচেয়ে আশ্চর্য তার কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। আইনস্টাইন যাকে বলেছিলেন, দূর থেকে ভূতুড়ে প্রভাব। ধরা যাক, দুটো কণা, বহু দূরে গিয়েও— এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের দু’পারে থেকেও, একটা প্রভাবিত করতে পারে অন্যটাকে। কী ভাবে? একটার ধর্ম মাপলে, অন্যটার ধর্ম কী হবে, তা বলে দেওয়া যায়।
আইনস্টাইনের কাছে এ ধরনের প্রভাব অসহ্য মনে হল। ১৯৩৫ সালে তিনি এবং তাঁর দুই সতীর্থ বরিস পোদোলস্কি ও নাথান রোজেন এক পেপার লিখলেন ফিজ়িক্যাল রিভিউ জার্নালে— “ক্যান কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ডেসক্রিপশন অব ফিজ়িক্যাল রিয়ালিটি বি কনসিডারড কমপ্লিট?” আইনস্টাইন এবং দুই বিজ্ঞানী তাঁদের পেপারে (বিখ্যাত সে প্রবন্ধ ওঁদের উপাধির আদ্যক্ষরে ‘ইপিআর পেপার’ নামে প্রসিদ্ধ) বললেন, না, কোয়ান্টাম যে বর্ণনা দেয় বাস্তবের, তা ভুল। ওই তিন বিজ্ঞানী এ জন্যই এ ধরনের গাঁটছড়াকে বললেন, দূর থেকে ভূতুড়ে প্রভাব। বিজ্ঞানে, ওঁদের মনে হয়েছিল— ভূতের কোনও স্থান নেই।
ইপিআর পেপার পড়লেন এক জন। আরউইন শ্রয়েডিঙ্গার। পেপার পড়ে তিনি খুব খুশি হলেন। যাক, এত দিনে কোয়ান্টামের মোক্ষম জবাব দেওয়া গেছে। আইনস্টাইনের মতো তিনিও কোয়ান্টামের বিরোধী ছিলেন। পরমাণুর কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস। তার চার পাশে ইলেকট্রনরা ঘোরাঘুরি করছে। প্রত্যেক ইলেকট্রনের কক্ষপথ নির্দিষ্ট। এখন, একটা ইলেকট্রন এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যায়। বিচিত্র ব্যাপার, যেতে কোনও সময় লাগে না। মানে, এক কক্ষপথে ডুব, অন্য কক্ষপথে উদয়। এর নাম ‘কোয়ান্টাম জাম্প’। এটাও আইনস্টাইন মানতে পারেননি। আর, শ্রয়েডিঙ্গার বলেছিলেন যে, কোয়ান্টাম জাম্পের রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করবেনই। না-হলে জীবন বৃথা।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টকে শ্রয়েডিঙ্গার বলেছিলেন, ওটা কোয়ান্টামের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। বলেছিলেন, কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আমাদের বাস্তবের সব অভিজ্ঞতা উল্টেপাল্টে দেয়।
কোয়ান্টাম কত অদ্ভুতুড়ে, তা বোঝাতে ইপিআর পেপারে তিন বিজ্ঞানী এক কাল্পনিক পরীক্ষা বর্ণনা করেছিলেন। শ্রয়েডিঙ্গার আর এক কাল্পনিক পরীক্ষা বর্ণনা করলেন। বললেন, এক ডালাবন্ধ বাক্সের মধ্যে একটা বেড়াল, এক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, এক শিশি হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড, একটা হাতুড়ি রেখে দেওয়া হল। এ ভাবে এক ঘণ্টা রইল। এক ঘণ্টাকাল ডালাবন্ধ বাক্সের ভিতরে কী অবস্থা? এখন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ কখন তেজস্ক্রিয়তা দেখাবে বা না-দেখাবে, তা কোয়ান্টামের ব্যাপার। মানে, সম্ভাবনার ব্যাপার। কখন ঘটবে বা না-ঘটবে, কিছুই বলা যায় না। যদি পদার্থ তেজস্ক্রিয়তা দেখায়, তা হলে ঘা পড়বে হাতুড়িতে। ফেটে যাবে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের শিশি। ছড়াবে বিষাক্ত গ্যাস। মরবে বেচারা বেড়াল। আর, যদি পদার্থ তেজস্ক্রিয়তা না-দেখায়, হাতুড়িতে ঘা পড়বে না, ভাঙবে না হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের শিশি, ছড়াবে না বিষাক্ত গ্যাস, মরবে না বেড়াল।
সবটাই নির্ভর করছে পদার্থের তেজস্ক্রিয়তার উপর। যা কোয়ান্টামের ব্যাপার। সুতরাং এক ঘণ্টা ডালাবন্ধ বাক্সের মধ্যে বাঁচা এবং মরা বেড়াল থাকার কথা। এক ঘণ্টা পরে ডালা খুললে কী দেখব? হয় বাঁচা, নয় মরা বেড়াল দেখব। দেখা মানে তো ‘রেকর্ডেড ফেনোমেনন’। এবং এর জগৎ থেকে হয়-নয়’এর জগতে ফেরা। দুটোর জগৎ থেকে একটার জগতে ফেরা।
পরীক্ষা প্রমাণ করেছে, আইনস্টাইন যত সন্দেহই করুন, কোয়ান্টাম বাস্তব অভিজ্ঞতার যত পরিপন্থীই হোক না কেন, অণু-পরমাণুর জগৎ এমনই। হ্যাঁ, কোয়ান্টামের আজগুবি নিয়মকানুনের সব সত্যি।
এখন তো এই নিয়মকানুন মেনে তৈরি হতে চলেছে নানা সরঞ্জাম। কোয়ান্টাম টেকনোলজি এখন একটা ইন্ডাস্ট্রি। এ ব্যাপারে এখন রীতিমতো একটা দৌড় শুরু হয়ে গেছে— কে কার আগে তৈরি করে ফেলতে পারবে কোয়ান্টাম সরঞ্জাম। বিভিন্ন দেশ, নানা কোম্পানি (যেমন গুগল, আইবিএম ইত্যাদি) এখন এক প্রতিযোগিতায় শামিল। ভারতের ক্ষেত্রে আসল তাগাদাটা হয়তো আসছে চিন থেকে। চিনা বিজ্ঞানীরা অনেক দিন আগে শুরু করেছিলেন কোয়ান্টাম প্রযুক্তি।
কোয়ান্টাম-নির্ভর যে ক’টি প্রযুক্তি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় হল কোয়ান্টাম কম্পিউটার। চিপে ট্রানজ়িস্টর খোদাই করতে করতে (মানে, ট্রানজ়িস্টর ছোট হতে হতে) এখন শেষ সীমায় পৌঁছেছে। তাই চাই নতুন ক্ষমতাবান কম্পিউটার। এক লাফে বেড়ে যাওয়া ক্ষমতাবান কম্পিউটার। সেই যন্ত্রগণক কোয়ান্টাম কম্পিউটার। শ্রয়েডিঙ্গার যেমন ভেবেছিলেন একটা বেড়ালের বদলে দুটো বেড়াল। এক স্টেপের বদলে দুই স্টেপ। এক সঙ্গে।
আর আছে এনট্যাঙ্গলমেন্ট-নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ বিষয়ে পদক্ষেপ করার জন্য তিন বিজ্ঞানী গত বছর নোবেল প্রাইজ় পেয়েছেন। ভারত বড় দেরি করল কোয়ান্টাম গবেষণা শুরু করতে। সব সময়েই আগে শুরু করার সুফল পাওয়া যায়। চিনা বিজ্ঞানীরা আগে থেকে শুরু করার ফল পেয়েছেন। এনট্যাঙ্গলমেন্ট-নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থায় চিনা গবেষকরা এর মধ্যেই স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। গুগল কোম্পানি যে কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসির (কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে এগিয়ে) ঘোষণা করে ২০১৯ সালে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, সেই দাবি নাকি ভুল ছিল— এই মত চিনা কোয়ান্টাম গবেষকদের।
৬০০০ কোটি টাকা মুখের কথা নয়। গবেষণার জন্য এত বিপুল টাকা! কবে ভারতে আসবে ওই সমস্ত প্রযুক্তি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy