দুর্নীতিদগ্ধ: দীর্ঘ সময় ধরে চলছে স্কুলশিক্ষক আবেদনকারীদের বিক্ষোভ, ৩১ মে, কলকাতা
শিক্ষক পদপ্রার্থীদের ধর্না আর বিক্ষোভ, ক্ষোভ আর হতাশা, পশ্চিমবঙ্গবাসীর চিন্তা ও লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় সব স্তরে সব রকম নিয়োগ নিয়ে শহরের একাধিক স্থান বছরভর এই ক্ষোভের সাক্ষী। সরকারের প্রতিক্রিয়া হয় উদাসীন নয় প্রতিপক্ষীয়; আন্দোলনকারীদের নিত্য মোলাকাত শিক্ষাকর্তা নয়, পুলিশের সঙ্গে। এই ঔদাসীন্য আর দমনে কেবল ওই হবু-শিক্ষকদের নয়, সমস্ত শিক্ষকসমাজের অপমান। কর্তৃপক্ষের চোখে শিক্ষার কী স্থান, কত দূর অবনমিত, তার উৎকট প্রকাশ। আমি শিক্ষক, সেই গ্লানি আমারও।
হতে পারে, সব আন্দোলনকারী চাকরির সঙ্গত দাবিদার নন। হতেই পারে, কিছু লোক ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। বিরোধীরা অবশ্যই আসর সরগরম করছেন, করবেন। বিগত শাসনকালেও পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি আদালতে স্বীকৃত হয়েছে। আরও ব্যাপক ভাবে দেখা গেছে অন্যান্য রাজ্যে, চূড়ান্ত ভাবে মধ্যপ্রদেশে। বর্তমান অনাচারের মাত্রা তাতে কমে না।
২০১৬, ২০১৭, এমনকি ২০১৪ সালে যে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এখনও তার পাট চোকেনি। সেই ব্যর্থতার দায় কর্তৃপক্ষকে বইতেই হবে; কোনও ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। আন্দোলনকারীদের বৃহদংশের প্রত্যাশা, তাঁদের নিয়োগপত্র পাওয়া উচিত। এই প্রত্যাশার পিছনে কখনও আছে কর্তৃপক্ষের মৌখিক আশ্বাস, কখনও বিজ্ঞপ্তি বা স্বাভাবিক বিধিবিচার। উচ্চ আদালতে একের পর এক মামলায় তাঁদের দাবিগুলি যে মান্যতা পাচ্ছে, প্রাক্তন বিচারপতির তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে উদ্বেগ তুঙ্গে উঠতে বাধ্য। দুর্নীতির মাত্রা যা-ই হোক, অনমনীয় অস্বচ্ছতার নজির দিন দিন বাড়ছে।
অথচ, মেধাতালিকা তো আজ নতুন করে তৈরি হচ্ছে না, অন্তত হওয়ার কথা নয়। নিয়োগের ভিত্তিই ওই তালিকা, সবার আগে সেটি প্রস্তুত থাকার কথা। পাশাপাশি থাকার কথা বাস্তব নিয়োগের তালিকা। তৃতীয় একটি তালিকায় থাকবে কোন স্কুলে ক’টা পদ আছে, তার কতগুলি ভর্তি কতগুলি শূন্য। শিক্ষকদের মাইনে যেখানে সরকার দেয়, এই তথ্যও সরকারের ঘরে থাকতে বাধ্য। এবং ধরে নেওয়া যায়, তিনটি তালিকাই আজকের দিনে মজুত আছে কম্পিউটারে, সহজেই উদ্ধার করা যায়।
রাজ্যে স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৯৬ হাজার, শিক্ষকসংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি। সংখ্যা যা-ই হোক, কম্পিউটারবন্দি এই তিন তালিকা মিলিয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও স্কুলে-স্কুলে বণ্টনের হিসাব পদ্ধতিগত দিক দিয়ে কঠিন হওয়া উচিত নয়, যদি নথিগুলি ঠিকঠাক রক্ষিত থাকে। অবস্থা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আদালতের সঙ্গে চোরপুলিশ না খেলে সরকারের তরফে বিশ্বস্ত সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গড়ে— যাকে ‘সত্য ও সুবিচার কমিটি’ বলা হয় সেই ধাঁচে— এই আস্তাবল সাফ না করলেই নয়। এমন পদক্ষেপে আদালত সম্মত হবে আশা করা যায়, হয়তো আদালতেরই তত্ত্বাবধানে আঁটসাঁট সময়সূচি মেনে। এতে কিছু লোকের চাকরি যেতে পারে; অন্য অনেকের চাকরি হবে, পুরো ব্যবস্থাটা একটা সুষ্ঠু ছাঁদে ফিরবে। নইলে বিক্ষিপ্ত শাস্তিবিধানে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থামবে না, প্রশাসনে রাজ্যবাসীর আস্থা ফিরবে না; সবচেয়ে বড় কথা, স্কুলব্যবস্থা ধসে পড়বে।
এই শেষ পরিণতিটা মোক্ষম কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত। হাজার হাজার যুবা জীবিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা অবশ্যই মর্মান্তিক, কিন্তু শতগুণ মর্মান্তিক যে কোটি কোটি ছেলেমেয়ে উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কিছু দিন আগে শোনা গেল, রাজ্যের সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে মাধ্যমিক স্তরে গড়ে এক জনও পূর্ণ সময়ের অঙ্কের শিক্ষক নেই। সম্প্রতি এক স্থানীয় শিক্ষক জানালেন, রাজ্যে এমন ব্লক আছে যেখানে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে বিজ্ঞানে ভর্তি বন্ধ, কারণ একটা স্কুলেও বিজ্ঞানের সব ক’টি বিষয়ে শিক্ষক নেই। চাকরিপ্রার্থীদের হেনস্থার চেয়েও ভয়াবহ অনাচার এই পরিসংখ্যানগুলিতে উঠে আসছে; নাটকীয় নয়, কিন্তু বিধ্বংসী।
বাংলার স্কুলপড়ুয়াদের, বিশেষত মেয়েদের, নানা অপরিহার্য সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। স্কুলবাড়ি পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটেছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে রাজ্যবাসীর দুয়ারে উচ্চশিক্ষা পৌঁছবার ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু এ সব দিয়ে যে শিক্ষার স্রোত বইবে, সেটার গুণাগুণ নিয়ে কোনও কার্যকর চিন্তা হয়েছে কি? হয়েছে কি পঠনপাঠন সম্বন্ধে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, মান পদ্ধতি শিক্ষকসংখ্যা পরিকাঠামো নিয়ে— প্রাথমিক মাধ্যমিক উচ্চতর যে কোনও স্তরে?
সর্বশেষ আঘাত হেনেছে কোভিড। অধিকাংশ রাজ্যের তুলনায় বাংলায় দেরিতে স্কুল খুলেছে, তার পর গরমের দোহাইয়ে বন্ধ থেকেছে দুই দফা। সবচেয়ে বড় কথা, দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় মৌলিক শিক্ষণে যে ভয়াবহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা পূরণের কতটুকু ব্যবস্থা করা হয়েছে? মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অক্ষরজ্ঞান ভুলে গেছে, এমনও শোনা গেল। তাদের সংখ্যা সম্ভবত নগণ্য; কিন্তু যে ৩৪ লক্ষ শিশু অক্ষর চেনার সুযোগই পেল না, তাদের কী হবে?
‘শেখার সেতু’ নামে এক প্রস্থ বই তৈরি হয়েছে ঠিকই। তাতে ঘাটতি পূরণ হবে ‘অন্তত’ ১০০ দিনে, প্রয়োজনে আরও বেশি সময়ে। (বাড়তি গ্রীষ্মাবকাশ হিসাবে ছিল না।) এ বার যে শিশু তৃতীয় শ্রেণিতে উঠল, বলতে গেলে আগে কোনও দিন স্কুলে যায়নি, তার সেতুবন্ধন যুক্তব্যঞ্জন পাঠ দিয়ে— অর্থাৎ তাকে আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই আয়ত্ত করতে হবে। সবটা ১০০ দিনে? ভূমিকায় বলা আছে, শিক্ষকরা যেন একটা ‘সার্বিক ভাবনা’ মাথায় রাখেন; সেটা কী, তা স্পষ্ট নয়। সত্যিই শিশুরা কতটা শিখল, কী ভাবে তা মাপা হবে, ঘাটতি না পুরলে আর কী করণীয়— এ সব বাস্তব প্রশ্ন এখনও ওঠেনি, যদিও বইগুলি বিতরণের পর ১০০ দিন পার হতে চলল।
এই সঙ্কটকালে অতিরিক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন বহুগুণ বেড়েছে, বলা বাহুল্য। প্রত্যেক ছাত্রকে যে ব্যক্তিগত নির্দেশনা দেওয়ার কথা, তা স্বাভাবিক অবস্থাতেই সচরাচর হয় না, হওয়া সম্ভব নয়; আজকের পরিস্থিতিতে আরও দুষ্কর কিন্তু অপরিহার্য। নতুন শিক্ষক বহাল করেও চাহিদা মিটবে না, সাময়িক ভাবে স্বেচ্ছাশিক্ষক নিয়োগের কথা জরুরি ভাবে চিন্তা করা উচিত। অন্তত প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শূন্য পদগুলি অবিলম্বে পূরণ করা, এবং যেখানে পদের একান্ত অভাব সেখানে নতুন পদ সৃষ্টির কাজ আর ফেলে রাখা চলে না। যে ভাবে হোক টাকা জোগাড় করতেই হবে। এই তো সে দিন সরকার হঠাৎ আদালতে কয়েক হাজার নতুন পদের প্রস্তাব করেছিল, তার টাকা কোথা থেকে আসত?
আমাদের প্রশাসনে একটা মজার ব্যাপার আছে। কৃষি দফতরে খোঁজ করুন, জানতে পারবেন ফি-বছর কত টন ধান বা গম উৎপন্ন হচ্ছে; শিল্প দফতর বলতে পারবে, কত টন ইস্পাত সিমেন্ট ইত্যাদি। শিক্ষা দফতর কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যা যদি বা জানেও, হিসাব রাখে না কোন বয়সের শিশুরা কতটা লিখতে পড়তে গুনতে শিখল, একটু বড়রা ভাষা, গণিত বা বিজ্ঞান কতটা আয়ত্ত করল, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে কী গবেষণা হল। স্কুলপড়ুয়াদের অগ্রগতি সম্বন্ধে আমরা খবর পাই ‘প্রথম’-এর মতো দু’-একটি বেসরকারি সংস্থার কল্যাণে। তাদের সমীক্ষায় স্পষ্ট, ২০১৮ এমনকি ২০১৪-র তুলনায় ২০২১-এ প্রাথমিক স্তরে বাংলার শিশুদের পড়া ও গোনার মৌলিক ক্ষমতায় রীতিমতো অবনতি ঘটেছে। ২০১৪-তে অষ্টম শ্রেণির ৭৬.৩ শতাংশ ছাত্র দ্বিতীয় শ্রেণির উপযুক্ত বই পড়তে পারত; ২০২১-এ তা কমে হয়েছে ৬৮.৩ শতাংশ। ২০১৮-তে প্রথম শ্রেণির বাচ্চাদের ২৪.৯ শতাংশের অক্ষরজ্ঞান ছিল না, ২০২১-এ ৩২.১ শতাংশের। প্রথম শ্রেণিতে ১ থেকে ৯ গুনতে পারত না ২০১৮-তে ২০.৪ শতাংশ, ২০২১-এ ৩০ শতাংশ। অনেক রাজ্যে অবস্থা আরও খারাপ; সেটা আমাদের স্বস্তির কারণ হতে পারে না।
এই অবস্থায় শিক্ষক নিয়োগে হোক, মৌলিক শিক্ষা সংক্রান্ত আর কোনও কাজেই হোক, ছিনিমিনি খেলা কিংবা কালক্ষেপ করাটা সামাজিক মানবিক আর্থিক সব দিক দিয়ে চূড়ান্ত অপরাধ। এই চৈতন্য যদি আমাদের সকলের হয়— যাঁদের ছেলেমেয়ে সরকার-পোষিত স্কুলে পড়ে, এবং যাঁদের পড়ে না, একমাত্র তবেই হয়তো, ঘোর বিলম্বে হলেও, আমাদের মানবসম্পদের বিপর্যয় কিছুটা রোখা যাবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy