Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Dipsita Dhar

Dipsita Dhar: টিকা দিন, ক্লাসঘর খুলুন! নইলে স্বপ্ন ভাঙবে হাজার হাজার পড়ুয়ার

নয়া শিক্ষানীতি অম্বানী বাবুদের চাকর বানাতে চায় আমাদের। বাধ্য চাকর। পয়সা না ঢাললে ডিগ্রি পাওয়া কঠিন।

ওরও কথা ছিল কলেজ যাওয়ার। কিন্তু যাওয়া হবে না।

ওরও কথা ছিল কলেজ যাওয়ার। কিন্তু যাওয়া হবে না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

দীপ্সিতা ধর
দীপ্সিতা ধর
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২১ ১৭:১৭
Share: Save:

নাঙ্কুর বন্ধুরা অনেকে কলেজের ফর্ম ফিল আপ করছে। ওরও কথা ছিল কলেজ যাওয়ার। কিন্তু যাওয়া হবে না। অভাবের সংসার। বাবা ঘুগনি, পাউরুটি, ডিম ভাজা বিক্রি করেন। মা’কেও হাত লাগাতে হয়। তবু নাঙ্কুর স্বপ্নের অভাব ছিল না। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’, হীরক রাজার দেশে শিখেছিল। গাড়ি-ঘোড়া চাই না তার। ফুটো চালটা ঠিক করতে হত শুধু। বাবার হাঁটুর ব্যথা, মায়ের ছেঁড়া শাড়ি, এক জোড়া নতুন জামা-প্যান্ট— আপাতত এমনই ছোট ছোট কিন্তু ওর জন্য মস্ত বড় চাহিদা ছিল। স্কুলের হীরেন স্যার বলেছিলেন, ‘‘অঙ্ক এত ভাল পারিস। চালিয়ে যা। হারিয়ে যাস না।’’ অথচ নাঙ্কু বেমালুম হারিয়ে গেল। মানে কী রকম যেন তলিয়ে গেল! করোনা, অতিমারি, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব— এ সব তার সিলেবাসের বাইরে। ক্যালকুলাস গুলে খেয়েছিল। কিন্তু এ সব গলা দিয়ে নামল না। বাবার হাল্কা সর্দিকাশি থেকে ‘পজিটিভ’ হয়ে ওঠা। গোটা পাড়া একঘরে করে দিয়েছিল। পাড়ার কিছু সহৃদয় লোক পাশে এসে না দাঁড়ালে ওরা তিনজনেই মরে যেত। না-না, অতিমারিতে নয়। খিদেতে। সে খিদের জাত নেই, ধর্ম নেই। কোনও রাষ্ট্র, কোনও লকডাউন সে মানে না। নাঙ্কুর স্বপ্নের মতো খিদেটাও বড্ড বেয়াদব।

বাবা সেরে উঠেছিলেন। অনেক বাধা সত্ত্বেও দোকান খুলেছিলেন। তবু কেউ খেতে আসে না। হঠাৎ করে সবাই যেন ওদের দেখতে পাচ্ছে না। ‘আনসিয়েবল’। রাস্তায় দেখা হলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ছুঁলে যেন জাত যাবে। নাঙ্কু শুনেছে, ঠাকুর্দারা জমিদারের ক্ষেতে কাজ করতেন। তাঁদের ফলানো ধানের ভাতের গন্ধে ম-ম করত চৌধুরীবাড়ির দালান। কিন্তু চৌকাঠ পেরনোর নিয়ম ছিল না নাঙ্কুদের। গরম ভাতেরও জাত ছিল! নাঙ্কু মনে মনে রাগ করত খুব। এ কেমন অবিচার! ভাবত, একদিন যখন সে মানুষের মতো মানুষ হবে, সুদে-আসলে সব বুঝে নেবে। নাকি ভুলে যাবে অতীত ইতিহাস? চড়া পারফিউমে ঢাকা পড়ে যাবে রক্ত, ঘাম, অপমান? সে সব কথা থাক।

আজ নাঙ্কুর স্বপ্নভঙ্গের পালা। করোনা রোগী যতই সেরে উঠুক, তার ‘হাতে তৈরি খাবার খাওয়া যাবে না’। নাঙ্কু বুঝতে পারে, কেন তাদের সবাই এড়িয়ে যায়। একরকম বাধ্য হয়েই তাই কাজে নেমেছিল ও। স্কুল বন্ধ। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে মাঝে মাঝে। পাশের বাড়ির ছোট্টু ওর ক্লাসেই পড়ে। ওরা এক সঙ্গেই ক্লাস করত। বাবা টাকা জমাচ্ছিল। বলেছিল কলেজে উঠলেই স্মার্ট ফোন কিনে দেবে। দোকান বন্ধ হতেই সে সব টাকা খরচ হয়ে যায়। বাবার করোনা হওয়ার পর থেকে ছোট্টুদের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ। যাদের ঘরে চাল থাকে না, তাদের কি পড়াশোনার বিলাসিতা মানায়? নাঙ্কু যখন লাল জামা, পিঠে লাল ব্যাগ নিয়ে দু’চাকা চেপে বেরিয়ে পড়ে, তখন ওর সাইকেলটা ওর মতোই সাধারণ। পেট্রল চাই না, ডিজেল চাই না। নাঙ্কুর মন আর পায়ের জোরেই পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়ে ছোটে। এই রেস্তরাঁ থেকে খাবার ওই বাড়িতে, ওই ফ্ল্যাটের চারতলায় খাবার পৌঁছেই দৌড়ে নামে। দেরি হয়ে গেলে আবার তার টাকা কাটা যাবে। এ বার আর কলেজ-টলেজ হবে না। বাবা আগে একটা কাজ জোটাক, তারপর না হয় দেখা যাবে। নাঙ্কু গরম ভাতের গন্ধ নিয়ে ছুটে যায় এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। ওর পিঠে বোঝাই মণ্ডা-মিঠাই। আর পেটে আগুন। চৌধুরীদের দালানবাড়ির মতো অনেক চৌকাঠ ওর পেরিয়ে যাওয়া মানা।

গত লকডাউন, স্কুল-কলেজ বন্ধ এবং ‘ডিজিটাল এডুকেশন’-এর শিকার ওরা।

গত লকডাউন, স্কুল-কলেজ বন্ধ এবং ‘ডিজিটাল এডুকেশন’-এর শিকার ওরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নাঙ্কু এ দেশের ‘ওয়ার্কিং স্টুডেন্ট / ড্রপড আউট স্টুডেন্ট’- দের একজন। ওদের সংখ্যাটা প্রায় কয়েক লক্ষ। বিগত লকডাউন, স্কুল-কলেজ বন্ধ এবং ‘ডিজিটাল এডুকেশন’-এর শিকার ওরা। যে দেশের বেশিরভাগ পরিবারের বার্ষিক আয় ১০ হাজার টাকার কম, তফশিলি জাতি-উপজাতি বা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ভুক্ত হলে আরও কম, যে দেশে কম্পিউটার ব্যবহার করা পরিবারের সংখ্যা ১৫.১ শতাংশ, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩০ শতাংশ, সে দেশে অনলাইন শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রস্তাবিত ‘ব্লেন্ডেড মোড’, যার ৪০ শতাংশ হবে ডিজিটাল মাধ্যমে, কাদের জন্য? এই যে হাজার হাজার নাঙ্কু অঙ্ক শিখতে চেয়ে ডেলিভারি বয় হয় গেল শেষ দু’বছরে, এর দায়িত্ব নেবে কে? জীবনের অনিশ্চয়তা, গরিব বাবার ফোন না কিনতে পারার অসামর্থ্য বুকে নিয়ে জীবন শেষ করে দেওয়া ‘এলএসআর’-এর ঐশ্বর্যের জীবনের দাম চোকাবে কোন সরকার? অবসাদ আর অস্থিরতা তিলে তিলে শেষ করছে যে ছাত্রছাত্রীদের জীবন, তার দায়ভার কেউ নেবে না?

সদ্যপ্রকাশিত এসএফআই-এর রিপোর্ট ‘দ্য প্যানডেমিক দ্যাট এন্ডেড এডুকেশন ফর মেনি’-তে এমনই সব কথা উঠে এসেছে। লকডাউনের কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা স্কুলছুটেরর সংখ্যা যে কোনও মানুষের বুকে কাঁপন ধরাবে। মেয়েরা দেশজুড়ে স্কুলছুটের সংখ্যায় পাল্লায় আরও ভারী। সমীক্ষা বলছে ৩০.২ .শতাংশের কারণ কোনও ‘ঘরের কাজ’। কারণ, ঘরের কাজ মেয়েদেরই। না হলে শ্বশুরবাড়ির কাছে কী সার্টিফিকেট দেখাবে? গোল রুটি, মানিয়ে নেওয়া— এ সবই তো মেয়েদের গয়না। ভারতে গা-ভর্তি গয়না ছাড়া মেয়ের বিয়ে মানায় না। গত লকডাউনে ‘ফোর্সড ম্যারেজ/ চাইল্ড ম্যারেজ’-এর শিকার হয়েছে বহু ছাত্রছাত্রী। চাইল্ড হেল্পলাইন নম্বরে গার্হস্থ্য হিংসায় আটকে-পড়া মেয়েদের ফোন বেড়েছে ২০১৯-এর চাইতে প্রায় তিন গুণ। শিল্পা-সুলতানাদের আকাশছোয়াঁর ইচ্ছাগুলো আকাশকুসুম হয়ে গিয়েছে। সমীক্ষা বলে, অতিমারীর পর স্কুলে ফেরার প্রবণতা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ, ঘরের কাজ, তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়া, তাড়াতাড়ি মা হওয়ার চাপে ক্লাসরুমে ফেরা হয়নি আর।

গত লকডাউনে ‘ফোর্সড ম্যারেজ/ চাইল্ড ম্যারেজ’-এর শিকার হয়েছে বহু ছাত্রছাত্রী।

গত লকডাউনে ‘ফোর্সড ম্যারেজ/ চাইল্ড ম্যারেজ’-এর শিকার হয়েছে বহু ছাত্রছাত্রী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নই, এরা কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় বা বেগম রোকেয়া হবে না, তবুও এরা শিল্পা-সুলতানাই হতে পারত। কিম্বা মীরাবাই চানু, মেরি কম বা রানি রামপাল। খবরে পড়ছিলাম, লন্ডন অলিম্পিক্সের মাশালবাহক পিঙ্কি কর্মকার বাবার সঙ্গে অসমের চা বাগানে মজুরের কাজ করেন। বিশ্বকাপ জেতা ছেলের হাতে ব্যাট-বলের জায়গায় উঠে এসেছে ইট, জোগাড়ের কাজের সরঞ্জাম। এমন বৈষম্য ছিলই, নারী-পুরুষ, জাতপাত, বিত্তশালী ও শ্রমজীবী। অতিমারি শুধু সেই পর্দাটা সরিয়ে নিয়েছে। এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বিভাজন। যার পকেটে রেস্ত, তার কাছে বেঁচে থাকাটা সহজ। যার ঘামে জবজবে শরীর, তার সামনের দিনটা ঝাপসা। তবু বাঁচার একটা কথা ছিল গণতন্ত্রে। জনকল্যাণকারী রাষ্ট্র বা ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর কথা ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের দায়িত্ব নেওয়ার। ১৯৯০ সালের পর থেকে সে একটু একটু করে পিছনে হাঁটছে। এ বার একেবারে উদ্বাহু হয়ে থালা বাজানোর পর্যায়ে চলে এসেছে। কর্পোরেট ট্যাক্স সংগ্রহ কমাও, পেট্রল-ডিজেলের সেস বাড়িয়ে দাও, কর্পোরেট ঋণ মাফ করো, শুধু কৃষিঋণ আদায় করে নাও সঠিক সময়ে। গরিব আরও গরিব হবে। বড়লোক আরও বড়লোক। শ্রমিক আত্মহত্যা করবে আর অম্বানীজি ফুলেফেঁপে উঠবেন। চেনা চিত্রনাট্য। খালি হিন্দুত্ববাদী মোড়কে আরও একটু বিষাক্ত। আরও একটু ঘৃণা। চাপ চাপ রক্ত।

 শিক্ষানীতি আমাদের অম্বানীবাবুদের চাকর বানাতে চায়। বাধ্য চাকর। পয়সা না ঢাললে ডিগ্রি পাওয়া কঠিন।

শিক্ষানীতি আমাদের অম্বানীবাবুদের চাকর বানাতে চায়। বাধ্য চাকর। পয়সা না ঢাললে ডিগ্রি পাওয়া কঠিন। নিজস্ব চিত্র

নয়া শিক্ষানীতি আমাদের অম্বানীবাবুদের চাকর বানাতে চায়। বাধ্য চাকর। পয়সা না ঢাললে ডিগ্রি পাওয়া কঠিন। তাই দর কষাকষিতে শিল্পা-সুলতানা-নাঙ্কুরা কমজোরের দলে। ওরা কম পয়সায় নিরাপত্তাহীন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হবে। মালিকের মেয়ের শাড়িতে ওদের চোখের জল চুমকির মতো চকচক করবে। ওদের রক্তে লাল হয়ে হেসে উঠবে চুনী— ‘শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে, ওরা কাজ করে’।

নাঙ্কু-জোসেফা-ঐশ্বর্যদের এ বার ক্লাসঘরে ফেরার পালা। ১২ অগস্ট, বৃহস্পতিবার থেকে ওদের জন্য, আমাদের জন্য রাস্তাই হবে ক্লাসঘর। ‘টিকা দিন, ক্লাসঘর খুলুন’। পাশাপাশি, স্কুলছুটদের জন্য ব্যবস্থা করুন বিশেষ প্যাকেজের। কোভিডে অনাথ হওয়া শিশুদের দায়িত্ব নিক সরকার। রানি রামপালদের পায়ের তলার মাঠ আর পেটের খিদের দায়িত্ব সরকার নিক। বাকিটা ওরা বুঝে নেবে। দরকার পড়লে ছিনিয়ে নেবে। ছোট্ট কুঁড়িতে শহিদ হয়ে যাওয়া, সকলের শিক্ষা, সকলের কাজের দাবিতে লড়ে যাওয়া সুদীপ্ত-সইফুদ্দিনের কসম, এ লড়াই ওরা জিতবে। নাঙ্কু-শিল্পা-জোসেফা-সুলতানাদের হারতে দেবেন না।

(লেখক বামপন্থী ছাত্রনেত্রী। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Dipsita Dhar CPIM school education higher studies digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy