দুর্নীতির জাল।
যাওয়া-আসার রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা পাথর; হোঁচট খাওয়া এড়াতে তাকে এক কোণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক দিন কেউ এসে তার গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে পুজো করতে শুরু করল। অচিরেই সেটি স্বপ্নে পাওয়া ‘জাগ্রত’ শিবলিঙ্গের মর্যাদা পেল, তাকে ঘিরে মন্দির উঠল, ভক্ত সমাগম হল, শেষ পর্যন্ত যিনি রোজ হোঁচট খেতেন তিনিও সেই দেবতার মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করে ফেললেন। গল্পের নাম ‘দেবতার জন্ম’ (শিবরাম চক্রবর্তী)। আজ দুর্নীতির উৎস সন্ধান করতে গিয়েও এই গল্পের কথাই মনে পড়ল।
দুই দশক আগে কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি বিভাগে থিসিস জমা দিতে গিয়েছিল এক ছাত্রী। কেউ তার কাছে কিছু (চা-মিষ্টি-বকশিশ) চাননি, সেও নিজে থেকে কিছু দেয়নি। আর দেয়নি বলে তার কোনও অসুবিধেও হয়নি। পরবর্তী কালে তার কনিষ্ঠরা থিসিস জমা দিতে যেতে শুরু করল মিষ্টির বাক্স নিয়ে এবং অচিরেই তা পরিণত হল ‘মিষ্টি খাবার’ টাকায়। ‘চেয়ে নেওয়া’ও শুরু হল। আজ যাঁরা কোটি কোটি মুদ্রা গোনা দেখে শিহরিত হচ্ছেন, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, এ ভাবেও দুর্নীতির জন্ম ও বংশবৃদ্ধি হয়।
কিন্তু তারও আগে বুঝে নিতে হবে আমরা ঠিক কী নিয়ে চিন্তিত? টাকার পরিমাণ না সামগ্রিক দুর্নীতি? যদি দ্বিতীয়টা হয় তা হলে বলি, দুর্নীতি যখন জাল বিস্তার করে তখন তা শুধু টাকায় আটকে থাকে না মিত্রোঁ; সে কথায় পরে আসছি! আর প্রথমটা হলে মনে রাখবেন জমা হওয়া ওই টাকায় আপনার আমার পাপও লেগে আছে, কারণ টাকা দেওয়ার এই সংস্কৃতি কালে-কালে তৈরি হয়েছে, আর তাতে আমরাও যোগ দিয়েছি, কখনও নিতান্ত বাধ্য হয়ে কখনও স্বেচ্ছায় প্রায় উপযাচক হয়ে, যে রকম ওই পিএইচ ডি বিভাগে টাকা দেওয়া হয় বা হত। প্রথম দিকে মনে করা হয়, টাকা দিলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীরা খুশি হয়ে কাজটা এগিয়ে দেবেন, আর পরবর্তী কালে মনে করা হয়, টাকা না দিলে কাজ পিছিয়ে যাবে। সবটাই কাল্পনিক, ঠিক ‘দেবতার কৃপা’র মতো। আজ যাঁরা মনে করছেন কোটি কোটি টাকা শুধুই স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) অযোগ্য প্রার্থীদের দেওয়া ঘুষ, তাঁরাও ভুল করছেন। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, টাকা না দিলে যোগ্য প্রার্থীরাও অনেক জায়গাতেই চাকরি/বদলি পাননি। এমন কিছু ঘটনার কথা সরাসরি কানে এসেছে সেই প্রার্থীদের কাছ থেকেই। এ-সব কথা জেনে বড় অসহায় লাগে, বুঝতে পারি না লড়াইটা ঠিক কোথা থেকে কার বিরুদ্ধে শুরু করতে হবে। যে শিক্ষিত ছাত্র যোগ্যতা অর্জন করার পর শুধু কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষা করছে, সে নিরুপায় হয়ে যদি শেষ অবধি সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলে, তাকে কতটা দোষ দেওয়া যায়!
কিন্তু যে সব জায়গায় টাকা লেনদেন হয় না বলেই জানা আছে সে-সব জায়গাও আসলে কতটা দুর্নীতিমুক্ত? পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাবে নিয়োগ হয়, তার প্রক্রিয়া কি স্বচ্ছ? নিয়োগের ক্ষেত্রে বিগত শাসকগোষ্ঠীর দু’টি উজ্জ্বল বিন্দু হল এসএসসি (১৯৯৭) আর কলেজ সার্ভিস কমিশন বা সিএসসি (১৯৭৯)। অবশ্য এসএসসি-র আগেও বামগোষ্ঠীর একটা দীর্ঘ সময়কাল ছিল; সেই সময় ইস্কুলের চাকরির জন্য স্থানীয় পার্টি দফতরে কী দিতে হত না হত, বা পছন্দের প্রার্থীকে নেওয়া না গেলে বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে কী ভাবে প্যানেল বাতিল হত, তা না হয় আপাতত ভুলে থাকাই গেল। কিন্তু কলেজে নিয়োগের সে কাল-এ কাল নিয়ে তো কিছু কথা আলোচনা হওয়া উচিত। এসএসসি-র স্বর্ণযুগে ‘ডোনেশান’ দেওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা স্বচ্ছ পদ্ধতিতে চাকরি পেতে শুরু করেছিল, কিন্তু সিএসসি কোনও যুগেই সেই স্বচ্ছতা অর্জন করতে পারেনি। কারণ, সিএসসি-র প্যানেল নির্মাণ ইন্টারভিউ-ভিত্তিক এবং সেখানে নানা ধরনের পরিচিতি সংক্রান্ত ‘অনর্থনৈতিক’ বিষয়গুলো কাজ করে যেত ও যায়। সিএসসি-র প্রথম বা মধ্যযুগেও (সেই অর্থে স্বর্ণযুগ তো কিছু আসেনি!) কী ভিত্তিতে প্যানেল তৈরি হল, সেই দীর্ঘ তালিকার ক’জন চাকরি পেল, কার নির্দেশে কে কাকে পেরিয়ে চাকরি পেয়ে গেল, তার হিসাবটা ছিল ‘অন্য রকম’। আর, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে খুব কম পদের জন্য অনেক প্রার্থী থাকেন, সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ নামক গোটা পদ্ধতিটাই এক একটা প্রহসন, কে কে পাবেন তা আগে থেকেই স্থির থাকে। যোগ্যতর প্রার্থীকে ইন্টারভিউ বোর্ডে নানা ভাবে হেনস্থা করে বাদ দেওয়ার নিষ্ঠুর খেলার কোনও বদল সে কাল থেকে এ কালে হয়নি। বরং শিক্ষাজগতে প্রভাবশালী ব্যক্তির অধীনে গবেষণা করার প্রবণতা (যাতে চাকরি-সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়) বেড়েছে কালে কালে। একে কী বলবেন? স্বচ্ছতা?
সুতরাং, শিক্ষাজগতের দুর্নীতি সে দিনও ছিল, আজও আছে। পরিমাণে বেড়েছে, ব্যাপ্তিতেও। সে দিন দেখেছি কলেজে পড়াবার যোগ্যতা যে অর্জন করতে পারেনি, সে অনায়াসে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাচ্ছে। আজ দেখছি, দুর্নীতির অভিযোগে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এমন শিক্ষক ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান পেয়ে কলেজশিক্ষকদের নির্বাচন করছেন। এই সমস্ত লেনদেন সর্বদা অর্থমূল্যে হয় না। তাই টাকা নিঃসন্দেহে দুর্নীতির একটি হাতিয়ার। কিন্তু চোখে দেখা যাচ্ছে বলে টাকাই একমাত্র দুর্নীতি, এমন ভাবনা নিঃসন্দেহে ভুল। দৃশ্য-অদৃশ্য বহুরূপে সে আমাদের সম্মুখে বিরাজমান।
আর যদি টাকার কথাই ধরি, তা হলেও আমাদের দায়িত্ব কমে না। বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে ‘টাকা দিয়ে প্রতারিত’ হওয়ার ঘটনা কাগজে প্রায়ই পড়ি। বেশ কিছু বছর ধরে সাধারণ স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্যও আমরা ছাত্রপিছু ‘ডোনেশান’ দিয়েছি। বি এড পড়ার সুযোগ পেতে দিয়েছি কয়েক লক্ষ টাকা। এ সব কথাও বাইরে এসেছে যখন কোথাও হিসাবের (পড়ুন বখরার!) গোলমাল হয়েছে। কিন্তু আমরা কোর্স ফি’র বাইরে ওই বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়েছি কেন? মেধাতালিকার তোয়াক্কা না করে যাতে আমার ছেলেটি বা মেয়েটি কোনও ভাবে একটা ‘সিট’পেয়ে যায়, সেই জন্যই তো! কয়েক বছর আগে কল্যাণীর একটি বেসরকারি কলেজে বি এড পড়ার জন্য ৫৩ হাজার টাকা কোর্স ফি-র উপরে আরও লক্ষাধিক টাকা ঘুষ দিয়েছিল কিছু ছাত্র; তারা সেটা দূরদর্শনের পর্দায় ঘোষণা করতে কুণ্ঠিত হয়নি, তালিকা বহির্ভূত ‘সিট’ তাদের ন্যায্য অধিকার বলে দাবি করেছিল। এই ভাবে টাকা দিয়ে সুযোগ কেনাকে তো আমরাই প্রায় বৈধ করে তুলেছি, অজ্ঞতার মোড়কে দুর্নীতিকে আমরাই প্রশ্রয় দিয়েছি যা এই আয়তনে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বার বার বলেছেন পারস্পরিক বিশ্বস্ততা ও মূল্যবোধই একটা সমাজের সম্পদ। কিন্তু এই মাত্রার একটা অসততা সামনে এলে সাধারণ মানুষ সৎ থাকার অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন। পঞ্চাশ কোটির কেলেঙ্কারি চোখের উপর জ্বলজ্বল করলে মাছওয়ালা বা ট্যাক্সি ড্রাইভার পঞ্চাশ টাকা বেশি নেওয়াকে আর অন্যায় মনে না-ও করতে পারেন। শিক্ষকদের নিয়ে আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়েছে যে সব মিম, তা দেখে অনুপ্রাণিত ইস্কুলের ছাত্ররাও শিক্ষকদের অসম্মান বা অমান্য করার ছাড়পত্র পেয়ে যেতে পারে। প্রতি দিন নানা রূপে দুর্নীতির সঙ্গে লড়তে লড়তে আমরা বোধ হয় তাকে চিনতেও ভুলে যাচ্ছি, স্বাভাবিক ভেবে সইয়ে নিচ্ছি; সেটাই সবচেয়ে বড় এবং ব্যাপক সামাজিক ক্ষতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy