Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Industrial Hub

কেমন আছে শিল্পগ্রাম

কথিত আছে, জগন্নাথের স্নানযাত্রার পর, ১০৮ ঘড়া জলে চান করে ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৫৩
Share: Save:

সবচেয়ে শেষের বাড়ি আমার এই গ্রামে। কপাল ফুটা আমাদের। গত দুই বছরে কেউ আসেনি গো আমাদের এখানে, কেউ আসেনি গো দিদি।” আর্তনাদের কণ্ঠ শোনা গেল কান পাততেই। রঘুরাজপুর শিল্পগ্রাম, পুরী থেকে মাত্র ১১ কিমি দূরে অবস্থিত এক ঐতিহ্য সংরক্ষণকারী কেন্দ্র, হেরিটেজ ভিলেজ। পুরী ঘুরতে গেলে অনেকেই দেখে আসি এই গ্রাম। ২০০০ সালে এই গ্রামকে হেরিটেজ সম্মান দেওয়া হলেও এই গ্রামের বয়স প্রতিষ্ঠা হয় ৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। প্রায় দেড়শোটি শিল্পী পরিবারের বাস, যারা বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ওড়িশার পটচিত্র তৈরির শিল্পকলা। পুরনো ব্যবহৃত শাড়ি, তেঁতুলবিচির ‘গম’ (গুঁড়ো), আর সাদা চকের গুঁড়ো দিয়ে হাতে তৈরি ক্যানভাস, ঝিনুকের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি সাদা রং, হরীতকী বাটার হলুদ রং, ঘিয়ের প্রদীপের কালো রঙের মতো আরও নানান উপকরণে তৈরি হয় অবিশ্বাস্য সূক্ষ্ম চিত্রণের পটশিল্প। রাসযাত্রা, বিষ্ণুর দশাবতার, জগন্নাথের স্বর্ণবেশ, গন্ধর্বরথ— কে নেই পটচিত্রে।

কথিত আছে, জগন্নাথের স্নানযাত্রার পর, ১০৮ ঘড়া জলে চান করে ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা। তখন মূর্তির গর্ভগৃহের দ্বার রুদ্ধ রেখে এই পটচিত্রেই পূজিত হন তিনি, এমনই বিশ্বাস। তাই এই পটচিত্রের এত গুরুত্ব, মহিমা, বংশপরম্পরায় এই পটচিত্র আঁকা, তার রং তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণের জ্ঞান রাখে এই শিল্পগ্রাম। অবশ্য শুধু পটচিত্র নয়, সময়ের প্রয়োজনে ছোটখাটো উপহার সামগ্রীও তৈরি করতে বাধ্য হন তাঁরা, কেউ কেউ সে সব পসরা নিয়ে দিল্লি বা বাংলার মেলাতেও আসেন।

গত দু’বছর কোনও সুযোগই পাননি শিল্পীরা। পর্যটনে ছেদ, পুরীতে পর্যটকদের আসা বন্ধ মানে শিল্পগ্রামেও পর্যটক বন্ধ। অতিমারির পরিস্থিতি সামান্য নিয়ন্ত্রণে আসার কারণে পুরীর মন্দিরের বিধিনিষেধ অনেক শিথিল হয়েছে, মানুষ পুজো দিতে আসতে পারছেন। শিল্পগ্রামও আশায় বুক বাঁধছে যদি নতুন করে শুরু হয় বিক্রিবাটা।

ভার্গবী নদীর পাশ ধরে বড় রাস্তা ছেড়ে যেখানে নামতে হয় শিল্পগ্রামে যাওয়ার মেঠো পথে, ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়েছিলেন রঞ্জন। শিল্পগ্রামে যাতায়াতের সুবাদে পরিচিত, গ্রামের মধ্যে যে সামান্য ক’জন ওড়িয়া বাংলা হিন্দি মিশিয়ে বেশ পরিষ্কার করে কথা বলতে পারেন, তাঁদের মধ্যে রঞ্জনই সবচেয়ে সামনে। দিল্লি হাট, সবলা মেলা সব জায়গাতেই আবার দেখা হয় রঞ্জনের সঙ্গে।

“জুন মাসে আমরা প্রত্যেক শিল্পী ফ্যামিলি দশ হাজার টাকা করে পাইছি দিদি।”

গত জুন মাসে ওড়িশা সরকার ঘোষণা করে যে, নতুন করে সাজিয়ে তোলা হবে শিল্পগ্রাম। প্রত্যেক শিল্পীপরিবারকে অর্থসাহায্য করা হয়, যাতে নতুন করে তাঁরা রং তৈরি করতে পারেন, তাঁদের পটচিত্রের অংশবিশেষ ফুটিয়ে তুলতে পারেন দেওয়ালে।

“ফণীর ফলে খুব ক্ষতি হয়েছিল দিদি। রং, দেওয়াল কোনও কিছুরই শোভা ছিল না। আমাদের কত কাজ, কত কিছু যে ভেসে গেছে।”

২০১৯-এর ফণী বিধ্বস্ত করেছিল ওড়িশাকে। পুরী, ভুবনেশ্বরের ক্ষয়ক্ষতি আমরা দেখেছি, ওড়িশার গ্রামাঞ্চলের ক্ষতি তেমন ভাবে সামনে আসেনি। রঘুরাজপুর ও তার সংলগ্ন চন্দনপুর, বাসুদেবপুরে যাঁরা গিয়েছেন, দেখতে পাবেন যে অন্যান্য গ্রামের চেয়ে আপাত ভাবে দেখতে অন্য রকম বা আর্থিক সমৃদ্ধি তুলনামূলক ভাবে বেশি হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে শিল্পগ্রাম একই রকম দুর্বল।

যে ভাবে একই রকম স্পর্শকাতর থেকেছে সে অতিমারির সামনে। অসুস্থতা, মৃত্যুর ভয়কেও অতিক্রম করে সেখানে ছিল শূন্যতা। অতিমারির আগে যাঁরা গিয়েছেন, দেখে থাকবেন কী ভীষণ কর্মব্যস্ততা, শিল্পীরা মাদুর পেতে দিচ্ছেন, এ ঘর ও ঘর নিয়ে যাচ্ছেন।

এখন, অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক অবস্থাতেও সেই সব রাস্তা নিস্তব্ধ। গ্রামের মাঝখানে সারিবদ্ধ মন্দিরের যে শ্রেণি, সেই ভূয়াসেনী, রাধামোহন, গৌরাঙ্গ মন্দিরেও পুজো চলছে কোনও মতে।

গ্রামের শেষের এ বাড়িটি একদম ভার্গবী নদীর তীরে, সেই শিল্পী ও তাঁর মা হাতের শিল্পকাজ দেখাচ্ছিলেন। “আমার মনে হয় দিদি এই সব করোনা আর থাকবে না। তখন অনেক লোক আসবে। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ থাকবে, যে আমার এই কাজ বুঝবে, আদর করে নিয়ে যাবে সব কিছু। তত দিন আমরা এঁকে যাব দিদি, তৈরি করব পট।”

এই বিশ্বাসেই বাঁচছে শিল্পগ্রাম। আমাদের সবার মতোই।

অন্য বিষয়গুলি:

Industrial Hub Orissa Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy