তেইশ বছর বয়সে স্বামীহারা মেজদিদা তাঁরই সমবয়সি বিধবা জা-কে বলেছিলেন, “চালকুমড়োর ঘণ্টতে কালোজিরের সঙ্গে একটুখানি হিং সম্বার দিয়ে দেখিস দিদি, একদম ইলিশ-ইলিশ গন্ধ হবে।” রক্ষণশীল হিন্দু বাড়িতে প্রায়-অচ্ছুত আফগান দেশের হিং আলতো অনুমোদনের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে নিরামিষ হেঁশেলে। বাংলার পাকঘরের চিত্র যেন হয়ে উঠতে থাকে এক সান্ত্বনার শিল্প, বাঙালি মেয়ের নিজস্ব বয়ান, যা নিরুচ্চারে অতিক্রম করে যায় দুর্লঙ্ঘ্য সীমান্ত, এমন অনায়াসে যে কেউ খেয়ালই করে না।
পূর্ববঙ্গের কালিপুরের বর্ধিষ্ণু লাহিড়ী চৌধুরী পরিবার দেশভাগের পর চলে আসে এ পারের মুক্তাগাছায়। সে বাড়ির গিন্নি রেণুকা দেবী চৌধুরানী রকমারি নিরামিষ রান্না-র ভূমিকায় লিখছেন, নামকরা রাঁধুনিদের (এঁদের মধ্যে অনেকেই বামুন ঠাকুর) কাছে অনেক শিখেছেন তিনি। তা ছাড়া ছিল নুরা বাবুর্চি, যাঁর নাম মাইনের খাতায় নুরা চক্রবর্তী লেখা থাকত। তখনকার দিনে মুসলমান বাবুর্চির রান্না বারবাড়িতে কর্তারা খেতেন ঠিকই, কিন্তু সেটা কখনওই স্বীকৃত হত না, সে জন্যেই মাইনের খাতায় চক্রবর্তী পদবি যোগ। দেশভাগের অনেক পরে, কলকাতার বাড়িতে নুরা বাবুর্চিকে অন্দরমহলে ডেকে অনেক রান্না শেখার পর নুরাই রেণুকা দেবীকে অভয় দিয়ে বলে, “ভয় করবেন না মা, যদি কোনও সময় ভুলে যান, তখন গুরুর নাম স্মরণ করবেন, আমার নাম স্মরণ করবেন।” রান্নার নাম মনে করলে দেখি নিরামিষ আলুর দম, কাঁচকলার কোফতা বা ছানার কোর্মায় কত মুসলমানি নাম ঢুকে পড়েছে বাঙালি হিন্দুর পাকশালে।
বাংলার রান্নাঘর শুধু হিন্দু বাঙালির রান্নাঘর নয়। তাতে আছে দুই বাংলার রান্নাঘরই; বাঙালি মুসলমানের ‘পাকের ঘর’ (ঢাকায় প্রচলিত), ‘ওস্যাঘর’ (বরিশাল), ‘হেইনসেল’ (যশোর)। মুসলমানের রান্নায় আমিষ-নিরামিষ হেঁশেলের বেড়া নেই। মনে হয়, রান্নায় ঘটি-বাঙাল বিভাজনের আড়ালেও একটা হিন্দুয়ানি আছে। দেশভাগের পর রাঢ়-বরেন্দ্রভূমের সাংস্কৃতিক সংঘাত হিন্দু বাঙালির মধ্যে এই বিভাজন তৈরি করেছিল। বাংলাদেশে আবার দেখি বিভাজনটা হিন্দু-মুসলমান পাকঘরের। আমার ও-পার বাংলার ধর্ম-ভাই তানভীর আহমেদ যশোরের ছেলে। ওর স্ত্রী নূপুর কায়স্থ বাড়ির মেয়ে। নূপুর বলে, “রাঁধুনি, মেথি, কালো জিরা ফোড়নের যে আলাদা বাস (ঘ্রাণ), সেটা আমার শাশুড়িমা জানতেন না। আমিও জানতাম না, কত রকমের মাছের ভুনা আর ভর্তা হয় বাংলার মাটিতে।” তানভীরের মা নাকি এখন ‘ডাইল’-এ পেঁয়াজ-রসুনের সঙ্গে জিরে মিশিয়ে ‘বাগড়’ (সম্বরা) দেন। এই জিরে তাদের পাকঘরের রান্নায় এসেছে স্ত্রী নূপুরের হাত ধরে।
কষানো আর সাঁতলানো (মঙ্গলকাব্যে পাব ‘সান্দাইলো’), ভাজা আর ভাজি, ঘ্যাঁট আর ভুনা— কত যুগ ধরে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কী সুন্দর পাশাপাশি বাস করছে আমাদের রান্নাঘর! কাঁচকলা বা লাউয়ের খোসা দিয়ে অমৃতের মতো রান্না সম্ভব হয়েছে এমনই ঘরোয়া উপাদান দিয়ে, কখনও নামানোর আগে একটু আচারের তেল, কোথাও বা কাঁচা কাসুন্দির ছিটে। ফুটতে থাকা লাউশাকের ঝোলে একটু শিল-ধোয়া জল, মানকচু বাটায় সামান্য নারকেল কোরা (যশোর, খুলনায় ঘরে ঘরে নারকেল গাছ), সোনামুগের ডালে আতপ চাল ধোয়া জল, লোটে (লইট্টা) মাছ বাটায় আম-কাসুন্দি, কচুর পাতায় মাছ রাঁধার সময় দুটো লঙ্কা পুড়িয়ে মেখে দেওয়ার গোপন আদানপ্রদান রয়ে গিয়েছে গ্রাম বাংলার গেরস্ত ঘরের মেয়েদের দিনযাপনে। রান্নার সুবাস জাত-ধর্মের নিগড় ভাঙে, নারী-পুরুষ বিভেদ প্রাচীরও। ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী চৈতন্য রায় বলেছিলেন, উত্তরবঙ্গে খোলের বাদনে যে ঘিসঘিস শব্দ ওঠে, তাতে থাকে টাকি মাছ ভাতে সেদ্ধ করতে দেওয়ার গোপন অভিলাষ। চৈতন্যদার মুখে শুনেছিলাম বোল: ‘ঘিস ঘিসা ঘিসা ঘিস/ টাকি মাছখান ভাতত দিস্’। উঠোনে বসে থাকা পুরুষটির সঙ্গে অন্তরালের নারীর প্রকাশ্য বিনিময় নিষিদ্ধ, তাই এ ভাবেই বার্তা বয়ে নিয়ে চলে খোলের বোল।
আজ বাঙালির বিয়েবাড়ির পাতে বাটার নান, কুলচা বা পনির বিনিময়ের বার্তা আনে বটে, কিন্তু তা খাওয়ার পাতে যতটা, রান্নার হাঁড়িতে ততটা নয়। অন্তঃপুরের প্রচ্ছন্ন বিনিময় নজরে আসার আগেই মিলিয়ে যায় চিরতরে, এই তার বৈশিষ্ট্য। সার কথা, মেয়েদের নিজস্ব বয়ানের পরিসরে ঘটি-বাঙাল বা হিন্দু-মুসলমান নেই। বাজারে বিক্রি হওয়া মশলার চটজলদি ধোকা বা শুক্তোর মোড়কের গায়ে উপকরণের তালিকা থাকে বটে, কিন্তু কত বিচিত্র পথে যে একটি বাঙালি পদে এসে মিশেছে এতগুলি মশলা, সে কথা লেখা থাকে না। কর্পোরেট রান্নার বাজার আমাদের মনে করিয়েছে, আমরা যুগে যুগে রান্নাঘরে বন্দি মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে শিখিনি। ভাবিনি, তাঁদের বন্ধনগুলো ঠিক কতখানি বেদনার ছিল, কেমন করে সেগুলো পেরিয়েছিলেন তাঁরা। আর নস্যাৎ করেছিলেন সমাজ-সংসারের সীমান্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy