গত দেড়শো বছর ধরে ‘হুতোমের তুল্য বই আর হল না’ বলে যে বাঙালি আক্ষেপ করেই চলেছে, তার একটি কারণ অবশ্যই হুতোমের ভাষা, যে ভাষায় আর কখনও লেখা হয়নি। তার মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষা হুতোমের অন্তর্ধানের পর থেকে ক্রমশ উচ্ছন্নে গিয়েছে। বরং উল্টোটাই। যে সময় হুতোম প্যাঁচার নকশা লেখা হচ্ছে, তার খুব কাছাকাছি কালাঙ্কেই লেখা শুরু করছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রায় একই সময় জন্মাচ্ছেন মোগল-উত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন অবশ্য সেই দুধের শিশুকে পাঠক চেনে না, তবে কয়েক দশক পর থেকে তাঁর গদ্য ও পদ্যের অলঙ্কারের ঝঙ্কারে আচ্ছন্ন থাকবে বাঙালি। সম্পূর্ণ অন্য ঘরানায় বাংলা গদ্য লিখছেন তাঁরই জ্যেষ্ঠভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর বিপুল ক্যারিসমা, জ্যোতি ঠিকরোচ্ছে দিগ্বিদিকে। গদ্যরচনায়, বিশেষ করে তাঁর পিয়ের লোতির ভ্রমণবৃত্তান্তের বঙ্গানুবাদ ‘ইংরেজ বর্জিত ভারত’ এক অসামান্য শিল্পকীর্তি। তিনি আর কিছু দিন লেখালিখি চালালে হয়তো বাংলা গদ্যভাষার চলনটাই বদলে যেত।
কিন্তু কথা হল, এঁরা যতই শক্তিশালী হন, নোবেল পেয়ে বাংলার মুখোজ্জ্বল করুন, বাঙালি যতই রবীন্দ্রগান বা ‘লোকহিত’-এ মুখ গুঁজে নিজের অভিব্যক্তি খুঁজে পাক, সমকালীন বঙ্গসমাজের লেখালিখির, অন্তত গোড়ার দিকটা, এক বিদঘুটে জগাখিচুড়ি ভাষায়, যার নাম সাধু ভাষা। সংস্কৃতের হ্যাংওভারে আক্রান্ত সে বস্তু এন্তার তৎসম ঠুসে সম্পূর্ণ কৃত্রিম ভাবে এক তৈরি করা জিনিস, যা বাঙালির মুখের তো নয়ই, বরং রীতিমতো চেষ্টা করে সে ভাষা থেকে চলিত এবং ফার্সি শব্দকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেটা বস্তুত এক সচেতন বা অবচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যেখানে ভাষাকে এক রকম ভাবে তৈরি করা হচ্ছিল ভদ্রলোকের ড্রয়িং রুমের উপযুক্ত করে। প্রকল্পটা রাজনৈতিকই, কারণ এ রকম একেবারে নয় যে, মৌখিক ভাষা বা ফার্সিসমৃদ্ধ চলিত বাংলায় ভাবগাম্ভীর্য বা গীতিমাধুর্য ফোটে না। বরং উল্টোটাই। “কোন অপরাধে, দীর্ঘমেয়াদে, সংসার গারদে থাকিব” জাতীয় পদ লিখতে পারলে গত দেড়শো বছরে যে কোনও গীতিকারই গর্ব বোধ করতেন। কিন্তু লেখেননি বা পারেননি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও সংসারের অসারতা এবং প্রভুর কাছে যাওয়ার আকুলতা নিয়ে বহু গান লিখেছেন। কিন্তু ‘দেখো, প্রভু, চিরদিন আঁখি পরে থেকো জেগে/ তোমারে ঢাকে না যেন সংসারের ঘন মেঘে’ জাতীয় রচনাগুলির ভাষা, যেন ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমার ডিজ়াইনার-ড্রয়িংরুম। গারদ, মেয়াদ, এই জাতীয় শব্দ জল-অচল, ব্যবহার করলে পুলিশে ধরবে।
তা, হুতোম যে অতুলনীয় তার একটা কারণ, ভাষার প্রশ্নে তিনি এই আধা-ব্রাহ্ম আধা-ভিক্টোরীয় ভদ্রলোক প্রকল্পের ঠিক বিপরীত মেরুতে। ব্যঙ্গরচনা আর লেখা হয়নি, তা নয়। বঙ্কিমও লিখেছেন, সে সব আজও বিখ্যাত। কিন্তু তার ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, সুবিখ্যাত ‘বাবু’তে যে ব্যঙ্গচিত্র বঙ্কিম তৈরি করেন, তা তৎসমখচিত চকচকে— “যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু।” উল্টো দিকে হুতোমের ভাষা একেবারেই কথ্য, যেন রকের বুকনি। ওই একই বাবুপ্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, “(বাবুদের) প্রথম দলের সকলি ইংরাজী কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ... টেবিলে খান, কমডে হাগেন”। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, বঙ্কিমের গদ্যের অসম্ভব ধ্বনিমাধুর্য সত্ত্বেও, আম-পাবলিকের কাছে ওই রূপচর্চিত ব্যঙ্গের চেয়ে পরিষ্কার ভাবে চেনা, পরিচিত এবং অব্যর্থ চিত্রকল্পের আবেদন অনেক বেশি।
বলা বাহুল্য, এখানে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের নিন্দেমন্দ করার জন্য এ সব লেখা হচ্ছে না। কারণ বাংলা ভাষার এই ত্রুটিও, যদি ত্রুটিই হয়, চিরস্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেই চলিত ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন। নজরুল ইসলামের মতো প্রতিভাদের উদ্যোগে হইহই করে ফার্সি শব্দকে বাংলা ভাষায় পুনঃপ্রতিস্থাপিত করা হয়। আরও কয়েক দশকের মধ্যেই, জীবনানন্দোত্তর যুগের তরুণরা বস্তুত সংস্কৃত প্রাধান্যকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ বা যুবক-যুবতীরা বা আরও পরের ‘হাংরি’ জাতীয় আন্দোলন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস বাদ থেকে যায় যে, এঁরা নির্দ্বিধায় এবং নিঃসঙ্কোচে ভাবগম্ভীর তৎসম শব্দের সঙ্গে দুচ্ছাই মৌখিক ভাষাকে পাশাপাশি বসিয়ে দিতেন, যা হুতোমোত্তর যুগে আর হয়নি। এও এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে, বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দাস নয়। সংস্কৃতে গুরুচণ্ডালী একটা দোষ, কিন্তু বাংলায় ‘দুগ্ধফেননিভ তুষারশুভ্র পালকশয্যায় ধপ করে শুয়ে পড়লাম’ জাতীয় বাক্য ভরপুর জায়েজ। সেটা দুর্বলতা নয়, বাংলা ভাষার শক্তি।
কিন্তু এত কিছুর পরেও যে গত দেড়শো বছরে নতুন হুতোমের জন্ম হল না, তার কারণ হুতোম স্রেফ ভাষা-কারিকুরি নয়, হুতোম আসলে একটা দেখবার পদ্ধতি— বা দেখার পদ্ধতি। ওই নকশা বস্তুত নিজের ছবি, যেখানে চার পাশের উদ্ভট ব্যাকগ্রাউন্ডে নিজের কার্টুনপ্রতিমাকে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে। এই আত্মপ্রতিকৃতি তো শুধু আঁকার কৌশল নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি করে, দেখার প্রকরণ। বিগত একটা আস্ত শতক ধরে বাঙালি এই দেখার প্রকরণটুকুকে হারিয়ে ফেলেছে। এ কথার মানে এই নয় যে, নিজেকে খুঁটিয়ে দেখা হয়নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে লেখাগুলির উদাহরণ দেওয়া হল, তা এক প্রকারের আত্মদর্পণই। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, লেখার ভঙ্গির প্রশ্নে পাড়ার মাংসবিক্রেতার সঙ্গে তাঁর বিশেষ তফাত নেই। একটাই পার্থক্য, ঝোলানো পাঁঠার বদলে সেখানে ঝুলে থাকে নিজের জীবন, আর তিনি কেটে কেটে খদ্দেরদের বিলি করেন। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ক্ষেত্রেও খুব কাছাকাছি কথাই বলা যায়। এ সবই খুব মহৎ সাহিত্য। কিন্তু এঁদের সঙ্গে হুতোমের একটা তফাত বিরাট। হুতোম শুধু আত্মবীক্ষণ নয়, সমাজের প্রেক্ষিতে নিজেকে দেখা। সবাই সেখানে কার্টুন। লেখক নিজেও। গোটা সমাজই এক কমিক স্ট্রিপ, “আমি কারেও লক্ষ্য করি না, অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমন কি, স্বয়ংও নক্সার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।” সেই কারণেই হুতোমের ফক্কুড়ি বা ভাষা কোনও স্টাইল স্টেটমেন্ট নয়। তিনি গোটা সমসময়কে দেখেন। দেখেন নৈর্ব্যক্তিকতায়। সেখান থেকে স্যুট-কোট-টাই পেয়ালা-পিরিচ-বাবুয়ানি সবই অলীক লাগে। তার পর এই কার্টুনের ফিল্মি সেটে সং সেজে হুতোম নিজে মহাসমারোহে অবতীর্ণ হয়ে যান। তাতে তৈরি হয় যে কম্পোজ়িশন, সে শুধুই ইয়ার্কি নয়, শুধুই আত্মধ্বংসী মজা নয়, বরং গোটা সমাজের অলীকত্বকে খুঁটিয়ে দেখার এক প্রকৌশল।
বাঙালি, গত দেড়শো বছরে এই প্রকৌশলকে বেমালুম হারিয়ে ফেলেছে। বিষয় কিছু কম পড়েছে বা বদলে গিয়েছে তা নয়, বরং বেড়েই চলেছে। আজও ভদ্রজন টিভির পর্দায় তারস্বরে নাগাড়ে খেউড় করেন এবং সেটাকে তাঁরা রাজনৈতিক বিতর্ক বলেন। না হলেও তিরিশ বছর ধরে চলছে টিভি সিরিয়ালের রঙ্গ-ঢঙ্গ সং সাজা। আজও বাবু ও বিবিরা বাংলা বলতে হীনম্মন্যতায় ভুগে ক্রমাগত ব্যবহার করে যাচ্ছেন, “আই কান্ট গো দেয়ার, ফিলিং হাঁটু ব্যথা” জাতীয় বাক্যবন্ধ। কিন্তু সে সব নিয়ে রঙ্গ অনুপস্থিত। দেখার ভঙ্গিটাই গরহাজির। এ ঠিক আজকের ব্যাপারও না। গত একশো বছরে বিরাটাকার জাদু-বাস্তবতা বাঙালি জীবনে কম পড়েনি। আজ থেকে বছর সত্তর আগে ঘটে গিয়েছে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে অলীক ব্যাপার, দেশভাগ। তা নিয়ে অশ্রুজল, সঙ্গত কারণেই কম ঝরেনি। কিন্তু তার অলীকত্বটুকুকে চোখে আঙুল দিয়ে কেউ লেখেননি, “কলকেতায় এসে মোল্লা পিটিয়ে বাবু বল্লেন, হিন্দুরাজত্ব চাই, হুড়মুড়িয়ে পেয়াদা লাগিয়ে জমির উপর লাইন-টেনে, কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, দেশভাগ হল। হিন্দু বাঙালির নাক কেটে, ঘর ভঙ্গ করে, বাবু মনের আনন্দে পাঁটার মাংস সাঁটিয়ে বিধানসভায় বক্তৃতা করতে লাগলেন।” এ এক বীভৎস, নৃশংস গল্প, কুশীলবদের কার্টুনে পরিণত না করলে উপস্থাপনা অসম্ভব। দেশভাগ নিয়ে দিস্তে দিস্তে লেখা হয়েছে, কিন্তু হুতোমীয় দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে এই প্রায়-অলীক কিন্তু ঘোর-বাস্তব বীভৎসতা রাজনৈতিক প্রতর্ক থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদনের রমরমা।
একই ভাবে হারিয়ে গিয়েছে নানা সাম্প্রতিক ঘটনাও। আশির দশকে ধূপ-ধুনো জ্বেলে টিভিতে রামায়ণ দেখা, নব্বইয়ের গণেশের দুধ খাওয়ার হুজুগ, একবিংশ শতকে কুকুর তাড়াতে দরজার বাইরে নীল জলের বোতল ঝোলানোর হিড়িক। এ সব সামান্য জিনিস নয়। এক প্রান্তিক বিভক্ত জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার অদ্ভুত জাদুর অংশ। যেখানে সব্বাই কার্টুন। যিনি বর্ণনা করছেন তিনিও। লাতিন আমেরিকা হলে এ নিয়ে মায়াগদ্য লেখা হয়ে যেত, কিন্তু বাংলায় তেমন হেলদোল নেই। কারণ, এখানে হুতোম আর লিখতে বসেন না। আধা-ভার্চুয়াল এই পৃথিবীতে সং-সাজা আত্মপ্রতিকৃতির আর তত মূল্যও নেই অবশ্য। কারণ পৃথিবীতে এখন এসে গিয়েছে
সেলফি যুগ। সেই ছবিতে ত্বক হয় মোলায়েম, মুখ হয় উজ্জ্বল, সমাজমাধ্যমে মেলে পিঠচাপড়ানি ও আদরবাসা। এখন ভ্যান গখ আত্মপ্রতিকৃতি আঁকলেও লোকে বলত, মুখে অমন দাগ কেন? ক্যামেরাটা ভাল না? এই বিদঘুটে প্রশ্নকে নিয়েও খিল্লি করতে পারবেন, সে রকম ডিজিটাল হুতোম আজও, সম্ভবত জন্ম নেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy