হিজাব ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অংশ নয়, তাই স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের অধিকার রয়েছে ড্রেস কোড বেঁধে দেওয়ার। কর্নাটক হাই কোর্টের এই রায় শুনে কিছু ছাত্রী ঘোষণা করেছেন, তাঁরা কলেজের পড়া ছাড়বেন, কিন্তু হিজাব ছাড়বেন না। এই সিদ্ধান্তে যদি শেষ পর্যন্ত অটল থাকেন মুসলিম মেয়েরা, সেটা হবে ভয়ানক পরাজয়। কারণ, হিন্দুত্ববাদী দলটার উদ্দেশ্য যে তা-ই। কলেজের বাইরে এক দল উত্তেজিত তরুণ যখন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে হিজাবের বিরোধিতা করেন, তখন তা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিধি লঙ্ঘনের সমস্যা বলে মনে হয় না।
হিজাব পরে স্কুল-কলেজ যাওয়া উচিত কি না, এটা একটা অভিসন্ধিমূলক প্রশ্ন। গেরুয়াবাহিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার অজুহাত তৈরি করেছে হিজাবকে কেন্দ্র করে। হিজাব-বিদ্বেষ কর্নাটক থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য কিছু রাজ্যেও। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হিজাব-পরা স্বাস্থ্যকর্মীকেও অফিসে ঢুকতে বাধা পেতে হয়েছে। আসলে আমরা অনেকেই উস্কানিমূলক রাজনীতির উদ্দেশ্য ধরতে না পেরে ফাঁদে পা দিচ্ছি। হিজাব আর হিজাব বর্জন, নির্বাচন আর চাপিয়ে দেওয়া, সঙ্কীর্ণতা আর উদারতার তত্ত্ব ঘেঁটে কাহিল হচ্ছি। হিজাব ভাল না মন্দ, সেই আলোচনা অবশ্যই হবে, কিন্তু এই পোশাককে চর্চায় আনা যাদের প্রয়োজন হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যও ঠিকমতো বুঝে নিতে না পারলে মেরুকরণের জালেই আমরা আটকে থাকব।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবক্তাদের নাকি সদিচ্ছা ‘মুসলিম বোন-কন্যা’দের ক্ষমতায়ন। তাই মুসলিম মেয়েদের বিভিন্ন ‘সমস্যা’ সামনে রেখে জনমানসকে উত্তাল করার সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি ও কেন্দ্রের শাসক দল। যার প্রথম ধাপ ১ অগস্ট, ২০১৯, তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করে আইন তৈরি করা। ১ অগস্ট মুসলিম নারী অধিকার দিবস পালন করাও শুরু হয়েছে। ভারতের গণতন্ত্রে মুসলিম মেয়েদের প্রতি ন্যায়বিচারের এটা নাকি একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ন্যায়বিচার না মিথ্যা প্রচার, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। তাৎক্ষণিক তালাক দেওয়ার অপরাধে স্বামীকে কারাগারে পাঠানোর আইন মজবুত। কিন্তু সেই স্ত্রী এবং তাঁর সন্তানদের অন্ন-বস্ত্রের সুরাহা হওয়ার আইন দুর্বল, অস্বচ্ছ।
এই বছরের শুরুতেই দেখা গেল ‘বুল্লি বাই’ নামের একটি অ্যাপ-এ মুসলিম মেয়েদের নিলামে তোলা হচ্ছে। নিলামে তোলা এই মেয়েরা শিক্ষিত, লড়াকু, প্রতিবাদী, প্রতিষ্ঠিত। এঁদের মধ্যে কিছু মেয়ের সরকারি নীতির বিরোধিতার ইতিহাস রয়েছে। তার আগে ‘সুল্লি ডিলস’ অ্যাপ তৈরি করেও মুসলিম মেয়েদের নিলামে তোলা হয়েছিল। মুসলিম মেয়েরা রাষ্ট্রের গতিবিধি নিয়ে প্রশ্ন করবে? সংগ্রামে, আন্দোলনে সক্রিয় হবে? এমন স্পর্ধা দেখলে সমঝে দেওয়া দরকার। ‘বুল্লি বাই’ অ্যাপের কারিগর যুবক ধরা পড়লেও অনুতপ্ত হননি, মুসলিম বিদ্বেষের বাতাবরণে তিনি এতটাই সংক্রমিত। দেশের সরকার মুসলিম মেয়েদের ক্ষমতায়নে এমন তৎপর যে, তাদেরকে নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় আক্রান্ত হতে হচ্ছে। এর পরেও কি সরকার ও শাসক দলের ষড়যন্ত্রের কৌশল স্পষ্ট হয়ে ওঠে না?
স্কুলে ইউনিফর্ম থাকে, কলেজে সাধারণত থাকে না। হয়তো ‘ড্রেস কোড’ থাকতে পারে, তবে তা পূর্বেই ঘোষণা করা দরকার। হিজাব-পরা ছাত্রী ভর্তি করার পর পোশাকবিধির অজুহাতে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। মুসলিম মেয়েদের ক্ষমতায়নের সদিচ্ছা থাকলে সব সমস্যা কাটিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা রাখতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখছি, বোরখা-হিজাব পরা ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। মানে মুসলিম মেয়েরা আগের তুলনায় বেশি পড়তে আসছে কলেজে। এই পোশাকের শর্তেই হয়তো তারা পড়তে আসার অনুমতি পেয়েছে। কলেজে হিজাব পরে ঢোকা যাবে না, এমন ফতোয়া হঠাৎ জারি হলে আমার ছাত্রীদের কিছু অংশের কলেজ আসা বন্ধ হবে, এটা অবধারিত। শিক্ষা বন্ধ হলে কাজ পাওয়ার লড়াইটা আরও কঠিন।
হিজাব আর শিক্ষার লড়াইয়ে কোনটা বেছে নেবে মেয়েরা? প্রশ্নটা বড় জটিল। কারণ যতই হিজাবকে মেয়েরা আমার ‘চয়েস’ বলুক, তাদের ‘চয়েস’টা তো অনেকটা পিতৃতন্ত্রেরও নির্মাণ। হিন্দুত্ববাদী পিতৃতন্ত্রের আঘাতে মুসলিম মেয়েদের ‘হিজাব চয়েস’ বাড়ছে। আগে হিজাব পরতেন না, এমন মেয়েরাও হিজাব পরে রাস্তার প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন হিজাবের পক্ষে। আর মুসলিম পিতৃতন্ত্রের ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে এই পোশাকটা যেন মেয়েদের ‘চয়েস’। তারা এই ‘চয়েস’কে মান্যতা দিচ্ছে। যেন এ ভাবে হিজাব না পরে হট প্যান্ট, জিনস বা ফ্রক পরলেও তারা মেনে নেবে। দুই পিতৃতন্ত্রের ইচ্ছে-খুশির নিয়ন্ত্রণে এ দেশের মুসলিম মেয়েদের অবস্থান। হিজাব ছাড়ো আর হিজাব পরো— এই টানাটানির মাঝে তারা আটকে পড়েছে। কিছু মেয়ে হিজাব বিতর্কের পর থেকে ‘হিজাব আমার চয়েস’ জানিয়ে মুসলিম পিতৃতন্ত্রকেই শক্তিশালী করছেন। কর্নাটকের কিছু ছাত্রী বলেছেন, ধর্মবিধি অনুযায়ী মেয়েদের চুল ঢেকে রাখতে হয় বলেই হিজাব পরা উচিত। হয়তো সে জন্যই তাঁরা মনে করছেন, পড়া ছাড়বেন কিন্তু হিজাব ছাড়বেন না। কিন্তু কেন মেয়েদের চুল ঢেকে রাখতে হবে, এই প্রশ্ন করতে শেখার জন্যই যে তাঁদের আধুনিক শিক্ষা দরকার।
বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy