Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গোলমেলে অঙ্কে জেরবার
Russia Ukraine War

আম ও ছালা, দুই-ই কি হাতছাড়া হওয়ার জোগাড় ভারতের

অদূর ভবিষ্যতে চিন-রাশিয়া অক্ষ এতটাই সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছে, যা আগে কখনও দেখেনি আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চ।

অক্ষ: গত মাসে বেজিংয়ে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (বাম দিকে)।

অক্ষ: গত মাসে বেজিংয়ে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (বাম দিকে)। পিটিআই

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২২ ০৫:১৬
Share: Save:

পরশুরাম প্রণীত ‘প্রেমচক্র’ গল্পটির থেকে মাধুর্য সরিয়ে যদি শুধু তার জটিলতাটুকু রাখা যায়, যেখানে “জারিত চায় জমিতাকে, অথচ জমিতার টান লারিতের ওপর। আবার লারিত ভালবাসে তমিতাকে, কিন্তু তমিতার হৃদয় হারিতের প্রতি ধাবমান...।” যে গল্পের এক চরিত্র বঙ্কা বলেছিল, “ভয়ংকর গোলমেলে প্লট, মনে রাখা শক্ত।”

এ বার বর্তমান প্লটে আসি। রাশিয়া ভালবাসত ভারতকে। তবে রাশিয়ার আপৎকালীন ভালবাসা চিনের প্রতি! অথচ চিনের সীমান্ত শত্রু ভারত। ভারতের নির্ভরতা ঘুরে ফিরে সেই রাশিয়ার উপর। অথচ রাশিয়া এই মুহূর্তে আমেরিকার পরম শত্রু। আমেরিকা আবার নির্দিষ্ট কারণে ভারতকে চায়। ভারতেরও আমেরিকা বিনা গীত নেই! অথচ রাশিয়ার যে কোনও বন্ধু, আমেরিকার চক্ষুশূল।

প্লট বড়ই গোলমেলে বঙ্কা! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উত্তরোত্তর সেই জটিলতা আরও বাড়ারই আশঙ্কা, অন্যান্য দেশের পাশাপাশি ভারতেরও কিছু কম নয়। ওই প্রেমচক্রের উদাহরণ নিয়েই বলা যাক যে, একান্তই কাছাখোলা না হলে সকলেই বোঝেন, স্বার্থ বিনা কেউ কাউকে ভালবাসেন না। কোনও প্রেম নিকষিত হেম নয়। যে কোনও সম্পর্কই দেনা-পাওনার পোক্ত হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তত কূটনীতিতে।

ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার আগ্রাসনের কার্য-কারণ-বিধেয় যা-ই থাক না কেন, তার জেরে বিশ্ব পরিস্থিতি এখন প্রবল জটিল। এত দিন মোটামুটি ভাবে ঠেকনা দিয়ে চলা প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিদেশনীতি এবং অর্থনীতিও অতিকায় বুলডোজ়ারের মুখে পড়েছে। ইউক্রেন থেকে শেষ ভারতীয় নাগরিকটির নিরাপদে ফিরে আসা নিয়ে রাজনৈতিক প্রচার নিঃসন্দেহে শুরু করবে বিজেপি। যে কোনও ক্ষমতাসীন দলই তা করত। তাতে ন্যায্য ভাবেই বহু মানুষের আশীর্বাদ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু শুধু মাত্র তেইশ হাজার ভারতীয় ছাত্র এবং অন্যান্য নাগরিককে ফিরিয়ে আনলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে না, সে কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চেয়ে ভাল এখন আর কে জানেন?

কিন্তু এ কথা যুদ্ধের বোমাবর্ষণের মতোই প্রকট ও বিকট, ভবিষ্যতের ভূ-রাজনীতি ওলটপালটের নাদ। যুদ্ধের নির্ঘোষেও চাপা পড়ছে না পশ্চিম বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সেতু ভেঙে পড়ার শব্দ। রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত সমুদ্র তলদেশ দিয়ে সংযুক্ত দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমের মধ্য দিয়ে সরবরাহ বন্ধ হওয়া সময়ের অপেক্ষামাত্র। এই পাইপলাইনটি শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপের অনেক দেশেরই জ্বালানি তৃষ্ণা নিবারণের অন্যতম উপায়। রাশিয়ার ইউরোপের উপর প্রভাব খাটানোর হাতিয়ারও। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সংঘাত যত বাড়বে, শক্তিক্ষেত্রেও বিশ্ব-সমীকরণের উলটপালট হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। ভারত সেই উথালপাথালের বাইরে থাকতে পারে না আজকের বিশ্বে।

রাশিয়ার আগ্রাসন বিষয়ক জরুরি ভিত্তিতে ডাকা রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনের সাম্প্রতিক ভোটাভুটিতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আমেরিকা-সহ গোটা পশ্চিম আজ একঘরে করে দিয়েছে রাশিয়াকে। কিন্তু সত্যিই কি তা সম্ভব? কারণ রাশিয়ার এই কোণঠাসা পরিস্থিতিতেও তো তাদের সঙ্গে রয়েছে মহাশক্তিধর চিন।

এখানেই ভারতের উদ্বেগের প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের ভারসাম্যের কূটনীতি এখনও পর্যন্ত মস্কো ছাড়া কাউকে খুশি করেনি। পশ্চিমকে তো নয়ই। কিন্তু সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভাল— সেই ‘খুশি’ এতটা নয় যে, এর পর ভারতের কথায় রাশিয়া উঠবে-বসবে। সাউথ ব্লকের তর্জনীহেলনে চিন-নীতি নিয়ন্ত্রিত হবে। না আদৌ তা ঘটবে না। বরং পশ্চিমের সঙ্গে ভবিষ্যতের অনন্ত যুদ্ধপথে চিনকে সঙ্গে রাখা ছাড়া এক পা-ও আর এগোনো সম্ভব নয় মস্কোর। এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার চিনের উপর নির্ভরশীলতা আসলে যে অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে, এই পাঁচনসম সত্য গলাধঃকরণ করতে মোদী সরকারের সমস্যা তো হচ্ছেই। এ কথা মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগাম তূর্যনিনাদ যখন শোনা যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই এক মহাবৈঠকে বসেছিলেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, দু’-দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের কোনও সীমারেখা নেই, এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যা কিনা সহযোগিতার জন্য নিষিদ্ধ। চিন এবং রাশিয়ার নতুন এই সম্পর্ক নাকি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যে কোনও সামরিক এবং রাজনৈতিক জোটের চাইতে ঢের বেশি উন্নত। সুধী পাঠক, যুদ্ধের প্রাক্কালে এই নতুন চিন-রাশিয়া চিত্রনাট্যে কি প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বর মিশে ছিল না?

ভারতকে আগামী দিনে দু’টির মধ্যে যে কোনও একটি রাস্তায় হাঁটতে হবে। এক, কারও নাম না করে ভৌগোলিক অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা এবং হিংসার নিন্দা করা। সেই সঙ্গে কূটনীতির রাস্তায় ফেরার আবেদন করে যাওয়া।
যা তারা করেই চলেছে। অন্যটি হল, আমেরিকা এবং পশ্চিমের পক্ষ নিয়ে খোলাখুলি রাশিয়ার এই আগ্রাসন নীতির প্রবল সমালোচনা করা, রাষ্ট্রপুঞ্জের ভোটাভুটিতে নির্দিষ্ট পক্ষ নেওয়া, তথাকথিত এই ভারসাম্যের নীতি থেকে সরে আসা। আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ইউক্রেন যা করার জন্য বার বার ভারতকে আবেদন করেছে।

এখনও পর্যন্ত ভারতকে এই
রাশিয়া-বিরোধিতার রাস্তায় না হাঁটার জন্য কোনও দণ্ড দিতে হয়নি। চতুর্দেশীয় অক্ষ বা কোয়াড, তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সহযোগিতা মঞ্চে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে আমরা দেখিনি। সম্প্রতি জরুরি ভিত্তিতে কোয়াডের বৈঠক ডেকে আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের শীর্ষনেতারা সমুদ্রপথের সহযোগিতা (চিন-বিরোধিতা) নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, কোয়াডে চিড় ধরে গিয়েছে। ভবিষ্যতে তা বড় ফাটলে পরিণত হতে পারে।

অদূর ভবিষ্যতে চিন-রাশিয়া অক্ষ এতটাই সুদৃঢ় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠতে চলেছে, যা আগে কখনও দেখেনি আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চ। মস্কোর বিদেশনীতি (এবং ভারতনীতিও) এর পর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করবে বেজিং। পশ্চিমের এবং আমেরিকার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচতে, মস্কোরও অনেক ক্ষেত্রে চিনের হাতে ‘মাত্রিয়োশকা ডল’ হয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তরও দেখা যাচ্ছে না। সহজ কথায়, এর পর পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করা সংক্রান্ত ভারতের অনুরোধ মানার কোনও কারণ থাকবে না মস্কোর। যা নয়াদিল্লির জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত আশঙ্কার। এই বিষয়টিও হয়তো কাকতালীয় নয় যে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দিনই মস্কোতে হাজির ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমরান খান। বৈঠক করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে।

শুধু পাকিস্তানই নয়। চিন-রাশিয়ার শক্তিশালী জোট, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলির উন্নয়নশালী প্রকল্প এবং শক্তি চাহিদাকে কব্জা করার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে একটি পরমাণু কারখানা বসাতে বাংলাদেশকে সাহায্য করছে রাশিয়া। যে মডেলটি এই অঞ্চলে চিন তৈরি করেছে অনেকটা সেই পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ বাংলাদেশকে সহজ সুদে ঋণ দিয়ে। এর পর যে জ্বালানি তারা ইউরোপকে দিচ্ছিল, তার একটা বড় অংশ চলে আসবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। এই সামগ্রিক অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে তাদের যে স্বাভাবিক অর্ধ শতকের সহযোগিতা ছিল তা আর আগের মতো থাকবে না। মস্কোর বিরুদ্ধাচরণ না করার পরও রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে অস্ত্র কেনার বিষয়টি এখনও গলা পর্যন্ত জলে। আমেরিকা এ বিষয়ে তাদের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা থেকে আর ছাড় দেবে না নয়াদিল্লিকে। ফলে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে চলতি প্রবাদে বলা হচ্ছে, আম এবং ছালা উভয়ই হাতছাড়া হওয়ার জোগাড়!

প্রথমেই যা বলা হচ্ছিল আর কি! এই বিশ্ব পরিস্থিতিতে কে যে কার মন পাবে, সেই চক্র বড়ই জটিল। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতের কাছে এখনও তার কূলকিনারা নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Russia Ukraine War
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy