বহু বছর পর নিঃশব্দ ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মতো তাঁরও কি এক বিকেলে বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ দেখতে যাওয়ার কথা মনে পড়েছিল?
বিকেল নয়, মেক্সিকোয় তখন দুপুর। বাবার শরীর ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপতর জেনে এক ছেলে সপরিবারে আমেরিকা থেকে, আর এক জন ফ্রান্স থেকে উড়ে এসেছেন। গত কয়েক মাস ধরে এ ভাবেই তাঁদের যাতায়াত চলছে। বাবা অ্যালঝাইমার্স-এ আক্রান্ত, মায়ের ক্যানসার।
পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা চলছে, বড় ছেলে রডরিগো দোতলায় গেলেন। ওখানেই একটা ঘরকে প্রায় হাসপাতাল বানিয়ে তাঁর বাবাকে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের মতো ওঠানো-নামানো সম্ভব, এমন ‘ফাওলার্স বেড’, সকাল-সন্ধ্যা ডাক্তার আর নার্স। তাঁর বাবার দীর্ঘকালের সেক্রেটারিও আসেন, অনেক চিঠিপত্রের উত্তর দিতে হয়। রডরিগো দেখলেন, কাচের দরজার আড়াল থেকে বাবার সেক্রেটারি ও নার্স তাঁকে ইশারায় ডাকছেন। কোনও হইচই ছাড়াই তাঁরা যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চান। কাচের দরজা ঠেলে রডরিগো ঘরে ঢুকলেন। নার্স জানালেন, “ওঁর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
অতঃপর দ্বিপ্রাহরিক আড্ডার মাঝপথেই সবাই দোতলায় ছুটে এসেছে। নার্স মৃতের মুখে তোয়ালে জড়িয়ে চোয়াল বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। ৫৭ বছরের দাম্পত্যের শেষে সে-দিন মা নার্সদের নির্দেশ দিলেন, “হচ্ছে না। আরও ভাল ভাবে জড়িয়ে দাও।” তার পরই বাঁধ ভাঙল। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেদের বললেন, “কেমন বাচ্চাদের মতো লাগছে, দেখ।”
রডরিগো এটা জানতেন। অসুস্থ, স্মৃতিহীন বাবার ঘরে এক দিন ঢুকতে গিয়ে তাঁরও মনে হয়েছিল, মানুষটা আকারে কেমন যেন ছোট হয়ে গিয়েছেন। নোবেলজয়ী লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ় এখন শুধু তাঁর বাবা নন, সন্তানের মতো। চেনা লোকের সান্নিধ্যে বাবার এখনও ভাল লাগে, কিন্তু কারও নাম মনে রাখতে পারেন না। এক দিন মাকে দেখিয়ে সটান জিজ্ঞেস করলেন, “এই ভদ্রমহিলা কে? আমাকে এত বিরক্ত করে কেন?” ইনিই যে তাঁর ছেলেবেলার প্রেমিকা ও বিবাহিত স্ত্রী মার্সিডিজ় বাচা, শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা উপন্যাসের লেখকের সেটিও আর মনে পড়ে না। ওই উপন্যাসেই তো তিনি ভুলে-যাওয়া রোগের মহামারির কথা লিখেছিলেন। সেই মহামারি এমনই যে, মাকোন্দো গ্রামের লোকজনকে লিখে রাখতে হত, ইহা গরু; দুইলে দুধ দেয়; সেই দুধ থেকে ছানা ও দই তৈরি হয়।
স্মৃতির বিভ্রম কি শুধু স্ত্রীকে নিয়ে? এক বিকেলে বাগানে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারিকে বললেন, “বাড়ি যাব। এটা আমার বাড়ি নয়। বাড়িতে বাবার পাশে শুয়ে থাকি, জানো?” সেক্রেটারি বুঝে গেলেন, দাদুর কথা বলছেন লেখক। তাঁর সেই কর্নেল দাদু, যাঁকে ছেড়ে আট বছর বয়সে মামাবাড়ি থেকে চলে আসার পর আর দেখা হয়নি। কিন্তু শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা থেকে কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না-র মতো উপন্যাসে যাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সেই গার্সিয়া মার্কেজ় এখন বাবা আর দাদুতে গুলিয়ে ফেলেন।
কয়েক বছর আগেই অসুখটা ধরা পড়েছিল। তাঁর স্মৃতি ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে। সারাক্ষণই প্রবল উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় দিন কাটাতেন। এক দিন ফুঁপিয়ে উঠেছিলেন, “আমার কিছু মনে পড়ে না। আমি লেখক, স্মৃতিই আমার যন্ত্র বলো, কাঁচামাল বলো, সব। আমাকে বাঁচাও।” একই কথা সারা দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছিলেন। কিছু দিন বাদে অবস্থা একটু সহনীয় হল। লেখক তখন আর কে তুমি, কী নাম ইত্যাদি প্রশ্ন করেন না। “আজকের দিনটা বেশ সুন্দর, না? বৃষ্টি হবে?” এই সব নামহীন ভাববাচ্যে নিজের অসুস্থতা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানেও শেষরক্ষা হল না। কথোপকথনের মাঝখানেই কোথায় যেন আপন মনে তলিয়ে যেতেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে বললেন, “এখানে কেন? বাড়ি যাব।” সবাই বোঝাল, তুমি বাড়িতেই এখন। দিন দুয়েক পর শান্ত হলেন।
চূড়ান্ত দিনটা ছিল ১৭ এপ্রিল ২০১৪। গুড ফ্রাইডের আগের দিন, বৃহস্পতিবার। তাঁর শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা উপন্যাসের অন্যতম নায়িকা উরসুলা এমন দিনেই মারা গিয়েছিল। রডরিগো আর তাঁর ভাই গনজালো দেখলেন, কান্নার শেষে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের ক্যানসার-আক্রান্ত মা বারান্দায় বসে সিগারেট ধরালেন।
এ ভাবেই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রডরিগো গার্সিয়া তাঁর সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ আ ফেয়ারওয়েল টু গাবো অ্যান্ড মার্সিডিজ় (হার্পারকলিন্স, ২০২১) বইতে জানিয়েছেন তাঁর মা-বাবার শেষ দিনগুলির স্মৃতি। বাংলায় বিখ্যাত বাবাকে নিয়ে রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতি বা তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালিখি আছে। কিন্তু এই ক্ষীণকায় বইটির স্বাদ অন্য। ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল গার্সিয়া মার্কেজ় নিউমোনিয়া নিয়ে মেক্সিকোর হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮৭ বছরের নিউমোনিয়া আক্রান্ত অ্যালঝাইমার্স রোগীকে বেশি দিন ভুগতে হয়নি। দু’সপ্তাহ পরে বৃহস্পতিবারই সব শেষ!
লক্ষ্মীবারটাই কি এই বিশ্বখ্যাত দাম্পত্যের জলবিভাজিকা? ছেলের স্মৃতিচারণ পড়তে পড়তে মনে পড়ল বাবার আত্মজীবনী লিভিং টু টেল দ্য টেল-এর শেষটা। কলম্বিয়া থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে ইউরোপগামী উড়ান ধরেছেন তরুণ সাংবাদিক। মার্সিডিজ় বাচা তাঁর প্রেমের প্রস্তাবে তখনও নীরব। উড়ানেই চার-পাঁচ লাইনের চিঠি লিখলেন লেখক। শেষে পুনশ্চ— “এক মাসের মধ্যে উত্তর না পেলে ইউরোপেই থেকে যাব। দেশে ফিরব না।” এক মাস অপেক্ষা করতে হয়নি, জেনিভার হোটেলে চেক ইন করতে গিয়েই তিনি পেয়ে গেলেন সেই মেয়ের চিঠি। সেটাও ছিল বৃহস্পতিবার।
কিন্তু এ সব তো ১৯৫৬-৫৭ সালের কথা। তার পর? গত বছরের অগস্ট মাসেই মেক্সিকো থেকে মার্সিডিজ় আমেরিকাবাসী ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন, এই অতিমারিটা কবে শেষ হবে বলো তো! তার কয়েক দিন বাদেই মৃত্যু। অ্যালঝাইমার্স থেকে করোনাকাল, স্মৃতিভ্রংশী বার্ধক্য সবই হাজির এই বইয়ে। রডরিগো বাবাকে জানান, তিনি এ বার আমেরিকা ফিরছেন। কাজে যোগ দিতে হবে। ছেলেকে চিনতে না পেরেও অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক-এর লেখক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বিড়বিড় করেন, “যেতে হবে? কেন, এখানে থাকলে হয় না?” আর এক জায়গায় রডরিগো জানান, বাবার পাণ্ডুলিপি ও কাগজপত্র মা বেঁচে থাকতে থাকতেই তাঁরা টেক্সাসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বা তাঁর ভাই, কেউই আর মেক্সিকোয় ফিরবেন না। ফলে মা-বাবার স্মৃতিজড়িত বাড়িটাকে মিউজ়িয়াম করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এখানেই নোবেল পরিবারের বাইরে এসে এই বই আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেও স্পর্শ করে যায়।
এই বই নিয়ে তাঁর দোটানার কথাও খোলাখুলি জানিয়েছেন রডরিগো। মা-বাবার অসুস্থতা কি হাটে আনা উচিত? পরে বাবার কথাই মনে হয়েছে। গার্সিয়া মার্কেজ়ের ভক্তরা জানেন, লেখক বহু বার বলেছিলেন, পরিচিতদের শোকযাত্রায় তিনি যান না। কেননা, জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে যতই প্রাণবন্ত করুন না কেন, নিজের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তো অধরাই থেকে যাবে। বিষণ্ণতা নয়, এ যেন প্রয়াত পিতার সঙ্গে পুত্রের কথোপকথন।
এই নীরব কথাবার্তায় মায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি। লেখকের মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভা। কলম্বিয়া ও মেক্সিকো, দুই দেশের প্রেসিডেন্টই মঞ্চে আছেন। তাঁরা যথারীতি ভাল ভাল কথা বললেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট জানালেন, বিধবা স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারবর্গের প্রতি দেশের সমবেদনা রইল। মার্সিডিজ় বাড়ি ফিরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন, “বিধবা-টিধবা কী বলছিল রে? আমি এখনও তিনটে বিয়ে করতে পারি।”
বিশ্বখ্যাত বাবার দৈনন্দিন রুটিনের কথাও জানিয়েছেন ছেলে। সকাল ৯টা থেকে স্টাডিতে, তখন কাউকে চিনতে পারেন না। মা প্রয়োজনে চিরকুট পাঠান, সেটা বাবাকে দিয়ে আসতে হয়। দুপুর তিনটেয় বাবা লাঞ্চে আসেন, তখন গল্পগুজব হয়। তার পর বৈকালিক নিদ্রা। বলতেন, “ডেকে দিয়ো।” ছেলেবেলায় দু’চার বার ডাকতে গিয়ে কেলোর কীর্তি। বাবা আঁ আঁ করে চেঁচিয়ে উঠছেন। দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি। ২০০৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে লেখক বলেছিলেন, “মাঝরাতে আর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি না। কিন্তু আজকাল আইডিয়াও আর আসে না।” ওটিই তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার!
তার পর? সে দিন রাস্তায় প্রবল ভিড়, গাড়িঘোড়া অন্য রাস্তায় ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটু বাদে চুল্লিতে ঢুকবে বাবার নশ্বর দেহ। রডরিগোর মনে হল, শ্বাস পড়ছে। কোথায়? এ তো তাঁর নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস। মরদেহ চাকা লাগানো গাড়িতে চলল অগ্নিশয্যায়। কিন্তু বিপত্তি! বাকি শরীরটা ঢুকে গেলেও মাথা আর কাঁধ হঠাৎ আটকে গেল। চুল্লির কর্মীরা ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিলেন। এই সমস্যায় তাঁরা অভ্যস্ত।
বহ্নিমান চিতাতেই কি সব শেষ? সব কাজ চুকিয়ে রডরিগো ফিরছেন। গত তিন সপ্তাহে এ ভাবেই তাঁকে আট বার মেক্সিকো-লস অ্যাঞ্জেলেস করতে হয়েছে। উড়ান ক্রমে দশ হাজার ফুট উচ্চতায়। রডরিগো দেখলেন, তাঁর পাশের মহিলা ফোনে শতবর্ষের নির্জনতা পড়ছেন।
স্রষ্টা থাকেন না, সৃষ্টি রয়ে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy