অতিথি: চিনে রিকশায় রবীন্দ্রনাথ, ১৯২৪। বিশ্বভারতী-র সৌজন্যে।
১৯২৪-এর ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ মে। এক বসন্তে অতিথি হয়ে রবীন্দ্রনাথ চিনে কাটিয়েছিলেন ব্যস্ত ঊনপঞ্চাশটি দিন। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ চিনে গিয়েছিলেন। চিনে বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আরব্যরজনী’ পড়ে তাঁর প্রথম এক ‘রোম্যান্টিক’ চিনকে জানা।
রাণু অধিকারীকে লেখা কিছু চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের প্রসঙ্গ রয়েছে। ১৯২৩-এর নভেম্বরে (?) চিন ভ্রমণের পরিকল্পনা জানিয়ে লিখছেন, চিনে গিয়ে ডাকাতের পাল্লায় পড়ে মুক্তিপণ জোটাতে না পারলে ‘...মাথার পিছনে ঝুঁটি গজিয়ে একটা চীনে মেয়ে বিয়ে করে চৈনিক হয়ে আনন্দে কাটিয়ে দেব।’ লিখছেন, চিনের বক্তৃতা লিখতে বসলেই তাঁর মাথায় শুধু গান চলে আসছে। ১৩ মার্চ ১৯২৪-এ রাণুকে লিখলেন, “আমাকে চীন থেকে যে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েচে সে বোধহয় তুমি পড়ে দেখেচ। আমাকে ওঁরা কত আদর করে ডেকেচে আর আমার কাছে কত প্রত্যাশা করেচে।... আমাকে বিদেশে একটা বাণী বহন করে নিয়ে যেতে হবে এই হুকুম।” কবির চিনযাত্রা ভেস্তে গেলে, তাঁকে কাছে পাওয়া যাবে— রাণুর এমন চিন্তার আভাস পেয়ে, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “যাকে চীন ডেকেচে, আমার মধ্যে তাকে দেখে তুমি খুশি হও রাণু। চীন আমাকে না ডাক্লে বেশ হ’ত এমন কথা তুমি মনে মনেও বোলো না।... আমাকে জগতের লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পাও যদি তাহলেই তুমি সবচেয়ে বেশি পাবে।” অভিমানী, কিশোরী অনুরাগিণীকে রবীন্দ্রনাথের মৃদু ধমকেই যেন প্রছন্ন কবির চিনভ্রমণের ব্যাকুলতা।
রবীন্দ্রনাথ চিনে যাবার আগেই তাঁর কিছু রচনা সে দেশে অনূদিত হয়েছিল। আধুনিক চিনের মননে কবির চিন ভ্রমণের সম্ভাব্য, অনভিপ্রেত প্রভাবের আশঙ্কায় কিছু বিরুদ্ধ জনমতও গড়ে উঠেছিল। চিনে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মূলত পিকিং-এর ‘লেকচার এ্যাসোসিয়েশন’-এর আমন্ত্রণে। চিনা কবি-অধ্যাপক শু চ্রী মো ২৭ ডিসেম্বর ১৯২৩ রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি চলতি সময়ের বিষণ্ণতা, দ্বিধা এবং ক্ষোভের উপশম ঘটাবে। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের সঙ্গীদের ভিতর ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু, কালিদাস নাগ এবং লেনার্ড এল্মহার্স্ট। চিনের রাষ্ট্রশক্তির অন্যতম নিয়ন্ত্রক সান-ইয়াৎ-সেন ৭ এপ্রিল ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথকে চিনে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখলেন, “আমি খুবই চাইব নিজে উপস্থিত হয়ে আপনাকে চিনে স্বাগত জানাতে।”
রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর চিন ভ্রমণের বৃত্তান্ত খুব বেশি লিখে যাননি। চিন থেকে ঘুরে এসে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ইন্স্টিট্যুট হল্’-এ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রবাসী-তে ‘চীন ও জাপানে ভ্রমণবিবরণ’ শিরোনামে প্রকাশিত এই বক্তৃতাটির প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের আলোচনায় প্রায় চোখে পড়ে না। তিনি বলছেন, চিন সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের একটি ধারণা ছিল, এবং “সকলের চেয়ে প্রাচীন সভ্যতা যার অন্তর্নিহিত প্রাণ-শক্তিকে চীন বাঁচিয়ে রেখেছিল, তার স্থান কোথায় দেখতে খুব ইচ্ছা করেছিলুম।” আরও বলেছিলেন, “আমাকে যারা ডেকেছিল, তারা বলেছিল কিছু বক্তৃতা দিতে হবে।” এও বলেছিলেন, ‘বিশেষ কাজ’-এ ব্যস্ত থাকায় তিনি চিন ভাল করে ঘুরে দেখতে পারেননি এবং সাধারণ মানুষের অন্তরের কথা জানার সুযোগ পাননি। তাঁর দাবি, চিনে কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য নিয়ে, “ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হ’য়ে যাইনি, সমগ্র এশিয়াকে একত্র করতে যাইনি, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে স্বাভাবিক সম্বন্ধ, সে-সম্বন্ধের আকর্ষণকে স্বীকার করে’ আমি তাদের মধ্যে গিয়েছিলুম এবং দাঁড়িয়েছিলুম...।” ধরে নেওয়ার কারণ রয়েছে, এক মানবতা-কেন্দ্রিক বিশ্ববোধের কথা আলোচনা করাটাই ছিল চিনে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘বিশেষ কাজ’।
চিনের প্রাচীন রাজতন্ত্রের অবসানের বারো বছর পর, রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের লগ্নে নতুন চিন এক রাষ্ট্রিক, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে, অতীতকে আঁকড়ে না থেকে, পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শক্তিধর হওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। নানা শহরে সর্বত্র ভিড় উপচে-পড়া শ্রোতাদের সামনে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ চিনের কিছু পরিবর্তনপন্থীদের, বিশেষত চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও যুবসম্প্রদায়কে বিমর্ষ ও আতঙ্কিত করে তুলেছিল। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেছেন, রবীন্দ্রনাথ চিনের সমকালীন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রবণতাগুলি বোঝেননি। এই ধারণা হয়তো ঠিক নয়। সময়ের দাবি, এবং বস্তুতান্ত্রিক যন্ত্রনির্ভর প্রগতির ঊর্ধ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক রচনার যে উচ্চ আদর্শে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, খোলা মনে সেই ভাবনার কথাই তিনি চিনে বলে এসেছিলেন, যেমন বলেছিলেন জাপানেও। তাঁর ভাবধারার কারণে চিনে তাঁকে কয়েক বার গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে ইস্তাহার প্রচারিত হয়। ব্যক্তিগত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও তিনি চিন-বিরোধী কোনও মনোভাবকে প্রশ্রয় দেননি। জাপানকে অগাধ ভালবেসেও, জীবনের উপান্তে, চিন-জাপান যুদ্ধের সময় তিনি নির্দ্বিধায় চিনের পক্ষ নিয়েছিলেন। চিয়াং কাইশেক, তাই-চি-তাও’এর মতো চিনের রাষ্ট্রনায়কেরা রবীন্দ্রনাথকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়ে তাঁর সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন।
১৯২৩-এর অক্টোবরে(?) রাণুকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওষুধে সাড়া দেওয়া, বিশ্বভারতীর জনৈক মুমূর্ষু কর্মীর কথা জানিয়েছেন। লিখেছেন, তা দেখে বিধান রায়ের মতো চিকিৎসক হাসছেন আর বলছেন, “রবিবাবুর এই আধ্যাত্মিক চিকিৎসা রোগীর ইহকালের পক্ষে বিশেষ কাজে লাগ্বে না।” রবীন্দ্রনাথ কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন, তার কয়েক মাস পর যেন এই সহজ কৌতুকই বিব্রত উপহাস হয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে বর্ষিত হবে চিনের কিছু বুদ্ধিজীবী, যুবসম্প্রদায়ের ভিড়ে, যার অভিঘাতে তাঁকে এক ভাষণে বলতে হবে, প্রগতির পথ রুদ্ধ করতে, সম্পদ বা বস্তুবাদের প্রতি নিরাসক্তি জাগাতে, ভারতবর্ষের ‘সংক্রামক অধ্যাত্মবাদ’-এর প্রচারক হয়ে তিনি চিনে আসেননি!
১৯২৪-এর ৩০ মার্চ প্রতিমাদেবীকে লিখছেন, “চীনের জন্যে ছটা লেক্চার লিখতে হবে।” ২০ মে পিকিং থেকে রাণুকে লিখেছেন, “এই কয়দিনের মধ্যে অন্তত চল্লিশটা বক্তৃতা করেচি।” চিনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণ সঙ্কলিত করে ১৯২৪ ও ১৯২৫-এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বই টকস ইন চায়না। চিনাদের বিষয়ে কলকাতার ভাষণে বলেছিলেন, “এত বড় পরিশ্রমী আর এমন কর্ম্মিষ্ঠ জাতি জগতে কোথাও নেই।” চিনের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রমশক্তিসম্পদের টানে পৃথিবী চিনমুখী হয়েছে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী, বস্তুবাদের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল এবং প্রাচীন সভ্যতায় আস্থাবান মনে করেই চিনে তাঁর বিরুদ্ধতা গড়ে উঠেছিল জানিয়েও চিনে বুদ্ধের দেশের অতিথি রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, তিনি চিনে অসম্মানিত হননি। “আমাকে কেউ অসম্মান-সূচক কিছু বলেনি।... বরাবর বলেছে, “আমরা এঁকে অপমান করতে চাইনে। ওঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে।”
রবীন্দ্রনাথের চিন ভ্রমণের কিছু উজ্জ্বল দিকের কথা বলতে গিয়ে তান চুং ও ওয়েই লিমিং লিখেছেন, তাঁর আগে আমন্ত্রিত অতিথি জন ডিউই ও বার্ট্রান্ড রাসেল-এর তুলনায় রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত হলেও অধিক সমাদৃত ছিল, এবং চিনে রবীন্দ্রনাথের দোভাষী, কবি শু চ্রী মো’এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। শিশিরকুমার দাশ এবং তান ওয়েনের মতে, রবীন্দ্রনাথের ‘স্ট্রে বার্ডস’-এর মতো অণু-কবিতার ধারায় চিনা কবিরা প্রভাবিত হয়ে ছোট কবিতা লিখতে প্রাণিত হয়েছিলেন। চিনে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি শহরে ঘুরেছিলেন। চিনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের সমাধি এবং শেষ সম্রাট ফুই-এর আমন্ত্রণে ‘ফরবিডন সিটি’র রাজপ্রাসাদ, তার সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং রাজ-উদ্যান, পিচ-লাইলাক ফুলে ভরা চিন দেখেছিলেন। চিনে তাঁর জন্মদিনে একটি চৈনিক নামও পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: চু-চেন-তান।
চিন ভ্রমণকালে চিন ও ভারতের কৃষিজীবী, পল্লিবাসী, গবেষক, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চিনের চা-উৎসবের ধারায় শান্তিনিকেতনে প্রবর্তন করেন ‘শু চ্রী মো চা-চক্র’। সেখানে গাইবার জন্যে একটি গানও লিখেছিলেন: ‘হায় হায় হায় দিন চলি যায়’। ১৯২৯-এ জাপান যাওয়ার পথে অপূর্বকুমার চন্দের সঙ্গে শু চ্রী মো-এর অতিথি হয়ে রবীন্দ্রনাথ শাংহাইয়ে কয়েকটি ভোজসভা ও সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। ১৯২৯-এর ২১ মার্চ রথীন্দ্রনাথকে লেখেন, “চীনে খাওয়া আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। কিন্তু অপূর্ব্ব হাঙরের কান্কা খেতে একটু আপত্তি করলে না। আমার পক্ষে প্রায় সবগুলোই ছিল অপথ্য।” চিনা গবেষক তান য়ুন শান এবং চিনের সুহৃদদের সহায়তায় শান্তিনিকেতনে ১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন চিন-ভারত গবেষণাকেন্দ্র চিনভবনের।
১৯২৪-এ তাঁর চিনভ্রমণের পুরোটা সুখের হয়নি। “কিছু ফেলে গেলেন না তো?” পিকিং থেকে বিদায়ের প্রহরে, তাঁর আতিথেয়তায় নিযুক্ত জনৈক সেবকের প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “আমার একখণ্ড হৃদয় ছাড়া আর কিছু ফেলে যাইনি।” চিনে তিনি যেন ছিলেন বসন্তের হঠাৎ হাওয়ায়, মহাকালের স্রোতে ভেসে আসা ক্ষণকালের এক ব্যস্ত, বিতর্কিত, নির্বিকল্প অতিথি। চিনে পৌঁছেই, ১৩ এপ্রিল এক বাগানে চা-সংবর্ধনায়, কে জানে কী মনে করে গেয়ে উঠেছিলেন তাঁর আপন গান: ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে/ এসে হেসেই বলে, ‘যা ই যা ই যাই।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy