Advertisement
E-Paper

উন্নয়নের আগে তথ্যের স্বচ্ছতা

সরকার যদি কখনও অর্থনৈতিক ব্যাপারে সমালোচনা শুনতে রাজি না থাকে, তা হলে তারা কোনও ক্ষেত্রে সত্যি কথা বললেও তাতে বিশ্বাস করা কঠিন হয়।

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০২
Share
Save

এক কালে সরকারি ভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের গুণমান বিষয়ে ভারতের বেশ সুনাম ছিল। অথচ আজ ভারত বিষয়ে যে কোনও মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভরসাযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব। ভারতের মাথাপিছু আয় এত কম হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্রের পরিমাণ বিগত দশকে দ্রুত কমেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এ বিষয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

সরকার যদি কখনও অর্থনৈতিক ব্যাপারে সমালোচনা শুনতে রাজি না থাকে, তা হলে তারা কোনও ক্ষেত্রে সত্যি কথা বললেও তাতে বিশ্বাস করা কঠিন হয়। দরিদ্র মানুষদের একাংশের ব্যয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, এই খবরটি যাতে কিছুতেই প্রকাশ না পায়, তার জন্য এক বার সরকারি তথ্য প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি সরকারের দাবি, ভারতে চরম দারিদ্র আর নেই। দেশের মাথাপিছু আয় এত কম হওয়া সত্ত্বেও তরতর করে দারিদ্রের হার কমছে কেন, কী ভাবে— সেটা যথাযথ তত্ত্ব ও তথ্য ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা করার দায় সরকারেরই। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।

কিছু দিন আগে এক গবেষকের কাছে শুনলাম, ২০১৪ সালের আগেকার অ্যানুয়াল সার্ভে অব ইন্ডাস্ট্রিজ় (এএসআই) তথ্যভান্ডারটি সরকারি মাধ্যমে আর পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বহুলব্যবহৃত সরকারি তথ্যভান্ডার। সেটি যদি না পাওয়া যায়, তা হলে গবেষকদের তা বেসরকারি সূত্র থেকে মোটা দামে কিনতে হবে। সরকার হয়তো নতুন ভাবে তথ্যভান্ডারটি তৈরির কথা ভাবছে— সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠবে যে, ভান্ডারটি যথাযথ হবে কি না।

সরকার অতীতের তথ্যসংগ্রহে ভুলত্রুটি এবং তথ্যভান্ডারের তথ্যের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেই পারে। কিন্তু সরকার কী করছে বা করবে, সেটা জনগণের— যাঁদের মধ্যে পেশাদার গবেষকরাও আছেন— জানা আবশ্যক। সরকারি তথ্য এবং বিশ্লেষণ যদি বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস না করেন, তা হলে ভোটে হয়তো তার প্রভাব পড়বে না, কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির প্রগতি নিয়ে বহির্বিশ্বে হাসাহাসি হবেই। প্রশ্নটা দেশের সম্মানের।

একটি কারণে পরিবারপিছু আয়ের চেয়ে ব্যয়ের সমীক্ষা ও প্রগতি বা অধোগতির ধারাকে বুঝতে বেশি সাহায্য করে। এখন রাজ্যভিত্তিক এবং কেন্দ্রীয়স্তরে বহু কল্যাণমূলক প্রকল্প কার্যকর হচ্ছে। যেমন ধরুন স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। পরিষেবাটি পেয়ে প্রচুর মানুষের উপকার হয়েছে। স্বাস্থ্যজনিত খরচ কমায় হাতে দু’দশ টাকা বেঁচে যাচ্ছে, তাই মানুষ এখন বাড়তি খরচ করতে পারেন। যাঁদের আয় তেমন ভাবে বাড়ছে না, তাঁরা যদি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পবাবদ বেশ কিছু সাহায্য পান, অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের খরচ করার সামর্থ্য খানিক হলেও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বর্ধিত ব্যয় দারিদ্রের পরিমাণ কমাবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যয় বৃদ্ধির হার সামগ্রিক দেশের বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। এ সব ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সমালোচনাকে উপেক্ষা করা নয়, মাথাপিছু ব্যয়ের উপর কল্যাণমূলক প্রকল্পের বাড়তি সুবিধার সঠিক পরিমাপ হিসাব করা। রাজনৈতিক তরজায় সে হিসাব লুকিয়ে ফেলা হলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

ধরা যাক, প্রমাণ পাওয়া গেল যে, দেশে দারিদ্র বেশ খানিকটা কমে এসেছে, এবং মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে। ভোগব্যয় বাড়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমটি অবশ্যই আয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি। দ্বিতীয় কারণ হল, পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বাসস্থানের মতো বিষয়ে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেলে হাতে ব্যয়যোগ্য টাকার পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু ভারতে প্রতিটি রাজ্যে রাজ্য সরকারের অবদান আর কেন্দ্রীয় সরকারের অবদানকে আলাদা করা যাবে কী ভাবে? মানুষের ব্যয়ক্ষমতা দশ টাকা বাড়লে তার কতটা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের জন্য বাড়ল, আর কতটা রাজ্য সরকারের জন্য, বলব কী ভাবে? বলার সহজ কোনও উপায় নেই, তার জন্য গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু, সব টাকাই তো মানুষের করের টাকা। ফলে, কার পয়সায় উন্নতি হচ্ছে তা নিয়ে বেশি বিতর্কের কোনও জায়গা নেই।

ভারতে লোকসংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণে দেশে মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম হওয়া সত্ত্বেও মোট জিডিপির পরিমাণে আমরা এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা। এই ‘উন্নতি’ নিয়ে গর্ব করার কারণ নেই। কেউ বলতে পারেন, গরিব মানুষদের আয় ঠিকমতো মাপা হচ্ছে না। কথাটা ভুল নয়— অসংগঠিত ক্ষেত্রে রোজগারের ভাল হিসাবপত্র কোনও দিনই করা হয় না। কিন্তু অন্য দিকে চরম দারিদ্র যে এ দেশটাতে নেই, সেটা বলা যায় না। মানবোন্নয়ন সূচক, ক্ষুধা সূচকের মতো রিপোর্টে সেই দারিদ্রের ছবি স্পষ্ট। তা হলে দরিদ্রের আয়ের সঠিক হিসাব হলেও খামতির পরিমাণের সঠিক হিসাব জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব সরকারেরই। ফুটপাতে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের ক্রয় ও সঞ্চয় ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন। যাঁরা গাদা গাদা আয়করের রিটার্ন ফাইল করেন অথচ একটি পয়সাও আয়কর দেন না, তাঁদের আসল আয় কত, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। তা না হলে মাথাপিছু আয়ের সঠিক হিসাব হবে না। ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের নীচের দিকে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জীবনে এই অসাম্য কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তারও যথাযথ পরিসংখ্যান প্রয়োজন।

মোট কথা, তথ্য ও পরিসংখ্যান লুকিয়ে রেখে আর যা-ই হোক, আর্থিক উন্নয়ন হতে পারে না। তার জন্য স্বচ্ছতা চাই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

GDP Central Government

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}