দেশের সুস্থায়িত্ব না বিকাশ, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এমন প্রশ্ন বা তুলনা শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। কারণ দু’টি বিষয় আদৌ পরস্পর-বিরোধী নয়, বরং পরস্পর-সম্পর্কিতই বলা যায়। তবু কেন্দ্রীয় সরকারের বিচারে সুস্থায়িত্বকে হারিয়ে উঠে এল বিকাশ। এই বছর ‘সুস্থায়ী ভবিষ্যতের জন্য বিজ্ঞান’ এই ঘোষিত ‘থিম’-কে সরিয়ে শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বিজ্ঞান দিবস (২৮ ফেব্রুয়ারি) পালনের নতুন ‘থিম’ ঘোষণা হয়েছে ‘বিকশিত ভারতের জন্য দেশীয় প্রযুক্তি’।
এতদ্দ্বারা বিজ্ঞান দিবসের কার্যক্রম স্পষ্ট ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়ে উঠল।
ঘটনাটি অভিনব। শুধু ঘোষিত থিম বদলে দেওয়ার বিরল উদাহরণ বলেই নয়, বিজ্ঞান দিবসের থিম-এর মতো স্বল্পপ্রচারিত বিষয়ও যে শাসক দলের রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে, সেটাও লক্ষণীয়। না হলে এমন ইংরেজি-হিন্দি মিশ্র ভাষায় থিম রচনা হবে কেন আর তা ‘বিকশিত ভারত’ এই রকম আবেগপূর্ণ শব্দ ব্যবহারই বা করবে কেন! বোঝা যাচ্ছে, এই গতিতে চললে আগামী বছরেই আমরা সম্পূর্ণ হিন্দিতে শিরোনাম পাব।
সে যা-ই হোক, আপাতত সদ্য হাতে পাওয়া এই বিষয়টি এবং বিজ্ঞান দিবস পালনের সঙ্গে তার সঙ্গতি নিয়ে কিছু সদর্থক চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।
বিজ্ঞান দিবস হল বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তোলার দিন; যুক্তিহীন, ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা জারি রাখার দিন। তেমনই থিম হল এমন বিন্দু, যাকে কেন্দ্র করে মূল বিষয়টি নানা দিকে প্রসারিত হতে পারে। অর্থাৎ, ‘থিম’ এমন হবে, যা মূল বিষয়টিকে ঘিরে নানা রকম ভাবনা ও বিশ্লেষণকে উৎসাহিত করবে, শুধুমাত্র কিছু তথ্যকে তুলে ধরবে না। বিজ্ঞান দিবসের প্রথম দিকের থিম-এর
দিকে তাকালে এই বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যায়। গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞান দিবস পালনের প্রবণতা যতটা বেড়েছে, থিম মুখ্য উদ্দেশ্য থেকে ততটাই বিচ্যুত হয়েছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তোলার পরিবর্তে বিজ্ঞানকে কোনও না কোনও একটা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে; নানা ভাবে বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে শুধু প্রযুক্তির জয়গান গাওয়াও হয়েছে। বিজ্ঞান দিবস পালনের এই রীতিনীতি যে বর্তমান সরকারের বিজ্ঞান ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এ কথা আগেও বার বার আলোচনা হয়েছে।
তাই এই বছরের শুরুতে যখন বিজ্ঞান দিবসের ‘সুস্থায়ী ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কিত থিম ঘোষণা হল তখন মনে হয়েছিল, সরকার তার নিজের কাটা গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারছে না। কারণ, গত ছ’বছরে এই শিরোনাম তৃতীয় বার ফিরে এল। কিন্তু তার পরই থিম বদলের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং বিকশিত ভারতের জয়গান গাওয়ার আহ্বান। হ্যাঁ, এই থিম ঘোষণার সময় ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ দেশীয় প্রযুক্তি এবং দেশীয় বিজ্ঞানীদের অবদানের প্রতি জনগণের প্রশংসাসূচক মনোভাব তৈরি করার কথাও গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন।
সত্যি বলতে, ‘বিকশিত’টুকু বাদ দিলে চর্চার জন্য এমন একটি বিষয়ের ভাবনাটা প্রশংসনীয়। তবে তার জন্য জানা দরকার দেশীয় প্রযুক্তি বলতে সত্যিই কী বোঝায়। মন্ত্রিমশাই যদিও দেশীয় প্রযুক্তি মানে একেবারে (বর্তমান সরকারের) সমকালীন প্রযুক্তি অর্থাৎ চন্দ্রযান, আদিত্য এল-ওয়ান, কোভিডের টিকা ইত্যাদির কথাই উল্লেখ করেছেন; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে দেশীয় প্রযুক্তি মানে ‘দেশের লোকের উপকারের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার’ নয়, বরং প্রাচীন কাল থেকে দেশীয় মানুষজনের হাতে স্থানীয় উপকরণ কাজে লাগিয়ে যে সব ‘ঘরোয়া’ পদ্ধতিতে জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে, তারই উত্তরাধিকার। সঠিক অর্থে দেশীয় প্রযুক্তি মানে তা অবশ্যই প্রজন্মব্যাপী ‘ঘরোয়া’ ব্যবহারিক জ্ঞান ও বিদ্যার ধারা, যা এখনও প্রাসঙ্গিক। স্বভাবতই স্থানভেদে এই প্রযুক্তির নানা রকমভেদ দেখা যায়, অর্থাৎ একই কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে, এমনকি একই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিচিত্র রকম প্রযুক্তি কৌশল ব্যবহার হয়, যার প্রত্যেকটির পিছনেই আছে স্থানীয় মানুষের গভীর পর্যবেক্ষণ ও দক্ষতা। যেমন, বহু প্রজন্ম ধরে পৃথিবীর অনেক দেশেই মাটির পাত্র তৈরি হয় কুমোরের চাকা থেকে; মাটির মেঝে বা দেওয়ালকে মসৃণ এবং জীবাণুরোধক করে তুলতে মাটির সঙ্গে গোবর বা অন্য কিছু মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। কী রকম পাত্র তৈরি হবে, বা কী মেশানো হবে, তা স্থানভেদে বদলায়, কিন্তু মৌলিক ধারণাটা বদলায় না। তেমনই লঙ্কা বা টমেটোর খেতে জীবাণুর আক্রমণ আটকাতে গাঁদাফুলের চাষ করা হয়। শিশুর মাথার গড়ন সুন্দর করতে সর্ষের (চাল-ডাল নয়) বালিশ ব্যবহার করা হয়। মিশ্র চাষে যে জীবাণুর আক্রমণ রোধ করা যায়, বা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ (৫০০ গ্রাম-১ কিলো) সর্ষের তৈরি একটি নরম বালিশে যে সর্ষের বহতা ধর্ম (ফ্লুইডিটি) দেখা যায়, এই পর্যবেক্ষণটাই হল ঘরোয়া প্রযুক্তির মূল।
ভারতীয় জ্ঞানধারার (ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম) প্রবক্তারা যে দেশীয় প্রযুক্তিকে বৈদিক ভারত আর বর্তমান ভারতের কাঠামোয় বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করবেন, সেটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের (ভারতীয়) দেশীয় প্রযুক্তির উত্তরাধিকার কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম নাগরিক সভ্যতাগুলোর একটি হিসাবে স্বীকৃত। সুতরাং পোড়ামাটি, মুদ্রা ও বাসনের জন্য আলাদা আলাদা ধাতুসঙ্কর থেকে শুরু করে কামারের হাপর, ধানের গোলা, সেচের জন্য সুপারি গাছের বাকল (দোনা), বাউলের একতারা, কাপড় রাঙানোর প্রাকৃতিক রং, চুন-হলুদ, কম্পোস্ট সার, আমাদের জীবনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এই রকম অজস্র মণিমুক্তো, সবই হল আসলে দেশীয় প্রযুক্তি, যাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও বলা যায়। দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ, জনজাতি ও অরণ্যবাসী মানুষের জীবনচর্যা থেকে এদের সংগ্রহ করা যায়। কেউ এদের পেটেন্ট নেয়নি, বরং এদের পিছনে রয়েছে যে বিজ্ঞান, দেশি-বিদেশি ভাগাভাগির উপরে উঠে তা এক-একটি সূত্রের মতো বিভিন্ন সংস্কৃতিকে যোগ করে। একে প্রতি দিন চিনে নেওয়া অবশ্যই বিজ্ঞান সচেতনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া।
যন্ত্রনির্ভর আধুনিক সভ্যতায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরও এই ঘরোয়া প্রয়োগ-কৌশলগুলোর গুরুত্ব কমে না, বরং এদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়। তার কারণ এই প্রযুক্তিগুলি বেশির ভাগই প্রকৃতিনির্ভর কিছু পদ্ধতির সন্ধান দেয়, যারা দূষণমুক্ত, সাশ্রয়ী এবং যতটুকু দরকার ততটুকুই হাতে তুলে দেয়। ফলে বাজার সংস্কৃতির ‘মেক ইট লার্জ’ নীতির বিপরীতে গিয়ে ঘরোয়া প্রযুক্তি স্বভাবতই পরিবেশবান্ধব (সংরক্ষক) হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে দু’টি কথা উল্লেখ করা দরকার। প্রথমত ভারতে ইদানীং প্রয়োগকৌশল (ইনোভেশন)-মুখী কাজকর্মের গুরুত্ব অনেকটা বেড়েছে। দেশীয় প্রযুক্তির উদাহরণগুলো অনেকটাই ইনোভেশন-এর সঙ্গে সমার্থক বলে মনে হলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে; সব ইনোভেশনই প্রযুক্তি নয়। দ্বিতীয়ত, দেশীয় প্রযুক্তির এই চর্চা পুরনো প্রযুক্তির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য নয়; বরং এই প্রতিটি প্রযুক্তির পিছনে যে জ্ঞান তাকে আবিষ্কার করা এবং তাকে উন্নততর কাজে লাগানোর উদ্যোগ করাই আসল কথা। এই বিষয়ে একটি চমৎকার উদাহরণ হল ঢেঁকি। ধানের খোসা ছাড়ানোর এই একান্ত দেশীয় প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্বয়ংক্রিয় ঢেঁকিতে ধান ছাঁটার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এতে প্রায় বিনা পরিশ্রমে অনেক তাড়াতাড়ি কাজ সারা হয়। আর প্রায় ১৫০০ বছর আগেকার চোল সাম্রাজ্যের সমকালীন স্বস্থায়ী সেচ ব্যবস্থার ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই শুকিয়ে যাওয়া ৩৫টি ঝিলকে জলে ভরিয়ে তুলেছেন ‘ঝিল-মানব’ আনন্দ মাল্লিগাওয়াড।
তা হলে আধুনিক গবেষণানির্ভর যে সব প্রযুক্তি (কৃষি, ধাতুবিদ্যা, মহাকাশবিজ্ঞান) মূলত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের কি দেশীয় প্রযুক্তি বলব না? অবশ্যই বলব। সেই বিজ্ঞানীদের কাজের কথা বিস্তারিত জেনে নিয়ে তাঁদের কৃতিত্বে গর্বিত বোধ করব। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের গবেষণাকেন্দ্রিক কোনও বিষয়ের কতটুকু সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তির অবদান, সেটা সেই বিজ্ঞানীরা ছাড়া কেউ ঠিকমতো জানেন না। তাই সরকারি উৎসাহে ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের জয়গানে গলা মেলানো ছাড়া এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের চর্চার বিশেষ কিছু সুযোগ নেই।
সরকারও আসন্ন নির্বাচনপর্বে শুধু হাততালিটুকুই চায়। তাই তড়িঘড়ি এই ‘থিম বদল’। আত্মনির্ভরতা যদি ফলাফল হয়, তা হলে কারণ হওয়া উচিত সরকারি উদ্যোগ। তার নমুনা হিসাবে সম্প্রতি পাওয়া একটি তথ্য উল্লেখ করি। চন্দ্রযানের পরবর্তী মহাকাশযান নিয়ে গবেষণা চলছে কলকাতার একটি গবেষণাগারে; সেখানে কাজের জন্য দরকার ছিল একটি ‘কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্ট চেম্বার’, যার দাম ১৮-২০ লক্ষ টাকা। গবেষণার ক্ষেত্রে এই টাকার অঙ্কটা খুব বেশি কিছু নয়। কিন্তু অনুদানের অভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকায় সেটা তৈরি করে কাজ চালানো হচ্ছে। এই রকম ‘চাপে পড়া’ (দেশীয়) প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের খবর সব গবেষণাগারে ছড়িয়ে আছে। সরকার কি এটাকেই ‘আত্মনির্ভরতা’ বলে দাবি করে অনুদানের অভাব হাততালি দিয়ে পূর্ণ করতে চায়? বিজ্ঞান দিবসের থিম থেকে ‘বিকশিত ভারত’-এর ধারণাটার মূল সূত্র আছে ওখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy