ভারতের সরকারি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। প্রতীকী ছবি
সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে পূর্বাভাস ছিল যে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হবে স্বল্পদৈর্ঘ্যের। বেসরকারি পূর্বাভাসদাতারা সারা বছরের বৃদ্ধির খতিয়ান সম্পর্কে তাঁদের প্রত্যাশাকে এই মুহূর্তে খানিক কমিয়েই দেখতে চাইছেন। তাঁদের মতে, বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে থাকবে। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রের পূর্বাভাসদাতারা বৃদ্ধির অঙ্ক আগামী ত্রৈমাসিকগুলিতে ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা জানাতে কেমন যেন একটা উদাসীন ভাব দেখাচ্ছেন। তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাল রেখে কিছুটা মধ্যপন্থায় রয়েছে। তাঁরা ৪ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলছেন। এবং আগামী অর্থ-বছরে (২০২৩-’২৪) সেই হার ৬ শতাংশের আশপাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে জানাচ্ছেন।
এমন সব নিরাশাব্যঞ্জক পরিসংখ্যান ২০১৯-’২০ সালের প্রাক-অতিমারি পর্বের ধীরগতির বৃদ্ধির বছরকে মনে করিয়ে দেয়।যে সময় বৃদ্ধির হার কমতে কমতে ৩.৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিল। মধ্যবর্তী কোভিড-পর্বের দু’টি বছর ২০২০-’২২-এ কার্যত কোনও বৃদ্ধিই ঘটেনি। যদি ২০১৯-’২৪— এই পাঁচ বছরের হিসাব একসঙ্গে নেওয়া যায়, তা হলে গড় বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৩.৬ শতাংশ। ১৯৭০ সাল থেকে খতিয়ান নিলে দেখা যাবেএই পাঁচ বছর সব থেকে ধীরগতির বৃদ্ধিপর্ব।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এমন অবস্থার মধ্যেও কিছু আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কোনও ক্রিকেট দল সার্বিক ভাবে ভাল না খেললেও দু’একজন ব্যাটসম্যান বা বোলার যেমন নজর কাড়েন, তেমনই কিছু ঝলক অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে পরিবহণ পরিকাঠামোয় উন্নতির কথা সর্বাগ্রে বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে ‘ডিজিটালাইজেশন’-এর বহুমুখী চরিত্র অর্জনের কথা।যে ক্ষেত্রটিতে উৎপাদন অবশ্যই আশা জাগাচ্ছে। পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, এক কঠিন সময়ে ভারত অন্যান্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির চেয়ে অনেকটাই উজ্জ্বল ছবি দেখাতে পেরেছে। তা সত্ত্বেও দ্রুত ছন্দের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সার্বিক লক্ষ্য (সাধারণত বছরে ৭ শতাংশ) কিন্তু এই সব আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে না। এর আনুমানিক ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, জীবাণুর জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলিকে বিচার করে ‘দীর্ঘমেয়াদি কোভিড’যেমন এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক স্বীকৃত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনই অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এক ‘লং কোভিড’লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমেরিকা এবং ইউরোপকে (ব্রিটেন-সহ) এই মুহূর্তে অতিমারির অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে বাড়াবাড়ি রকমের মূল্য চোকাতে হচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার উদ্দেশে ঘোষিত অবরোধগুলির প্রতিক্রিয়াও। বিপুল পরিমাণ সরকারি ঋণ এবং মূ্ল্যবৃদ্ধির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে দুই মহাদেশের অর্থনীতিই মন্দাবস্থার সম্মুখীন হতে পারে।কারণ, তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলায় বিপুল সুদের হারে ঋণ নিয়েছে।যা আগামী বছর দুয়েকে বাড়বে বই কমবে না। ইতিমধ্যে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৪ শতাংশ। অতীতের দ্রুতগতির বৃদ্ধিতে ফিরে যাওয়া তার পক্ষেও তেমন সহজ নয়।
এই তিন বৃহৎ অর্থনীতি বিশ্বের মোট গৃহজ উৎপাদনের (জিডিপি) দুই-তৃতীয়াংশের দাবিদার। সুতরাং যখন বাজার গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তখন সার্বিক ভাবেই বিশ্ব-অর্থনীতির বৃদ্ধি খানিক পরিমিত হবে বলেআশা করা যায়। দুই দুর্যোগের মধ্যবর্তী পর্বের (বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কট-উত্তর এবং প্রাক-কোভিড সময়কালের) আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ। তার তুলনায় ২০২২ এবং ২০২৩ সম্পর্কে সাম্প্রতিক ভাবনা এক স্পষ্ট অধোগতির ইঙ্গিত দেয়। যখন ভারত অন্যান্য অর্থনীতির চাইতে অনেকখানি ভাল অবস্থায় রয়েছে, তখন এ কথা মনে করা ঠিক নয় যে, এ দেশ অন্য কোনও গ্রহে অবস্থিত। এ সব সঙ্কটের মধ্যে ভারতও পড়তে বাধ্য।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিপত্তিগুলিও একই রকম ভাবে বাস্তব। ভারতের সরকারি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। নীতি-নির্ধারকেরা খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দিকে বেশি করে নজর দিচ্ছেন।কিন্তু তাঁরা পাইকারি মূল্যের বৃদ্ধিকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না।যা ১৫ শতাংশেরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনিবার্য ভাবে সুদের হারও বেড়ে গিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়তে চলেছে। সরকারি ঋণের বৃদ্ধির ফলও কিন্তু ঘোরতর বাস্তব। ২০১০-’১১ নাগাদ কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের উপরে সুদের পরিমাণ আদায়ীকৃত রাজস্বের ২৯.৭ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৪-’১৫ নাগাদ এই অনুপাত ৩৬.৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। সেই সময় থেকে অতিমারির সূত্রপাত পর্যন্ত এই অনুপাতটিই বহাল থেকেছে। অতিমারির ফলে সৃষ্ট দুর্বিপাকের মোকাবিলায় যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, তাতে সরকারি ঋণের পরিমাণ এমন এক বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে, যেআদায় হওয়া রাজস্বের ৪২.৭ শতাংশ লেগে যাবে তা পরিশোধে।
যখন রাজকোষে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তখন চড়া সুদের হার এই সব হিসাবের পুর্বাভাসকে ছাপিয়ে আরও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং তাকে কমিয়ে আনা একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বৃদ্ধির উপরে ভর করেই যখন আর্থিক নীতি নির্ধারিত হয়, তখন তাকে চাঙ্গা করার জন্য ‘বুস্টার টিকা’দেওয়ার সুযোগ অর্থনীতিতে কমই থাকছে। বৃহৎ অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। চলতি বছরে ভারত হয়তো ৭ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু সার্বিক ভাবে বিশ্ব ও দেশের ভিতরের পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখলে আন্দাজ করা যায় যে, ভারত বার্ষিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধির হারকে ছুঁতে পারলে সেটা হবে এক আশাব্যঞ্জক কৃতিত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy