Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Presidency University

সেই সংস্কৃতি বিদায় নিয়েছে

আমরা যারা প্রেসিডেন্সিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি তাদের এখন মনে হয়, এরই জন্য কি আমরা প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে চেয়েছিলাম?

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করে ২০১০-এ।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করে ২০১০-এ।

অমলকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৩১
Share: Save:

নব্বইয়ের প্রথমার্ধে পর পর কয়েক বার প্রেসিডেন্সি কলেজ দেশের শ্রেষ্ঠ ডিগ্রি কলেজ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইতিমধ্যে তৎকালীন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে ও অধ্যাপকদের সহযোগিতায় ‘বিকল্প উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা’ শিরোনামে একটি দলিল উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয় ১৯৯৫-এর ৫ জুন। এই দলিলে পাঠ্যসূচি, শিক্ষণব্যবস্থা, পরীক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন করে, তৎকালীন বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত পদ্ধতির অনুসরণে প্রেসিডেন্সিকে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা হয়, যে-হেতু এই ধরনের পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্সির পক্ষে আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সম্ভব নয়— প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। অনেক টানাপড়েনের শেষে প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, তাঁর উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করে ২০১০-এ।

২০১১-য় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন যে, তিন বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করবেন। আমরা, প্রেসিডেন্সির গভীর অনুরাগীরা ঘোষণাটি শুনে যারপরনাই আহ্লাদিত হই, এবং স্বপ্ন দেখতে শুরু করি তিন বছর পরেই প্রেসিডেন্সি অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের পাশে জায়গা করে নিয়েছে।

কিন্তু স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। আজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পর দশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু প্রেসিডেন্সির মান তো উন্নীত হয়ইনি, বরং দ্রুত তার মান অধোমুখী। এখন দেশের প্রথম একশোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রেসিডেন্সির ঠাঁই হয় না। লক্ষ করি, প্রেসিডেন্সি কলেজের যাবতীয় চিহ্নকে মুছে ফেলা হয়েছে, কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো সম্মান আজও অর্জন করতে পারেনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। তার বহিরঙ্গের চাকচিক্য অনেক বেড়েছে, কিন্তু গুণগত উন্নয়ন হয়নি। অতীতে সকলের কাছে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছিল অবারিত দ্বার। এমন অনেক মানুষ কলেজের চত্বরে ঢুকে বলতেন, এই কলেজে পড়ার সুযোগ তো পাইনি। তাই এসেছি তাকে দেখতে, যাতে চক্ষু সার্থক হয়। কিন্তু আজ বাইরের মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার নেই। প্রেসিডেন্সি যেন আজ বন্দিশালা, যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী-র রাজা যিনি নিজের কারাগারে নিজেই বন্দি।

শিক্ষাগত কৃতিত্বের জন্য নয়— প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আজ খবর হয় অশান্তি ও ছাত্রবিক্ষোভের জন্য। এই ঘটনাবলির প্রত্যেকটির পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে। শুনতে পাই, বিধাননগরের ছাত্রীনিবাসের আবাসিকদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য টাকা আদায় করা হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করে— বিনামূল্যে প্রেসিডেন্সিতে যাতায়াতের প্রয়োজনে ছাত্রীনিবাসের আবাসিকদের জন্য যে বাস কেনা হয়েছিল, সেটি কি আজ অচলাবস্থায়? যদি তা-ই হয়, তা হলে নতুন বাস কি কেনা হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তা হলে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রেসিডেন্সির ঐতিহ্য লঙ্ঘন করা হচ্ছে কেন? আর যদি কেনা না হয়ে থাকে, তা হলে অবিলম্বে তা কেনা হচ্ছে না কেন?

হিন্দু হস্টেল ভবন সংস্কার করার জন্য কয়েক বছর আগে তা খালি করে দেওয়া হয়। তার পর থেকে বছরের পর বছর ধরে সংস্কার হয়েই চলেছে এবং আবাসিকরা চরম বিপদের মধ্যে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা জোর করে হস্টেলে ঢুকে পড়েন এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এখন নানা ধরনের অব্যবস্থার শিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি ইঞ্জিনিয়ারদের দ্রুত কাজটি শেষ করতে বলতেন, তা হলে এত দেরি হত না। অতীতের এক কলেজ অধ্যক্ষ পূর্তবিভাগের কর্মীর সঙ্গে এমনই এক ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যে, প্রয়োজনে তাঁরা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে কাজ করতেন। এখন এই সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে।

এর কারণ হল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় আজ আমলাতন্ত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমলাতন্ত্র দিয়ে চলে না, চলে ভালবাসা দিয়ে। আমার অভিজ্ঞতা, ভালবাসা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করা যায়। এই ভালবাসার আজ বড়ই অভাব প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে রক্তকরবীর রাজা বসে আছেন নিজেরই তৈরি বেষ্টনীর মধ্যে। তাই তাঁর কাছে পৌঁছয় না বাইরের কোনও আর্তি, কোনও হাহাকার। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা— এই রাজাকে এক দিন বেরিয়ে নিজের তৈরি কারাগার ভেঙে ফেলতে উদ্যোগী হতে হয়। রবীন্দ্রনাথও তাই দেখিয়েছেন তাঁর রক্তকরবীতে।

আমরা যারা প্রেসিডেন্সিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি তাদের এখন মনে হয়, এরই জন্য কি আমরা প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে চেয়েছিলাম? ‘ইহারি লাগিয়া এত আয়োজন, এত জাগরণ, এত ক্রন্দন!’

অন্য বিষয়গুলি:

Presidency University Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy