—প্রতীকী চিত্র।
অমৃত মহোৎসবের গরল যেটুকু, বরাদ্দ হল বিলকিস বানুর জন্য।
গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলকিসের লড়াইয়ের যা কিছু অর্জন, তা শুধু ওঁর ছিল না। রাষ্ট্রেরও অর্জন ছিল। বিলকিসের আস্থা। সমাজের সুবিচার পাওয়ার আস্থা, বিলকিসকে ঘিরে।
আজকের ক্ষমতাকেন্দ্র সফল ভাবে সেই আস্থা অর্জনের প্রক্রিয়াকেই বাতিল করে দিতে পেরেছে। বিলকিসের, বিলকিসের মতন আরও অনেকের সুবিচারের আশা, তাদের ভরসা, আজকের ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছে অপ্রয়োজনীয়, অবান্তর।
সংখ্যালঘু মহিলা হিসাবে বিলকিসের লড়াইটা এমনিতেই কঠিন ছিল। বিলকিস সেই লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। গোটা পরিবার, সমস্ত আত্মীয়স্বজনকে হারিয়ে লড়াইয়ের শুরুতে বিলকিস যতটা বিপন্ন ছিলেন, এখন, তাঁর অপরাধীদের সাজা মকুবের ঘটনার পরে বিপন্নতাটা অনেক বেশি। এই বিপন্নতা শুধু শারীরিক নয়। আবারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যা থাকার সে তো আছে, এ রকম কিছু ঘটলে, আইন-প্রশাসন খুব কিছু নড়েচড়ে কিছু করতে পারবে এমন আশাও নেই।
কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। যে পথে, যে ভরসায় বিলকিস লড়েছেন সেই পথটা, সেই ভরসাটুকুও বিলকিসের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গত ২০ বছরে যে সামাজিক সমর্থনটুকু বিলকিসের পাশে জড়ো হয়েছিল, সেটা নস্যাৎ করে দিয়ে, সমাজের প্রতিনিধিদের নাম করে, নির্দিষ্ট দলীয় রাজনীতির ‘ভিন্ডিক্টিভ ম্যানিপুলেশন’ সেই নাগরিক রাজনীতির ‘স্পেস’টাকেও ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ করেছে।
বিলকিসকে নিয়ে আমার লিখতে অস্বস্তি হওয়ার কারণটা লিখতে লিখতে আমি আরও টের পাচ্ছি। অস্বস্তিটা শুধু এ রকম ছিল না যে, সব কথাই তো লেখা হয়ে গিয়েছে। আমি আর কী লিখব! বরং অস্বস্তিটা এ রকম যে, বিলকিসকে নিয়ে লিখতে গেলে আমি হয়তো আমার কথাই লিখে ফেলব। প্রান্তিকতার পরিচয়ের বিপন্নতা নিয়ে নতুন করে কী-ই বা লেখার আছে! যদি না তার বিপ্রতীপ বয়ানটুকু তৈরির উদ্যোগগুলোকে জড়ো করা যায়!
বিলকিস প্রসঙ্গে মাঝেমধ্যেই নির্ভয়া প্রসঙ্গের ‘রেফারেন্স’ আসছে। মনস্তত্ত্বের নিরিখে নির্ভয়া আর বিলকিস দু’জনেই অমানুষিক হিংস্রতার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁদের শরীরের উপর তাঁদের নিজেদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তুলনা আসাটা খুব স্বাভাবিক। মনস্তত্ত্বের নিরিখে, নির্ভয়ার ঘটনায় সুবিচারের দাবিতে তাঁর পরিবারের লড়াই আর পরিবার-পরিজন হারিয়ে, নিজের এবং নিহত পরিবারের জন্য বিলকিসের লড়াই— দুটোর অভিঘাত আলাদা রকমের।
বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, বিলকিস তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া জানানোর অবস্থায় নেই। গুমরে আছেন। ২০০২ থেকে এখনও পর্যন্ত বিলকিস যত রকমের ‘ট্রমা’র মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তার পর তাঁর কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া আশা করাটাও বেশ অশালীন ব্যাপার। তার থেকেও অশ্লীল ব্যাপারটা অবশ্য রাষ্ট্র এবং তার ক্ষমতাকেন্দ্র আগেই ঘটিয়ে ফেলেছে। ১১ জন অপরাধীর সাজা মকুবের সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে বিলকিসের মতামত চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
নির্ভয়ার ক্ষেত্রে বিচারের দাবিতে তাঁর পরিবার, সমাজের বৃহদাংশ যে ‘এজেন্সি’ নিয়েছিল, বিলকিসের বেলায় সরকার, ক্ষমতা, রাষ্ট্র, এবং সমাজের মেকি প্রতিনিধিত্ব সেই ‘এজেন্সি’ নিয়েছে ধর্ষক, খুনি অপরাধীদের জন্য। সেখানে নির্যাতিতের, ভিক্টিমের কোনও অংশীদারিত্ব নেই। বরং তাঁকে বাদ রাখার জন্য সব রকমের যত্ন নেওয়া হয়েছে। ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’-এর মেকিত্বটা সেখানেই খসে পড়েছে। রাষ্ট্র নিজেই বিলকিসের লড়াইটা আইনি গণ্ডির বাইরে বার করে দিয়েছে।
কিন্তু অন্য দিকে তার প্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত আর এক রকমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যেমন, বিলকিসের ধর্ষকদের শাস্তি মকুবের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে গিয়ে শাস্তি মকুবের দস্তুরটাকেই বাতিল করার দাবি তোলা হচ্ছে না তো? স্ট্যান স্বামী বা ভারভারা রাও, গৌতম নওলাখা বা সোমা সেন— বা এমন আরও অগুন্তি মানুষ, যাঁদের স্রেফ শাসকের বিরোধী রাজনৈতিক মত পোষণ করার অপরাধে জেলে পুরে রাখা হয়েছে, তাঁদের মুক্তির দাবিটা দুর্বল হয়ে যাবে না তো?
এমনিতেই কারাগারগুলি থেকে বিলকিস-কাণ্ডে অভিযুক্ত এবং এ রকম আরও অনেকের সাজা মকুবের রেওয়াজ যদি তৈরি হয়, তা হলে জেল বিষয়টাকে শুধুই বিরোধী রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পথটা প্রশস্ত হয়। খুব সঙ্গত কারণেই বিলকিসের অপরাধীদের শাস্তি মকুবের ঘটনা বিচারব্যবস্থা নিয়ে হতাশা তৈরি করে। কিন্তু সেই হতাশাজাত হিংস্রতা থেকে মৃত্যুদণ্ডের দাবির ন্যায্যতা তৈরি হবে কি না, সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটাও উঠে আসে।
সংসদ, বিধানসভা, গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা— সব কিছুকেই তাঁবে রাখার এই উদ্যোগে বিরোধী রাজনীতির স্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। এমনিতেই রাজনৈতিক বিরোধিতার স্বরও আপাতত ইডি-সিবিআই-আদালতের কাছে গচ্ছিত। কেন্দ্রীয় সংস্থার বকলমে বিরোধিতাকেও ক্ষমতাসীন রাজনীতি ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ করে নেওয়ার পরে বিরোধী রাজনীতি যেন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক নিয়মতান্ত্রিক আড়ম্বর।
শাহবানুর খোরপোষের অনুষঙ্গে আমাদের জীবনে রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ এসেছিল। বিলকিসের ধর্ষকদের অনুষঙ্গে এল অমৃত মহোৎসব। দেশ, তেরঙা— ইত্যাদির তোড়জোড়ে সংখ্যালঘু এক নিগৃহীতা মহিলার যাবতীয় লড়াই এবং সেই লড়াইয়ের অর্জনকে অবান্তর করে দেওয়া হল।
তা হলে এর বিপরীতে আমরা যারা বিলকিসের পক্ষে আমাদের অবস্থানকে স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করছি, তাদের লড়াইয়ের দাবিটা কী হবে? কার কাছে হবে? কেমন ভাবে সে দাবি পেশ করব আমরা? সরকার, আইনব্যবস্থা, এগুলির উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যাবে না, এটা যখন এত স্পষ্ট, তখন সামাজিক অবস্থান তৈরির সময় সেটা ভাবব না আমরা?
(লেখক নারী অধিকার আন্দোলনের পরিচিত ব্যক্তিত্ব, মনো সমাজকর্মী। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy