Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
IIT Kharagpur

বৈদিক যুগের আগে সিন্ধু সভ্যতা

ইতিহাসবিদরা যখন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন, তা তাঁদের করতে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে।

সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৫
Share: Save:

আইআইটি খড়্গপুরের সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমস ২০২২ সালের একটা ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে। শুরুতেই বলা আছে, ভারতীয় জ্ঞানধারার ভিত্তিকে উদ্ধার করা, বেদের গূঢ় জ্ঞানের স্বীকৃতি, সিন্ধু সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন, এবং ভারত ভূখণ্ডে আর্যদের প্রবেশের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করাই এই ক্যালেন্ডারের উদ্দেশ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণে যে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তারই প্রচারমাধ্যম এই ক্যালেন্ডার। এখানে নানা বিষয়ে ছবি সহযোগে হরেক কথা বলা আছে। তার মধ্যে একটি বিষয় গুরুতর। দাবি করা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতারই অঙ্গ। ইতিহাসবিদরা যে বলেন, সিন্ধু সভ্যতা প্রাক্-আর্য সভ্যতা এবং এক সময় আর্য-ভাষাভাষী মানুষ মধ্য-এশিয়ার উচ্চ স্তেপভূমি থেকে ইরানের পথে ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ বৈদিক সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল— এই ধারণা পশ্চিমি ইতিহাসবিদদের ষড়যন্ত্র, যাঁরা দেখাতে চেয়েছেন উন্নত সংস্কৃতি এবং হিন্দুধর্ম ভারতে এসেছে বাইরে থেকে। তাই আইআইটি খড়্গপুরের ক্যালেন্ডার-প্রণেতারা ইতিহাস নতুন করে লিখতে চান।

ইতিহাসবিদরা যখন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন, তা তাঁদের করতে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। সে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁদের বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক সমাজের সামনে পেশ করতে হয় গবেষণা পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে। অন্যরা বিচার করেন, যা সূত্র পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় কি না। এই প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি পেলে তবেই তা ‘ইতিহাস’ হিসাবে স্থান পায়।

তা হলে বিচার্য, ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার এবং তার দু’বছর পর হরপ্পা আবিষ্কার হওয়ার পর খোঁড়াখুঁড়ি করে কী তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, যার ভিত্তিতে ইতিহাসবিদরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এই সভ্যতা প্রাক্-বৈদিক? মূলত সূত্র ছিল চারটি।

প্রথম, সিন্ধু সভ্যতার বাড়িঘর পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি। অথচ, তার পরে সহস্রাধিক বছর ভারত ভূখণ্ডে কোনও ইটের বাড়ি পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, বৈদিক আর্যরা পোড়ামাটির ইট বানাতে জানতেন না। যদি সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতারই অঙ্গ হয়, তবে এটা হওয়ার কথা নয়।

দ্বিতীয়, বৈদিক সাহিত্যের প্রধান পশু হল ঘোড়া। অথচ, কোনও ভারতীয় জঙ্গলে বন্য ঘোড়া নেই। সিন্ধু সভ্যতার শতাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রে খননকার্য চালিয়ে প্রচুর পোড়ামাটির সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে। সেগুলিতে নানা পশুর ছবি আঁকা আছে— বাঘ, গন্ডার, হাতি, হরিণ, শুয়োর আছে, সবচেয়ে বেশি আছে ষাঁড়ের ছবি, এমনকি ষাঁড়ের শরীর আর হরিণের মুখওয়ালা এক-শিঙের কাল্পনিক জন্তুও আছে। কিন্তু কোনও ঘোড়ার ছবি নেই। অর্থাৎ, সিন্ধু সভ্যতার প্রধান পর্যায়ে ঘোড়া সেখানে ছিল না। তা হলে বলা যায়, ঘোড়া ভারত ভূখণ্ডে তার পরে এসেছে এমন কোনও জায়গা থেকে, যেখানে বন্য ঘোড়া আছে।

তৃতীয়, সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরগুলি থেকে জানা যায় যে, তাদের লিখিত ভাষা ছিল। সে লেখা এখনও পড়া যায়নি, কারণ আধুনিক কোনও ভাষার সঙ্গে তার সাদৃশ্য নেই। কিন্তু লিখিত ভাষা যে ছিল, তা নিশ্চিত। আর এও আমরা জানি যে, বৈদিক সভ্যতার প্রথম দিকে লিখিত ভাষা ছিল না, বেদের শ্লোকগুলি শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমেই প্রচারিত ও রক্ষিত হত। যদি সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার অঙ্গই হবে, তবে ঋগ্বেদের রচয়িতাদের লিখিত ভাষা থাকার কথা, আর তা সিন্ধু সভ্যতার লিখিত ভাষার ধারাবাহিকতাতেই আসার কথা। তা হয়নি।

চতুর্থ, বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, উপনিষদ, পুরাণ— এ সব বৈদিক সাহিত্যের কোথাও সিন্ধু সভ্যতার মতো নগরজীবনের বর্ণনা পাওয়া যায় না। ইটনির্মিত বাড়ি, পাকা রাস্তা, ঢাকা পয়ঃপ্রণালী— এ সবের কোনও উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যের কোথাও নেই।

এই চারটি সূত্র ভিত্তি করেই ইতিহাসবিদরা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে কোনও সাংস্কৃতিক সংযোগ ঘটেনি। যে হেতু বৈদিক সভ্যতার সাংস্কৃতিক ইতিহাস অবিচ্ছিন্ন ভাবেই পাওয়া যায়, তাই সিদ্ধান্ত হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পরই বৈদিক সভ্যতার শুরু। পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় পাওয়া ভারত ভূখণ্ডের সর্বপ্রাচীন ঘোড়ার জীবাশ্ম এবং ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর বিবর্তনের ইতিহাস স্তেপভূমির মানুষের ভারতে আগমনের সেই রকম সময়কালই নির্দেশ করে।

তাই আইআইটি খড়্গপুর কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, নিজস্ব বিশ্বাস বিজ্ঞানের ভাষার মোড়কে পরিবেশন করবেন না। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের অবদান আজ স্বীকৃত। ভারতের অতীত গরিমা প্রচারের জন্য অবিজ্ঞানের আশ্রয় নিলে সেই অবদানকেই ছোট করা হয়।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, কলকাতা

অন্য বিষয়গুলি:

IIT Kharagpur Calendar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy