পৌত্তলিক? বীরভূম কাণ্ডের তদন্ত শুরু করতে এসেছে সিবিআই, বগটুই, ২৫ মার্চ। পিটিআই
সত্তরের দশকের স্লোগান ছিল--‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো’! কটাক্ষটা নিছক পুলিশের বেতন নিয়ে নয়। পুলিশকে আসলে মনে করিয়ে দেওয়া, তুমি রাষ্ট্রের যন্ত্র। তোমার টিকি বাঁধা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় রাজনীতির নতুন স্লোগান হতে পারে ‘আমার পুলিশ, তোমার পুলিশ’! ‘আমার’ পুলিশ ভাল। ‘তোমার’ পুলিশ খারাপ। আমার পুলিশ নিরপেক্ষ। তোমার পুলিশ হাতের পুতুল। তার কাজ শুধুই বিরোধীদের হেনস্থা করা। আমার পুলিশ আমাকে ‘মা’ বলতে পারে। তুমি কেন তোমার পুলিশের ‘মাই-বাপ’ হয়ে উঠবে!
এক দিকে রাজ্যের পুলিশ, সিআইডি, সিট। অন্য দিকে কেন্দ্রের পুলিশ— সিবিআই। সঙ্গে দোসর ইডি, আয়কর দফতর। বিজেপি রাজ্যের পুলিশে অনাস্থা জানিয়ে বীরভূমের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত আদায় করছে। তৃণমূল নেত্রী সিবিআই-ইডি’র বিরুদ্ধে গোটা দেশে বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার ডাক দিচ্ছেন। বিজেপি বলছে, শুভেন্দু অধিকারীদের পুলিশ মিথ্যে মামলায় ফাঁসাচ্ছে। তৃণমূল বলছে, শুভেন্দু বিজেপিতে যেতেই তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তে ইতি পড়ল।
পুলিশ, সিবিআইকে নিয়ে কেন্দ্রের শাসক দল ও রাজ্যের শাসক দলের এই দড়ি টানাটানিতে একটা কথা ফের প্রমাণিত। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, কোনও জায়গাতেই পুলিশের কোনও স্বাধীনতা নেই। সে শুধু রাষ্ট্রের যন্ত্র নয়, শাসক দলেরও যন্ত্রে পরিণত।
ষোলো বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস প্রকাশ সিংহের মামলায় পুলিশের রাজনৈতিকীকরণ থামানোর রায় দিয়েছিল। আর সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে ‘খাঁচার তোতা’-র তকমা দিয়েছে আট বছর আগে। নরেন্দ্র মোদী তাঁর আট বছরের রাজত্বকালে খাঁচার তোতাকে মুক্তি দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেননি। কোনও রাজ্যেই পুলিশের রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই রামপুরহাটে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘কেন আনারুল পুলিশ পাঠাল না?’ আনারুল পুলিশের ডিজি নন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও নন। তিনি তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। তাঁর জমানায় যে নেতাদের হাতে পুলিশ পাঠানো বা না পাঠানোর ভার, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কোনও রাখঢাক করেননি।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরাও বিশেষ রাখঢাক করেন না। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়। অন্ধ্র, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে মণিপুর— মোদী জমানায় সিবিআই-ইডি-আয়কর দফতর বিরোধী শিবিরের নেতাদের ঘরে হানা দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব বাঁধা গতে আওড়েছেন, তদন্তকারী সংস্থা আইন মেনে নিজের মতো কাজ করছে। কিন্তু দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতারা বিজেপিতে যোগ দিলেই সিবিআই-ইডি হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ‘ওয়াশিং মেশিন’ হিসাবে বিজেপির খ্যাতি সিবিআইয়ের সৌজন্যেই।
রামপুরহাট ঘটনায় সিবিআই তদন্ত শুরু করার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সিবিআইয়ের তদন্তে তো কোনও বিচার মেলে না। নমুনা, নোবেল-নন্দীগ্রাম-নেতাই। খাঁটি কথা। সারদা-সহ চিট ফান্ডের মামলাতেও গত আট বছরে সিবিআই তদন্ত শেষ করতে পারেনি। ঠিক যেমন মুলায়ম সিংহ যাদব বা মায়াবতীর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের দুর্নীতির মামলার তদন্তও কখনও শেষ হয় না। কংগ্রেসের জমানায় মুলায়ম, লালুর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের বশে রাখা হত। নরেন্দ্র মোদী জমানায় একই সিবিআইয়ের জুজুতে মায়াবতী বাঘ-বন্দি-খেলায় জব্দ হয়েছেন। তেলুগু দেশমের চন্দ্রবাবু নায়ডুকে দুর্বল করে দেওয়াই হোক বা জগন্মোহন রেড্ডিকে বশে রাখা— অস্ত্র একটাই। সিবিআই তদন্ত। এই তদন্ত শেষ হলেই হাতিয়ারও হাতছাড়া। তাই বছরের পর বছর সিবিআই তদন্ত চলতেই থাকে। কাউকে বাগে আনতে হলে তদন্তের গতি বাড়ে। বশ হলে পুরস্কার স্বরূপ তদন্তের গতি কমে। কেন্দ্রে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় খোদ মোদী-শাহের বিরুদ্ধে সিবিআইকে কাজে লাগানোর অভিযোগ ছিল। মোদী-শাহ জমানায় গান্ধী পরিবার থেকে শরদ পওয়ার-উদ্ধব ঠাকরে-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সিবিআইকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
বগটুই কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফের ইডির তলব শুরু হতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্ত বিরোধী শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতাদের চিঠি পাঠিয়েছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে সিবিআই-ইডিকে কাজে লাগানোর প্রতিবাদে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার ডাক। কিন্তু তৃণমূলের এগারো বছরের রাজত্বে রাজ্যে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোর অভিযোগ কম নয়। বাম জমানা, বা তার আগে কংগ্রেস জমানাতেও পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বিরোধীদের শায়েস্তা করা, তাঁদের অভিযোগ না নেওয়া থেকে ভোটের সময় শাসক দলের কারচুপিতে মদত দেওয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে ছিল। তৃণমূলের জমানায় পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি শাসক দলের হয়ে কাজের অভিযোগ। তৃণমূলের নেতারা নির্দল প্রার্থী হিসেবে পুরভোটে মনোনয়ন জমা দিতে গেলে পুলিশ তাঁদের বাধা দিয়েছে, পুলিশ নিজেই ভোটে জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ। বিরোধী নেতা-সমর্থক, সমাজকর্মীদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগও ভূরি ভূরি। কেন্দ্রে সিবিআইয়ের দোসর ইডি-আয়কর দফতর হলে রাজ্যে উর্দিধারী পুলিশের দোসর সিভিক ভলান্টিয়ার। অপ্রীতিকর কাজ থেকে তোলাবাজির কাজে তাদেরই কাজে লাগানো হয় বলে অভিযোগ। শাসক দলের সমর্থকদের সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ করা হলেও তাঁদের অন্তত দৃশ্যত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা। বাস্তবে, গত কাল যিনি ছিলেন সিভিক পুলিশ, আজ তিনিই ভোটে জিতে তৃণমূলের পুরপিতা। অধুনা বিজেপি নেত্রী ভারতী ঘোষ পুলিশের উর্দি পরেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মা’ বলেছিলেন। সম্প্রতি আর এক পুলিশ অফিসার সিভিক পুলিশদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের মায়ের মতো।
পুলিশের উর্দিতে এ-হেন রাজনীতির রং মুছতেই অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস প্রকাশ সিংহ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ২০০৬-এ সুপ্রিম কোর্ট পুলিশের সংস্কারে একগুচ্ছ নির্দেশ দিয়েছিল। প্রকাশ সিংহ এখনও হতাশ কণ্ঠে বলেন, কোনও রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও সেই রায় পুরোপুরি রূপায়ণ করেনি। স্রেফ লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ হয়েছে। রায়ের নির্দেশ ছিল, পুলিশের ডিজি পদে দু’বছরের মেয়াদ বেঁধে দেওয়া। সুপ্রিম কোর্টের ধারণা ছিল, এতে রাজ্য পুলিশের ডিজি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবেন। শাসক দলের পছন্দমতো কাজ না করলেও পদচ্যুত হওয়ার ভয় থাকবে না। শাসক দল উল্টো পথ ধরেছে। পছন্দের অফিসারকে অবসরের আগে ডিজি পদে নিয়োগ করছেন মুখ্যমন্ত্রীরা। বশ্যতার বিনিময়ে দু’বছরের চাকরির পুরস্কার!
কেন্দ্রীয় সরকারও এর ঊর্ধ্বে নয়। মোদীর খাস লোক বলে পরিচিত রাকেশ আস্থানাকে অবসরের মাত্র তিন দিন আগে দিল্লি পুলিশের কমিশনার পদে নিয়োগ করা হয়েছে। কেন্দ্র ঘুরপথে রাজ্যের ডিজি পদেও নিজের পছন্দমতো লোক বসাতে চাইছে বলে অভিযোগ। নিয়ম অনুযায়ী, ইউপিএসসি আইপিএস-দের বাছাই তালিকা রাজ্যকে পাঠাবে। রাজ্য তার মধ্যে থেকে কাউকে ডিজি নিয়োগ করবে। পশ্চিমবঙ্গ এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। রাজ্যের আর্জি খারিজ হয়ে গিয়েছে।
আনিস খান কাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছিল। রামপুরহাট কাণ্ডে পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ। অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী পড়ুয়া, সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছিল। সেই দিল্লি পুলিশই বিজেপি নেতাদের উস্কানিমূলক বিবৃতি শুনেও কানে তূলো গুঁজে থেকেছে। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হিংসার সময় দিল্লি পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ছিল বলেও অভিযোগ। যার জেরে পরিস্থিতি সামলাতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে রাস্তায় নামতে হয়েছিল।
কিছু দিন আগে দেশের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা বলেছিলেন, আজ যদি পুলিশ শাসক দলের দাসত্ব করে, জমানা বদলালে সেই পুলিশকে খেসারত দিতে হবে। হক কথা। আর পুলিশকে দাস করে রাখা শাসক কবে তার খেসারত দেবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy