Advertisement
০৪ জুলাই ২০২৪
রাজনৈতিক বাস্তবতা একই রয়েছে, প্রমাণ করতে ব্যস্ত বিজেপি
PM Narendra Modi

আক্রমণই কৌশল, এখনও

সব মিলিয়ে অতিআক্রমণাত্মক রাজনীতির যে ‘ট্রেলার’টুকু দেখল দেশবাসী, তার পর্দা উঠবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এনডিএ-র এই তৃতীয় অবতার তাঁর স্বমূর্তি ধরবেন অনতিবিলম্বেই।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ ০৮:১৫
Share: Save:

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী ঠিক সে ভাবেই— দর্পিত আগ্রাসনে। সেই দর্প যদি আহতও হয়, যুদ্ধের ক্ষতদাগ যদি প্রকাশ্যেও আসে, আক্রমণের পথ থেকে তিনি বা তাঁর দল সরবেন না। অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম দিন থেকেই তিনি তা বোঝাতে শুরু করেছেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী শিবিরকে। এবং কিয়ৎপরিমাণে দেশবাসীকেও। আসন কমে ছত্রাকার হয়েছে। রামমন্দির নির্মাণের গৌরবকে বিজেপি আকাশে পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে ধুলোয় মিশিয়েছেন স্বয়ং অযোধ্যাবাসী। বারাণসীতে লজ্জার ছায়াপাত ঘটেছে। উত্তরপ্রদেশে ‘শাহজাদা’রা তাঁকে অকল্পনীয় ভাবে বিদ্ধ করেছেন।

কিন্তু তিনি সেই সৈনিক, যিনি আক্রমণকে শুধু সেরা রক্ষণই মনে করেন না, তাঁর প্রবণতায় আক্রমণাত্মক হওয়া ভিন্ন রাজনীতির অন্য কোনও ভাষা নেই— ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ডন ব্র্যাডম্যানের মতো! লোকসভার ফলাফল প্রকাশের পর এখনও এক মাসও অতিক্রান্ত হয়নি, নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার মতো সাংবিধানিক দায়িত্বকে তিনি নেহাতই ভীরুতা বলে মনে করেন! এই পর্বে এবং সম্ভবত তাঁর শেষ পর্বে তিনি আরও বেশি আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করবেন। বিরোধী কণ্ঠকে রুদ্ধ করার প্রয়াস হবে রাজ্যে রাজ্যে আরও ধারালো ভাবে। কোথাও কোনও নরম বৈষ্ণবতন্ত্র, ‘হর হর মহাদেব’ বলে জনসভায় গর্জন করা প্রধানমন্ত্রীর ধারেকাছেও পাওয়া যাবে না।

সদ্য জিতে সরকার গড়ার পর প্রথম দিনের সংসদ প্রবেশনাট্য সাধারণত শান্তিকল্যাণে ভরা থাকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী সুশাসনের, সমমর্যাদার, গঠনমূলক সংসদীয় আলোচনার, গণতন্ত্রের বাণী দেন। নিজে যা দেখেছি, বাজপেয়ী থেকে গত পর্বের মোদী পর্যন্ত এমনটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এ বার মোদী সংসদে প্রবেশ করার আগেই আক্রমণাত্মক রাজনীতি শুরু করলেন। এক নিশানায় একাধিক পাখিকে তিনি বিদ্ধ করলেন বলা চলে।

প্রথমত, পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থার বিস্তারিত চর্চা করে প্রধান বিরোধী দলের দুর্বলতম স্থানে আঘাত করলেন মোদী। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যদি গোধরা কাণ্ড গুজরাত দাঙ্গা লজ্জাজনক হয়, তবে চুরাশির শিখ দাঙ্গা তার থেকে কণিকামাত্রও কম নয়। এর পর সেটাকেও সামনে আনবেন সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এর কোনওটাই দেখেননি (পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থা বা শিখ দাঙ্গা), কিন্তু তাদের সেই ভাষ্যকে মনে করিয়ে দেওয়ার একটা ‘রাজনৈতিক দায়’ও রয়েছে বিজেপির। দ্বিতীয়ত, তাঁর সরকারের দিকে শুধু দেশ নয়, পশ্চিম থেকেও বার বার অসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পন্নুন হত্যা চক্রান্ত, মণিপুরের অভিযোগ ধেয়ে এসেছে। তাঁর নতুন সরকার এখনও মাস পোহায়নি, আমেরিকার কর্তা অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২০২৩ সালের ধর্মীয় স্বাধীনতা রিপোর্টে প্রকাশ ভারতে ক্রমবর্ধমান ঘৃণাভাষণ এবং ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছেন। বিজেপি নেতৃত্বের এখন প্রয়োজন, একটি পাল্টা ভাষ্যকে সামনে নিয়ে আসা, দেখানো যে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছিল আসলে কংগ্রেস নেতৃত্ব। তুলনায় নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালকে যাতে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ দেখায়।

এর পর তৃতীয় উদ্দেশ্য, যা মতান্তরে প্রকৃত উদ্দেশ্য। সংবিধানের প্রতি মোদী সরকারের সম্মান এবং শ্রদ্ধাকে উজ্জ্বল করে দেখাতে আরও একটি পাল্টা ভাষ্য বা ‘কাউন্টারন্যারেটিভ’ তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে এনডিএ সরকারের। তার কারণ, নির্বাচনের আগে মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের তফসিলি জাতি, জনজাতি, দলিত, পিছড়ে বর্গ অধ্যুষিত জনপদে কংগ্রেস, এসপি, উদ্ধব শিবসেনা-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল মানুষের কাছে পৌঁছে এটা সফল ভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল, ‘চারশো পার’-এর স্লোগান দেওয়া এই বিজেপি আসলে মহাশক্তিশালী হয়ে উঠতে চাইছে, নিজের মতো করে সংবিধান বদল করে নেওয়ার জন্য। তফসিলি জাতি, জনজাতির সংরক্ষণ নিকেশ করার জন্য। আর তাই প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঢোকার সময় জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ এক বার তুলেই ক্ষান্ত দিলেন না, পাঁচ দিনের মধ্যে মোট পাঁচ বার (তিনি নিজে আরও এক বার, স্পিকার ওম বিড়লা তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায়, রাষ্ট্রপতি দ্রোপদী মুর্মু তাঁর সংসদীয় বক্তৃতায়, উপরাষ্ট্রপতি সেই বক্তৃতার অনুবাদের সময়) জরুরি অবস্থা এবং সংবিধানের অবমাননার কথা তুললেন এবং তোলালেন।

সব মিলিয়ে অতিআক্রমণাত্মক রাজনীতির যে ‘ট্রেলার’টুকু দেখল দেশবাসী, তার পর্দা উঠবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এনডিএ-র এই তৃতীয় অবতার তাঁর স্বমূর্তি ধরবেন অনতিবিলম্বেই। রাষ্ট্রশক্তিতে শাণ দেওয়া, রুটিন বিরোধিতার প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন, অন্য দল ভেঙে (প্রয়োজনে শরিক দল জেডি(ইউ) এবং টিডিপি) নিজেদের সংখ্যা বাড়ানো, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করার যথেষ্ট ইঙ্গিত প্রথম সংসদীয় অধিবেশন থেকেই পাওয়া গিয়েছে। অন্য দিকে, বিরোধীরা এখন আগের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী, ফলে দর্পিত আচরণের সামনে গত লোকসভার তুলনায় তাঁরা ঢের উচ্চৈঃস্বরে আন্দোলন প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। সংঘাত আরও বাড়বে সব মিলিয়ে।

সংঘাত শুধু সংসদের বা দলীয় রাজনীতির ময়দানেই যে বাড়বে, তা তো নয়, বর্তমান সামাজিক এবং অর্থনীতির পরিসরে যে জায়গাগুলিতে চিড় ধরেছে গত পাঁচ বছরে, সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের সংঘাত আরও বাড়বে। অসন্তোষের প্রথম এবং বড় জায়গাটি বেকারত্ব, যুব সমাজের হতাশা যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে তারও ইঙ্গিত মিলছে নিট কেলেঙ্কারির মাধ্যমে। এবং, জাতিভিত্তিক জনগণনার যে আসমুদ্র হিমাচল (সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে) দাবি তৈরি হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে পারা না-পারা নিয়ে সংঘাত। ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে আঞ্চলিক আশা আকাঙ্ক্ষার বিরোধ আরও তীব্র হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। এর পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করে দেওয়ার রাজনীতি কী ভাবে চলবে বা আদৌ চলবে কি না, তা অনিশ্চিত। কিন্তু সামাজিক পরিসরে সক্রিয় মুসলিমবিরোধিতা বাড়লে রাষ্ট্রশক্তি যে মুখ বুজেই থাকবে, তা স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রেও সংঘাত বাড়বে নিঃশব্দে।

২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনী ফলাফলের একটি সম্প্রসারিত ব্যাখ্যা জনমানসে অনেকটাই সাফল্যের সঙ্গে নিজের ক্যাডার এবং জনতার কাছে প্রচার করেছে বিজেপি। তা হল, এই বিশাল জয় পরমাত্মার, আধ্যাত্মিক এক শক্তির ইচ্ছায়, মোদী যার অবতার। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে এই ব্যাখ্যা হয়তো চোখে পড়েছে বেশি, কিন্তু তার ভিত্তি এক দিনে তৈরি করা হয়নি। ইউপিএ সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে দেশবাসী পরিবর্তন খুঁজেছিলেন ২০১৪ সালে। কিন্তু সেই জয়কে বিভিন্ন প্রিজ়মে রেখে তার তত্ত্বায়ন করা হয়েছে দশ বছর ধরে। তখনও পরমাত্মার নির্দেশ, হিন্দুত্বের জয়, কখনও জাতীয়তাবাদের জাগরণ, অথবা নতুন ভারতের বোতলে ভরা হয়েছে নির্বাচনী ফলাফলকে। এ বারেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পাওয়া বিজেপির প্রচার-চিন্তায় খুব একটা বদল আসবে বলে তো মনে হয় না। তারা মানতে চাইছে না যে, এই জনাদেশ আসলে কুশাসন, হিন্দুত্বের ঔদ্ধত্যে ভোটারকে গবাদি পশু ভাবা, জীবনযাপনের মৌলিক প্রশ্নগুলিকে অবজ্ঞা করার বিপক্ষে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ফলাফলের পরেও এই দর্প, ২০৪৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার নির্ঘোষ, আগামী এক হাজার বছরের আগাম ঘোষণার কল্প-বৈজ্ঞানিক আস্ফালন।

হারের মুখ থেকে কোনও মতে জয়কে ধরে রাখতে পারা বিজেপি, আপাতত রাজনৈতিক বাস্তবতা যে একই রয়েছে সেটাই প্রমাণ করতে অতি ব্যস্ত। ফলে তাদের স্মরণে থাকছে না, হাই ভোল্টেজ জাতীয়তাবাদ অথবা বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন, অতি সাময়িক ভাবে ব্যথাহরা বড়ি হিসাবে জনতার মনে কাজ করতে পারে মাত্র। কিন্তু জয়ের দর্প একই ভাবে ধরে, মাটির বাস্তবতা আবারও ভুলে গেলে, সমাজ-রাজনীতির পরিসর আগামী দিনে আরও কর্কশ, ঘৃণাপূর্ণ এবং অন্তঃসারশূন্য হয়ে উঠবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

PM Narendra Modi India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE