—ফাইল চিত্র।
বিলকিস বানোর বয়স ৪১। ভারতের স্বাধীনতার বয়স ৭৬। একটি স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র কী ভাবে ধর্ষিত হয়, এ দেশ তা হাড়েমজ্জায় জানে। আর বিলকিস তা জেনে গিয়েছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। তাঁকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তারা একই মহল্লার মানুষ। যাদের আমরা প্রতিবেশী বলি। আত্মীয়স্বজন পরে, বিপদে-আপদে এই প্রতিবেশীদেরই আগে এগিয়ে আসার কথা। উৎসবের দিনে এই পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গেই খাবার ভাগ করে খাওয়া হয়।
কিন্তু এ রকম চেনা মুখেরা যে বহু সময় অচেনা হয়ে যায়, তা-ও তো আমরা ঢের জানি! তবে, বিলকিস তা জেনেছেন অনেক মূল্য দিয়ে! তাঁর মহল্লায় আগুন ধরিয়ে, বিলকিসের অন্তত ১৪ জন আত্মীয়কে খুন করা হয়, যাদের মধ্যে তাঁর তিন বছরের মেয়েও ছিল। তাকে আছড়ে মেরে ফেলে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, ২১ বছরের এই তরুণীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। ভয়াবহ অত্যাচারের জেরে তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তার পরে কী ভাবে তিনি পালিয়ে বাঁচেন, থানায় অভিযোগ দায়ের করেন, গুজরাতের পুলিশ-প্রশাসন কী ভাবে সেই অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়, সে কাহিনি আমরা অনেকেই জানি।
বিলকিসের এই কাহিনি ভারতীয় গণতন্ত্রে এক চিরকালীন কলঙ্কজনক ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে। যাঁরা ইতিহাস ভোলাতে চান, ইতিহাসকে পাল্টে দিতে চান, তাঁরা চেষ্টা করেও গুজরাতের ২০০২ সালের কাহিনি ইতিহাস থেকে মুছতে পারবেন না।
কিন্তু এখানে একটি ভিন্ন প্রসঙ্গের উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০০৮ সালের ২১ জানুয়ারি মুম্বইয়ে বিশেষ সিবিআই আদালত ওই ঘটনায় ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তাদের এক জন পরে মারাও যায়। বাকি ১১ জন আসামির মধ্যে এক জন তাকে রেহাই দেওয়ার আর্জি জানায় সুপ্রিম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালত শেষে তা বিবেচনা করতে বলে গুজরাত সরকারকে। কারণ, অপরাধস্থল ছিল গুজরাত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কমিটি ১১ জন বিচারপ্রাপ্ত আসামিকেই মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মাত্র এক জনকে মুক্তির সিদ্ধান্ত যদি নেওয়াও হয়, প্রশ্নটা হল, বাকি ১০ জনের ক্ষেত্রেও সেই একই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হল কেন? বাকি দণ্ডিত আসামিরা তো মুক্তির জন্য আবেদন জানায়নি?
গোটা ঘটনায় তীব্র আপত্তি তুলেছেন উচ্চপদস্থ বেশ কয়েক জন প্রাক্তন আমলা। ‘কনস্টিটিউশনাল কন্ডাক্ট গ্রুপ’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৩৪ জন প্রাক্তন আমলা সুপ্রিম কোর্টকে খোলা চিঠি লিখে গুজরাত সরকারের এই ‘ভয়ঙ্কর ভুল সিদ্ধান্ত’ সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন। ওই আমলারা তাঁদের লেখা খোলা চিঠিতে ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহ ঘটনার পুনরুল্লেখ করেছেন।
তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেই দিন শুধু বিলকিসই নন, সঙ্গে তাঁর মা ও আরও তিন মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকেন অচেতন বিলকিস। পরে সেখান থেকে আট জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। বাকি ছ’জন নিখোঁজ হয়ে যান। অচেতন বিলকিসের সঙ্গেই বেঁচে থাকেন শুধু এক বৃদ্ধ ও তিন বছরের একটি মেয়ে। তার পরেও ভয়ঙ্কর হুমকির মধ্যে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ও ক্ষতবিক্ষত একটি মেয়ে তাঁর নির্যাতনকারীদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে যে ভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, তা সাহসিকতার এক অবিস্মরণীয় কাহিনি।
গোধরা জেল থেকে বেরিয়ে বীরের সম্মান পায় ধর্ষক ও গণহত্যাকারীরা। মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে তাদের বরণ করা হয়। যে সনাতন ভারতীয় সমাজের সগর্ব ঘোষণা আজকাল প্রায়শই শুনতে পাওয়া যায়, সেই সমাজে কি ধর্ষকদের এ রকম সম্মান ছিল? তৎকালীন সামাজিক অনুশাসন কি এমন ঘটনার অনুমোদন দিত? তা হলে এখানে ব্যতিক্রম ঘটল কেন? যাঁরা এদের এ-হেন সম্মান দিলেন তাঁদের সামাজিক ভ্রুকুটি বা বিরোধিতার ভয় নেই? যাঁরা অত্যাচারিত হয়েছেন, খুন হয়েছেন, প্রতিহিংসার তীব্রতায় নিজ দেশে বারংবার পরবাসী হয়েছেন, তাঁদের কথা ছেড়েই দিন। তাঁরা তো আবার ভিন্নধর্মের, সংখ্যালঘু। কিন্তু সংবর্ধনাকারীদের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবেরা? তাঁরাও তো অন্তত প্রকাশ্যে এই ঘটনার নিন্দা করতে পারতেন! বলতে পারতেন? না, যথারীতি সে সব কিছু হয়নি। হয় না। আসলে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তো বিলকিস ও তাঁর পরিবার-পরিজন, তাই তাঁদের উপর অত্যাচার চালানোটা হয়তো ততটা গুরুতর অপরাধ নয়। ধর্ষক ও খুনিদের ব্রাহ্মণ পরিচয় সামনে এনে গৈরিক ভারতের আর এক প্রতিভূ বিজেপি বিধায়ক ওই অপরাধীদের সংস্কারী আখ্যাও দিয়েছেন!
বাকিটা জানে সুপ্রিম কোর্ট। তারা গুজরাত সরকারের কমিটির এই সিদ্ধান্ত মানবে, না কি সেই মুক্তির এই সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিয়ে ওই ১১ জনকে আবার জেলে ঢোকাবে, তার উত্তর স্পষ্ট নয়। তবু এই সামাজিক, আইনি ও রাজনৈতিক শোরগোলের মধ্যেই মৃদুভাষী বিলকিস বানোর কয়েকটা কথা বড্ড কানে বাজে! বিলকিস বলছেন, “গত ২০ বছরের আতঙ্ক আবার আমাকে গ্রাস করল ১৫ অগস্ট, যখন আমি শুনলাম আমার জীবন, পরিবারকে নষ্ট করে দেওয়া ১১টা লোক মুক্তি পেয়ে গেল, আমি আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখনও বোবা হয়ে আছি।”
৪১-এর বিলকিস বানো আতঙ্কে বোবা। কিন্তু ৭৬ বছরের স্বাধীনতা বোবা কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy