কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলি যাত্রা-র প্রথম বাক্যটি প্রবাদপ্রায়: “আলো ক্রমে আসিতেছে।” আলোকিত হতে পারার এই উচ্চাশাই মানবসভ্যতার চালিকাশক্তি। গ্যোয়টে নাকি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “মোর লাইট, মোর লাইট! ওপন দি উইনডো সো দ্যাট মোর লাইট মে কাম ইন।” ‘আরো আলো আরো আলো/ এই নয়নে, প্রভু, ঢালো’— রবীন্দ্র-প্রার্থনার সঙ্গে এই জানলা খুলে দেওয়ার আর্তির ফারাক নেই। পার্থক্য নেই ডাকঘর নাটকের শেষবেলায় রাজার চিঠির প্রতীক্ষারত অমলের ঘরের দরজা-জানলা খুলে দেওয়ার নাটকীয়তার সঙ্গেও।
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় আলো এক ধরনের শক্তি বা বাহ্যিক কারণ, যা চোখে প্রবেশ করলে দেখার অনুভূতি জন্মায়। আলো বস্তুকে দৃশ্যমান করে নিজে অদৃশ্য থাকে, তির্যক তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে যায়, এবং মাধ্যমভেদে বেগের পরিবর্তন হয়। সে যা-ই হোক, নিবিড় ঘন আঁধারে উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো আলোই প্রাণিকুলের সান্ত্বনা। মনকে পাথারে দিশেহারা, বিষাদে ম্রিয়মাণ না-হতে বলতে পারার অবলম্বন। আলো মানে খারাপ থেকে ভাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের পেট চিরে নবজাগ্রত আধুনিকের ভূমিষ্ঠতা। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “যখন বাইরে-ভেতরে কোথাও/ আলো নেই,/ তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য/ প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও।”
রবীন্দ্রনাথের গান মানেও আলোয় ভরা এক ভুবন। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত এক আলোয় ধোওয়া নয়ন যেখানে দেখছে সদাই। আলোয় হরা হৃদয় যেখানে জাগ্রত। যেখানে প্রাণের মাঝে আলো নাচে, হৃদয়বীণার মাঝে আলো বাজে। বাংলা আধুনিক গানেও তো আলো আর আনন্দ, এক দিকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়ে ওঠেন “নতুন সূর্য, আলো দাও”, ও পাশে মান্না দে, “অন্তরে অন্তরে দাও আলো দাও, কালিমা-কলুষ যত মুছে নিয়ে যাও।” সলিল চৌধুরী সমাজ বদলের স্বপ্ন-দেখা অগ্রণী সেনানীদের ডাকেন ‘আলোর পথযাত্রী’ বলে।
শারদীয়া উৎসবের চেয়ে কম আলোর স্রোতে ভাসে না শ্যামা-আরাধনার আয়োজন। কিছু বিশেষ জায়গায় তুলনায় আড়ম্বর বেশি। আর আছে বাজি পোড়ানোর ধুম। কালীপুজো তো ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’ আলোর নাচন দেখার উৎসব। কয়েক দশক আগে থেকে কালীপুজো ও তৎসংলগ্ন দিনগুলিতে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ-জনিত সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনা, সতর্কীকরণ, ধরপাকড়, জেল-জরিমানা, গ্রিন ট্রাইবুনাল, আদালত, বাজি বিক্রেতা সংগঠন, শব্দসীমার পরিমাপ ইত্যাদি বহুল আলোচিত। বাজির কথা যদি ছেড়েও দিই, আলো দূষণও কি শুধু কালীপুজো বা বিশেষ কোনও উৎসবের দিনেই হয়! ফিলামেন্ট-নির্ভর বাল্ব-এর হলদেটে আলোর চেয়ে এলইডি-র সফেদ আলোর উজ্জ্বলতা বহু গুণ, শহরের মোড়ে-মোড়ে, জায়গায়-জায়গায় ‘হাই মাস্ট’ বাতিস্তম্ভ। আগে পার্ক স্ট্রিট সেজে উঠত বড়দিনে, এখন সেই সাজ পরেই তাকে থাকতে হয় প্রায় সম্বৎসর। নিউ টাউন-রাজারহাটের ‘বিশ্ববাংলা সরণি’তে সাধারণ সময়েও হঠাৎ করে চলে এলে শহরে দুর্গাপুজো হচ্ছে ভেবে বসা অস্বাভাবিক নয়, কারণ তার সর্বাঙ্গের আলোর সজ্জা খোলা হয় না। কে বহন করে এই বিপুল খরচ! যে-ই করুক, টাকাটা জনগণের। বিদ্যুৎ মাসুল, জিএসটি তাঁদেরকেই দিতে হয়। পথবাতির স্তম্ভগুলিও ক্ষেত্রবিশেষে যে দূরত্ব রেখে বসানো হয়, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে
ব্যবধান বেশি রাখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না, কে বোঝাবে!
নিন্দুকরা বলেন রাজ্যে শিল্প নেই। বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত, অন্য রাজ্যের ক্রেতা সুলভ নয় সব সময়। বিদ্যুৎ মাসুলও এ রাজ্যে সারা দেশের মধ্যে চড়া। অথচ সন্ধে না হতেই আলোয় সব কিছু ধুয়ে দেওয়ার কমবেশি আয়োজন রাজ্য জুড়ে। তাতে কুলায় ফিরে আসা পাখিদের কাঙ্ক্ষিত অন্ধকার মুছে যাক, অচেনা অসহায়তায় পরিত্রাণহীনতা নিদ্রাহীনতা তাড়া করুক তাদের, কার দায় সে খবর রাখার! কার কী যায় আসে, যদি এক জোড়া কপোত-কপোতীর থেকে কেড়ে নেওয়া হয় কড়ি-বরগার আবডাল! কিনু গোয়ালার গলিতে সান্ধ্য-সোহাগে কাছাকাছি আসার অবকাশ পেত ব্যক্তিগত পরিসর কেনার ক্ষমতাহীন এক জোড়া কপোত-কপোতী, রাস্তায় কোনও বাতি ছিল না, কে বা কারা যেন ঢিল মেরে বার বার ভেঙে দিয়ে যেত টিমটিমে আলো। আলো খুব দরকার। তবে অতটাও দরকার নেই, যখন বাঁশবাগানের মাথার উপরে বা ইলেকট্রিকের তারে ঝুলতে থাকা চাঁদ দেখার ন্যূনতম নিবিড়তাটুকু উধাও হয়ে যায় বেমালুম। যানবাহনের আলোর এমন চোখ-ধাঁধানো উজ্জ্বলতা কি কাম্য, যা বিহ্বল করে দেয় রাস্তা পেরোতে চাওয়া পথিককে! আলো খুব দরকার, কিন্তু রাতে পৃথিবীকে তাপ বিমোচনের সবচেয়ে বেশি সুযোগ করে দেওয়াও কি দরকার নয়? নইলে বছরে এক দিন ‘পৃথিবী দিবস’ বলে দু’-এক মিনিট ঘরের আলো নিভিয়ে রাখতে গৃহস্থকে অনুরোধ জানিয়ে কী লাভ!
‘এত কবি কেন’ বলে একদা মহা গোল বাধিয়েছিলেন এক বঙ্গকবি। এত আলো কেন— মহানগর, শহরতলি আর মফস্সল শহরগুলোরও নিরিখে এই কথা বলার সময় কি এখনও আসেনি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy