প্রশাসক: সাঁচী স্তূপে খদিত সম্রাট অশোকের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস।
এনসিইআরটি-র ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকেও বাদ পড়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মৌর্য সম্রাট অশোকের দ্বাদশ মুখ্য শিলালেখর বিবরণ এবং অশোকের লেখগুলির আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে জওহরলাল নেহরুর উক্তি। নেহরু-যোগই কি অশোকের লেখকেও করে তুলল পরিত্যাজ্য? কেনই বা প্রজাতান্ত্রিক ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক এক রাজার নামাঙ্কিত স্তম্ভ ও চক্র?
প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে মৌর্যদের মতো বিশাল সাম্রাজ্য আর গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাকে রাজনীতি বোধহীন, ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতা হিসাবে দেখতে চাওয়া ঔপনিবেশিক লেখকরা আফগানিস্তান থেকে বাংলা, কাশ্মীর থেকে কর্নাটক পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যের উত্থানকে তাই দেখতে চেয়েছিলেন আলেকজ়ান্ডারের হস্তক্ষেপের ফল হিসাবে। গ্রিক বিবরণে আছে তরুণ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও আলেকজ়ান্ডারের সাক্ষাতের কথা। জেমস মিল তাই মনে করেছেন যে, ‘অযোগ্য’ চন্দ্রগুপ্তকে সম্রাট বানিয়েছেন আলেকজ়ান্ডারই। জেমস হুইলার, ভিনসেন্ট স্মিথদের লেখায় আলেকজ়ান্ডারের ক্ষণস্থায়ী ও উত্তর-পশ্চিমে সীমাবদ্ধ আক্রমণ অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ১৩৭ বছরের মৌর্য শাসনের চেয়ে। মৌর্য সম্রাট অশোক, স্মিথের বর্ণনায় হয়ে উঠেছেন ধর্মকেন্দ্রিক ভারতীয় সভ্যতার প্রতিভূ, যুদ্ধ ও রাজনীতি থেকে সরে আসা এক প্রায়-সন্ন্যাসী ধর্মপ্রাণ, অরাজনৈতিক বৌদ্ধ।
অশোককে নিয়ে বৌদ্ধ কিংবদন্তি বহু। কিন্তু এগুলির সৃষ্টি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, অশোকের সময়ের বহু পরে। বৌদ্ধধর্মের দুই প্রধান শাখা থেরবাদী ও মহাযানদের বিবরণে অশোকের কিংবদন্তিও দু’রকমের। থেরবাদী সিংহলের দীপবংস ও মহাবংস-এ (খ্রিস্টীয় চতুর্থ-ষষ্ঠ শতক) অশোকের মর্যাদা অপরিসীম। কারণ বৌদ্ধ সঙ্ঘে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটাতে আয়োজিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে থেরবাদকে স্বীকৃতি দেন তিনি। এই পরম্পরার সত্যতা প্রমাণিত সারনাথ, সাঁচী ও কৌশাম্বীতে স্তম্ভগাত্রে খোদিত অশোকের নির্দেশে, যেখানে অশোক সঙ্ঘের শৃঙ্খলা না-মানা সন্ন্যাসীদের বহিষ্কারের হুমকি দেন। তা ছাড়া, সিংহলে বৌদ্ধধর্ম ছিল রাষ্ট্রধর্ম। অশোকের সমসাময়িক রাজা দেবানামপিয় তিস্সকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন অশোকের পুত্র মহিন্দ। তাই এই পরম্পরায় অশোক এক আদর্শ রাজা। রক্তক্ষয়ী উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে রাজা হলেও, তিনি নিরন্তর ব্যস্ত থেকেছেন আধ্যাত্মিক সত্যসন্ধানে। রাজা হওয়ারও আগে, উজ্জয়িনীর প্রাদেশিক শাসক অশোককে বৌদ্ধ জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত করেছেন তাঁর প্রথম প্রেমিকা— বিদিশার বণিককন্যা দেবী। ভ্রাতৃহন্তা অশোকের রানি হতে পাটলিপুত্রে যাননি দেবী, রাজনীতি থেকে দূরে বৌদ্ধ আদর্শে বড় করেছেন তাঁর দুই প্রেমজ সন্তান মহিন্দ ও সঙ্ঘমিত্তাকে। অবশেষে অশোক বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় নিলে তাঁরাই তাঁর দূত হয়ে গেছেন সিংহলে।
অন্য দিকে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ রচিত উত্তর ভারতের মহাযান কিংবদন্তি অশোকাবদান-এর লেখকের কাছে অশোক এক দিকে বৌদ্ধ সঙ্ঘের শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক, অন্য দিকে প্রতিদ্বন্দ্বী থেরবাদের সমর্থক। অশোকাবদান ব্যক্তি অশোকের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে বৌদ্ধধর্মের মহিমাপ্রতিষ্ঠার আখ্যান। চণ্ডাশোক এখানে এক নৃশংস শাসক, যাঁর গণহত্যার বলি হন কখনও তাঁর ভাইয়েরা, কখনও মন্ত্রীরা, কখনও রানিরা। নির্যাতনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলে তাঁর কারাগারে। বৌদ্ধধর্ম তাঁর হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটালেও সে পরিবর্তন সাম্প্রদায়িক। এক দিকে হাজার হাজার স্তূপ নির্মাণ করেন অশোক, অন্য দিকে নির্বিচারে গণহত্যা করেন বিধর্মী আজীবিক ও জৈনদের। শেষ বয়সে বৃদ্ধ, অসুস্থ সম্রাট হয়ে ওঠেন বৃদ্ধ বয়সের তরুণী স্ত্রী তিষ্যরক্ষিতার নিয়ন্ত্রণাধীন। অবশেষে তিষ্যরক্ষিতা অশোকের প্রিয় পুত্র কুণালকে অন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলে, অশোক মৃত্যুদণ্ড দেন তাঁকেও। ভগ্নহৃদয়, ব্যর্থ সম্রাট প্রায়শ্চিত্ত খোঁজেন বৌদ্ধসঙ্ঘকে অকাতর দানে। একদা যে রাজ্যের জন্য নৃশংস লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই রাজ্য নির্দ্বিধায় দানের কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে পার্থিব সম্পদের অনিত্যতার বৌদ্ধ শিক্ষা, রাষ্ট্রের উপর সঙ্ঘের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি। পাঁচ শতাব্দী আগের রাজার ইতিহাস সেখানে সামান্যই।
সৌভাগ্যক্রমে অশোকের আত্মকথন ও প্রশাসনিক নির্দেশ খোদিত আছে তাঁর লেখমালায়। অশোকের গৌণ লেখসমূহতে ব্যক্তি অশোকের ধর্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে— তিনি বৌদ্ধসঙ্ঘের শৃঙ্খলারক্ষা করেন, পড়তে বলেন নির্দিষ্ট বৌদ্ধসাহিত্য, তীর্থযাত্রা করেন নেপালি তরাইয়ের গ্রামগুলিতে। কিন্তু, লেখমালার রচয়িতা অশোক অশোকাবদান-এর ধর্মান্ধ বৌদ্ধ রাজা নন। তাঁর চোদ্দোটি মুখ্য শিলালেখ ও ছ’টি (স্থানবিশেষ সাতটি) মুখ্য স্তম্ভলেখ অশোক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গোটা উপমহাদেশ জুড়ে। এগুলিতেই অশোক সরাসরি জানিয়েছেন তাঁর নতুন শাসননীতির কথা— যার নাম ‘ধম্ম’। ধম্মের আলোচনায় অশোক এক বারও উচ্চারণ করেন না বৌদ্ধদর্শনের ভিত্তিস্বরূপ চারটি আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, নির্বাণ লাভের কথা। ধম্মনীতি গ্রহণের কারণও বৌদ্ধধর্ম নয়, কলিঙ্গযুদ্ধের রক্তস্রোত। রাজাদের কীর্তিকাহিনিতে যুদ্ধজয় সাধারণত হয় গৌরবসূচক। ত্রয়োদশ মুখ্য শিলালেখতে কলিঙ্গজয়ী অশোক নেন বহু মানুষের মৃত্যু, দেশান্তর, যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার। জানান, আর যুদ্ধ নয়। রণভেরি নয়, ধম্মভেরি। একটিমাত্র যুদ্ধের রক্তপাতে ব্যথিত সম্রাটের স্বরে ভেঙে পড়ে তাঁর নৃশংসতার অবদানকাহিনি (যা অবশ্যই কলিঙ্গযুদ্ধের উল্লেখ করে না)। অশোকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান স্তম্ভলেখ শোনায় হিংসা, নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, অহঙ্কার, ঈর্ষা বর্জনের কথা। ধম্মের নীতি হিসাবে উল্লিখিত হয় অধর্মহ্রাস, কল্যাণবৃদ্ধি, দয়া, দান, সত্য, ও পবিত্রতা। সম্প্রদায়নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য ধম্মনীতির অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের সম্মানপ্রদর্শন, মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধা, এমনকি দাস ও ভৃত্যদের সঙ্গে সৎ ব্যবহারও।
প্রধান লেখগুলির ভিত্তিতে রোমিলা থাপর দেখান যে, ধম্ম ধর্মান্ধ শাসকের কল্পনাবিলাস নয়, এক বিচক্ষণ সম্রাটের প্রশাসনিক পদক্ষেপ, যা দমননীতির বদলে আদর্শগত ঐক্যসূত্রে বাঁধতে চেয়েছে বিশাল, বৈচিত্রপূর্ণ সাম্রাজ্যকে, গড়তে চেয়েছে উপমহাদেশব্যাপী নৈতিক সমাজ। তাই উত্তরসূরিদের যুদ্ধ এড়ানোর উপদেশ দিয়েও অশোক বলেছেন প্রয়োজনে ন্যূনতম নৃশংসতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। শৃঙ্খলারক্ষার্থে জনসমাগমপূর্ণ সামাজিক উৎসব নিষিদ্ধ করেছেন, বহাল রেখেছেন কঠোর গুপ্তচরব্যবস্থা। অরণ্যবাসীরা সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা করার হুমকিও দিয়েছেন। তবুও, নয়নজ্যোৎ লাহিড়ী দেখান, অশোকের বিরল নৈতিকতায় স্থান পেয়েছে প্রজার সঙ্গে সংযোগরক্ষার দায়িত্ব, প্রান্তিক মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা, আইন ও বিচারে সমানাধিকার, বৃক্ষরোপণ, বন ও প্রজাতি সংরক্ষণ, প্রাণিহত্যা নিয়ন্ত্রণ, মনুষ্যেতর প্রাণীর উপর নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা। অশোকের সারনাথ স্তম্ভের শান্ত, গাম্ভীর্যপূর্ণ সিংহের নতুন অবতারে দাঁতমুখ খিঁচোনো হিংস্রতা তাই বড়ই বেমানান।
ধর্মীয়, ভাষাগত, লিপিগত বৈচিত্রকে স্বীকার করেই আদর্শগত ঐক্যনির্মাণে সচেষ্ট হন অশোক, যা প্রভাবিত করে ভারতের ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-তে বিশ্বাসী নেহরুকে। আফগানিস্তানে অশোকের সাতটি লেখর ভাষা তাই প্রাকৃতের বদলে গ্রিক ও আরামীয়। উত্তর-পশ্চিমে ব্রাহ্মীলিপির স্থান নিয়েছে খরোষ্ঠী। ‘ধম্মমহামাত্র’ নামক আধিকারিকদের দায়িত্ব ছিল বৌদ্ধ শ্রমণ, ব্রাহ্মণ, আজীবিক, জৈন সবার তত্ত্বাবধানের। অশোকের সমন্বয়ী ভাবনা মৌর্য সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও সেলুকাসের সন্ধি ভারতীয় ও গ্রিকদের বৈবাহিক সম্পর্ককে বৈধতা প্রদান করে। সফিস্টদের এবং আজীবিকদের নিয়ে আগ্রহ ছিল চন্দ্রগুপ্তের পুত্র বিন্দুসারের। বরাবর ও নাগার্জুনী গুহালেখ সাক্ষ্য দেয় আজীবিকদের প্রতি বিন্দুসার-পুত্র অশোক ও তাঁর উত্তরসূরি দশরথের গুহাদানের। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর অবশ্য কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তি এই লেখগুলি থেকে মুছে দিতে চেষ্টা করেছিল আজীবিকদের প্রতি মৌর্য পৃষ্ঠপোষকতার সাক্ষ্য। পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়া দ্বাদশ মুখ্য শিলালেখতে অশোক বলেন: “অন্য সম্প্রদায়কেও সর্বতোভাবে সম্মান করতে হবে... যে... নিজের সম্প্রদায়কে মহিমান্বিত করার জন্য নিজের সম্প্রদায়ের প্রশংসা ও অন্য সম্প্রদায়গুলির নিন্দা করে, সে নিজের সম্প্রদায়েরই সমূহ ক্ষতি করে।” বর্তমান শাসকরা এ শিক্ষা ভোলাতে চাইবেন বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy