Advertisement
১১ অক্টোবর ২০২৪
Durga Puja 2024

সকল প্রাণের ধাত্রী

দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহন দুর্গাপূজাকে প্রান্তবাসীয় শবরদের উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। জয়দুর্গা, বনদুর্গা প্রভৃতি দুর্গার লৌকিক কল্পনার সঙ্গে আরণ্যক জীবনের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

আর্বিভূতা: দেবী শাকস্তরী, মর্তজনে শস্যসম্পদ দিচ্ছেন।

আর্বিভূতা: দেবী শাকস্তরী, মর্তজনে শস্যসম্পদ দিচ্ছেন।

অমিতাভ পুরকায়স্থ
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৪০
Share: Save:

সমাজবিজ্ঞানী ও সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, আদিম মানবগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত মাতৃকা-আরাধনার ধারা কৃষিকাজ আবিষ্কারের পর শস্য কামনার ধর্মাচারে মিশে দুর্গার পৌরাণিক রূপ তৈরি করেছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণেই দেবী নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ‘শাকম্ভরী’ নামে। দেবীমাহাত্ম্য অংশে নিজের শরীর থেকে উৎপন্ন শাকপত্রাদি দিয়ে জগৎ প্রতিপালনের কথাও বলছেন। দেবীর এই রূপকল্পনার পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার একটি সিলমোহরে। সেখানে নারীর জরায়ু থেকে শস্যগুচ্ছ উৎপন্ন হওয়ার চিত্র থেকে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার সময়েও শস্যদায়িনী রূপেই মাতৃকাদেবীর কল্পনা করা হয়েছিল। তাই পুরাণ এবং ইতিহাসের মধ্যে শস্যদেবীর রূপক নিয়ে তেমন বিতর্ক দেখা যায় না।

অন্য দিকে, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহন দুর্গাপূজাকে প্রান্তবাসীয় শবরদের উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। জয়দুর্গা, বনদুর্গা প্রভৃতি দুর্গার লৌকিক কল্পনার সঙ্গে আরণ্যক জীবনের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। বস্তুত দুর্গার শাকম্ভরী রূপকল্পনা অরণ্যচারী প্রকৃতির সন্তানদের জীবনযাপন ও উপাসনার কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতি উপাসনার এই প্রাচীন ধারায় পরিবেশ নিয়ে ধারণা বা বোধ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের নানা বিষয় স্বাভাবিক ভাবেই জায়গা করে নিয়েছিল। দুর্গাপূজায় বেশ কিছু আচার ও রীতি আমরা আজও পালন করি, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত পরিবেশ চেতনার বার্তাটি উৎসবের শোরগোলে অনেকটাই হারিয়ে যায়।

এই জাতীয় রীতিগুলির মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে শাকম্ভরী রূপকল্পনা ও নবপত্রিকা পূজার কথা। রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব গ্রন্থ অনুসারে এই নয় উদ্ভিদ হল— “কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মাণকং কচুঃ।/ বিল্বোঽশোকো জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা।” এই উদ্ভিদগুলি শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় শাড়িতে জড়িয়ে অবগুণ্ঠিতা বধূর আকার দেওয়া হয়। লৌকিক বয়ানে কলাবৌ বলা হলেও, নয়টি উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি এই নবপত্রিকা দুর্গার নয়টি রূপের প্রতীক। প্রতিটি উদ্ভিদে দেবীর এক-একটি রূপের অধিষ্ঠান। যেমন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রাহ্মণী, কচুতে অধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা ইত্যাদি। এই উদ্ভিদগুলির মধ্যে ধান, কলার মতো পুষ্টিগুণসম্পন্ন, এবং অশোক ও হলুদের মতো ঔষধের গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের অস্তিত্ব নজরে পড়ে। বছরে যে দু’বার দুর্গাপূজা করা হয়, অর্থাৎ বসন্ত ও শরৎ— দুই সময়েই মরসুম বদলের সময় রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। দেবীর উদ্দেশে ‘হর রোগং হর শোকং’ প্রার্থনার সঙ্গেই পুষ্টি ও বনৌষধি সংক্রান্ত জ্ঞানের সাহায্যে সমাজকে নীরোগ রাখার এই প্রয়াসে বৃহত্তর পরিবেশ সচেতনতা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না।

এই সূত্রেই আসে মহাস্নানে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের উপাদানের প্রসঙ্গ। মহাপূজায় ছোট-বড় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি, ধরিত্রীমাতার বুকে ক্ষুদ্র উইপোকা থেকে মহাকায় হাতি পর্যন্ত সমস্ত প্রাণের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয় মহাস্নানে বল্মীক মৃত্তিকা, বরাহদন্ত মৃত্তিকা, অশ্বদন্ত মৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকার ব্যবহার। সমগ্র জীবমণ্ডলের অস্তিত্বের স্বার্থে নদী, সমুদ্র, হ্রদ, পুকুর, কুয়ো-সহ সব রকমের জলাশয় সংরক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহাস্নানের এই কৃত্য। পূজা-উপচারের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের চিহ্ন খুঁজতে গিয়ে মহাস্নানের উপাদানগুলির মধ্যে বৃষ্টির জলের উপস্থিতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূজার সময় সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তা হলে বৃষ্টির জল নিশ্চয়ই শেষ বর্ষায় সংগ্রহ করা হত। এর মাধ্যমে কি এই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে? প্রাচীন ভারতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে ব্যবহারের নানা উদাহরণের কথা মাথায় রাখলে, এমনটা ভাবা কষ্টকল্পনা বলে বোধ হয় না।

কৃষিভিত্তিক সমাজে আরও একটা বিষয়ে সংরক্ষণের গুরুত্ব জীবন-জীবিকা ও পরিবেশকে একসূত্রে গেঁথে রাখে। সেটা হল বীজ সংরক্ষণ। ছোট ছোট ঘটের মধ্যে ‘সপ্তধান্য’— ধান, যব, গম, তিল, কঙ্গু, শ্যামক, চিনা ঘাসের দানা উৎসর্গের রীতিকে বীজ সংরক্ষণের ইঙ্গিত হিসাবে দেখা যেতে পারে। পূজার আচারে লুকিয়ে থাকা এই বার্তা ঠিক ভাবে অনুসরণ করলে হয়তো আমরা বাংলার বহু দেশীয় প্রজাতির শস্যকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারতাম।

দেবীপূজার নানা আঙ্গিকে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপস্থিতির মধ্যে নৃতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন আদিম জনগোষ্ঠীর কুলপ্রতীক বা ‘টোটেম’-এর স্মৃতি খুঁজে পেয়েছেন। দুর্গামূর্তি নির্মাণ ও আরাধনায় ধানের ছড়া, কলাগাছ, পদ্ম ইত্যাদি উদ্ভিদ ছাড়াও দেবদেবীর বিভিন্ন বাহনের মধ্যে মানুষের শিকারি-সংগ্রাহক অস্তিত্ব থেকে শুরু করে কৃষিভিত্তিক সমাজ পত্তন পর্যন্ত বিবর্তনের লম্বা ইতিহাস ধরা রয়েছে। কৃষি উৎপাদনকে খাদ্যশৃঙ্খলের সর্বনিম্ন স্তর ধরলে দেখা যায়, শস্য খেয়ে জীবনধারণ করা ইঁদুর থেকে শুরু করে সাপ, পেঁচা, ময়ূর হয়ে সেই খাদ্যশৃঙ্খলের একেবারে শীর্ষে থাকা বাঘ বা সিংহ— সকলেই দুর্গাপ্রতিমার ধারণা ও কাঠামোর অংশ। আমরা জানি, দুর্গাপূজার অংশ হিসাবে সমস্ত বাহনও পূজা পাওয়ার অধিকারী। বাস্তুতন্ত্রে সমস্ত প্রাণীর নিজস্ব গুরুত্ব বোঝানোর এমন স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল পাঠ শাস্ত্রকাররা সেই কবেই দিয়ে রেখেছেন।

প্রকৃতি ও পরিবেশচিন্তার একটি দিকে যদি থাকে সংরক্ষণ ও সহাবস্থান, তবে অন্য দিকে রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দেবীর আগমন ও গমনের বাহনের উপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টাও শারদোৎসবে অঙ্গীভূত হয়েছে। কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও, বাংলার সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন— হাতিতে চড়ে দেবীর যাওয়া-আসা বসুন্ধরাকে শস্যপূর্ণ করে। ঠিক সে ভাবেই দোলায় মড়ক, নৌকায় প্লাবন আর ঘোড়ায় নিহিত থাকে অরাজকতা তথা নৈরাজ্যের পূর্বাভাস।

প্রতিমা নির্মাণের প্রথাগত শৈলীটিও পরিবেশবান্ধব। কাঠের কাঠামোর উপর খড় বেঁধে তৈরি হয় প্রতিমার মূল আকৃতি। তার উপর কয়েক স্তরে মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি হয় সপরিবার দুর্গামূর্তি। এ ভাবে খড়, ধানের তুষ বা তেঁতুলবীজের মতো কৃষি-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার হয়। আগে শিল্পীরা ব্যবহার করতেন ভেষজ রং। প্রতিমার অলঙ্কারও তৈরি হত মাটি বা শোলা দিয়ে। প্রতিমা নির্মাণে ব্যবহৃত সব জিনিস বিসর্জনের পর প্রকৃতিতে মিশে যেত। একমাত্র কাঠের কাঠামো উদ্ধার করে পরের বছর মূর্তি নির্মাণে আবার ব্যবহার হত। অনেক বনেদি বাড়িতে পারিবারিক কাঠামোতেই মূর্তি গড়ার প্রথা এখনও মেনে চলা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি-দু’টি করে কাঠ বদলাতে হলেও আদি কাঠামোর সঙ্গে একটা যোগসূত্র থেকে যায়। তবে আধুনিক সময়ের দাবি মেনে মূর্তি নির্মাণের প্রাচীন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি আজ প্রকৃতি সংরক্ষণের মূল ভাবনা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে।

সর্বভূতে জগজ্জননীর অস্তিত্বের প্রসঙ্গ যে পূজায় বার বার উল্লিখিত হয়, সেখানে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবজগতের গুরুত্বের কথা স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। কিন্তু এক উৎসব থেকে অন্য উৎসবে ভেসে যাওয়ার মধ্যে আমরা সেই পাঠ কতটা গ্রহণ করতে চাই, সে প্রশ্নটা থেকেই যায় শেষাবধি।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE