—প্রতীকী চিত্র।
সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী এক মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা স্মার্টফোনে বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিন ডিভাইসের মাধ্যমে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা স্ন্যাপচ্যাট-জাতীয় কোনও সমাজমাধ্যমে যুক্ত থাকতে পারবে না। ওই জাতীয় সমাজমাধ্যমে যাদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, অবিলম্বে তা মুছে ফেলে দিদিমণিকে তার স্ক্রিনশট পাঠাতে হবে প্রমাণ হিসাবে।
এই নির্দেশকে অধিকাংশ অভিভাবক স্বাগত জানালেও, ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া মিশ্র। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সমাজমাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে গিয়ে তাদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ যে কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হচ্ছে, অনেক ছাত্রীই এ কথা স্বীকার করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, সমাজমাধ্যমের প্রতি আগ্রহ যে পড়াশোনার ক্ষতি করে, এটা জেনেও ফোনের আকর্ষণ থেকে তারা নিজেদের বিরত করতে পারে না। শিক্ষিকার এই নির্দেশ তাদের কাছে আশীর্বাদের মতো। একটু উঁচু ক্লাসের ছাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বলেছে, শুধু পড়াশোনার স্বার্থে আন্তর্জাল ব্যবহারে তারা বেশ সুফল পেয়েছে, বিশেষ করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে নানা তথ্যের পাশাপাশি সহপাঠীদের সঙ্গে পাঠ্য বিষয়ের আদানপ্রদানে। স্মার্টফোন বা আন্তর্জাল ব্যবহারের ফলে পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তারা মানতে নারাজ।
যারা এমন বলছে তারা হয়তো ব্যতিক্রমী। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ছাত্রছাত্রীদের একাংশ শুধু সমাজমাধ্যমই নয়, নানা অ্যাপভিত্তিক গেম, পর্নোগ্রাফি ভিডিয়ো, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার’সহ নানা খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে শুধু তাদের শারীরিক মানসিক সমস্যারই সৃষ্টি হচ্ছে না, তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, স্কুলে বা পরিবারে বদলে যাচ্ছে তাদের আচার-আচরণও। কয়েক বছর আগে ‘ব্লু হোয়েল’ নামে এক অনলাইন গেমের দৌলতে বিশ্ব জুড়ে বহু তরুণ-তরুণী আত্মহননে প্ররোচিত হয়েছিল, তার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এ দেশেও।
মোবাইলের প্রতি পড়ুয়াদের ক্রমবর্ধমান আসক্তি যে তাদের পড়াশোনা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষা ও গবেষণা তা বলেছে। টেক্সাসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অল্পবয়সিরা মোবাইল ফোনে এক বার আসক্ত হলে তা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। এতে তাদের আত্মসম্মানবোধ ও কর্মক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি, পারস্পরিক সম্পর্ক সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমেরিকান এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোনের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের এই আসক্তির পিছনে রয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সমাজমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ। গবেষণা বলছে, ৯৪% ছাত্রছাত্রী দিনে অন্তত এক বার তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই সব সমাজমাধ্যমে ঢোকে। মনোবিদদের মতে, ‘মোবাইল ফোন ম্যানিয়া’ এক সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা, ‘নোমোফোবিয়া’ (নো-মোবাইল-ফোবিয়া’) হিসাবেও তা চিহ্নিত। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করছেন, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার ধূমপান ও অ্যালকোহল পানের আসক্তির থেকেও বিপজ্জনক। এর ফলে ব্যক্তিগত অসুস্থতা, নিরাপত্তাহীনতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অনিদ্রা, ঘাড় ব্যথা, শুষ্ক চোখ, কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম, বুড়ো আঙুল ও কব্জির দুর্বলতা, দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রবণশক্তির দৌর্বল্য সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ইতিমধ্যেই জনস্বাস্থ্যে মোবাইল ফোন ম্যানিয়ার প্রকোপ বাড়ছে, তাই এখনই তা প্রতিরোধের উদ্যোগ করা বাঞ্ছনীয়।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের কুফল নিয়ে যখন বিশ্ব উদ্বিগ্ন, তারই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দফতর থেকে গত কয়েক বছর ধরে ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের স্মার্টফোন বা ট্যাব কেনার জন্য দশ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়ে আসছে। কোভিডের পরিণতিতে এ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য বিকল্প ‘ডিজিটাল ক্লাস’-এর কথা ভাবা হয়েছিল, শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীরা যাতে ডিজিটাল পড়াশোনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য ২০২১-এ পারিবারিক বার্ষিক আয় অনূর্ধ্ব দু’লক্ষ টাকা, এমন ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই প্রকল্প শুরু হলেও পরবর্তী কালে সকল ছাত্রছাত্রীকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে বিতর্ক ছিলই। করোনা-উত্তরকালে স্কুলগুলিতে নিয়মিত পঠনপাঠন শুরু হওয়ার পরেও ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি মোবাইল বা ট্যাব কেনার টাকা দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এতে মোবাইল-আসক্তি বৃদ্ধির ঝুঁকি তো রয়েছেই, উপরন্তু এই প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম যদি ‘অনুপার্জিত প্রাপ্তি’তে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের নৈতিক বৈকল্যের কারণ হবে।
আধুনিক বিশ্বে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষার্থে বা শিক্ষা-সংক্রান্ত তথ্য আহরণে মোবাইল ফোন জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছাত্রছাত্রীরাও এর বাইরে নয়। তবে ভারতেরই বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্বের সঙ্গে মোবাইল ফোন ব্যবহার, তার অসচেতন ব্যবহারের কুপ্রভাব সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার পর তার যথাযথ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ব্যাপারে লক্ষ রাখাটা অভিভাবকের কর্তব্য।
এই রাজ্যের স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মোবাইলের প্রয়োজনভিত্তিক ব্যবহারবিধি এবং এর বেশি ব্যবহারের কুফল সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy