জঞ্জালের পাহাড়।
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কলকাতা বিমানবন্দরের দিকে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে জঞ্জালের পাহাড়। দুর্গন্ধ, ধুলো আর ধোঁয়ার যন্ত্রণা ওই এলাকার নিত্যসঙ্গী। উত্তর শহরতলির একাংশে বাগজোলা নিকাশি খাল, পলি জমে তারও বেহাল অবস্থা। একই ভাবে, মজে-যাওয়া টালি নালা বা উপচে-পড়া ধাপার মাঠ বুঝিয়ে দেয়, উত্তর থেকে দক্ষিণ— শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা ভাল নয়।
নাগরিকের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত জাতীয় পরিবেশ আদালতও (ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল)। সম্প্রতি পরিবেশ আদালত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার ঘাটতির জন্যে ৩৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আদালত লক্ষ করেছে, রাজ্যে দৈনিক যে পরিমাণ কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার বেশির ভাগটাই কোনও প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই আঁস্তাকুড়ে জড়ো করা হচ্ছে। পরিবেশবিদদের মতে, আবর্জনা খোলা জমিতে ফেলে রাখলে তার থেকে ভূগর্ভস্থ জলে দূষণ ছড়াতে পারে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে পচনশীল আবর্জনা থেকে তৈরি হওয়া দাহ্য মিথেন গ্যাস থেকেও। অন্য দিকে, শহরাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি বর্জ্য জল পরিশোধন হয় না, অপরিস্রুত জল নদীতে সরাসরি মিশে যাচ্ছে। দূষিত নদীগুলির তালিকায় রয়েছে চূর্ণী, মহানন্দা এবং গঙ্গার অংশবিশেষ, যাদের দু’ধারে রয়েছে ঘন জনবসতি, আর কলকারখানা। অথচ, সরকারের তরফ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বারো হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে (পরিবেশ আদালতের ক্ষতিপূরণ এই বরাদ্দের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ)। বিপুল বরাদ্দ সত্ত্বেও বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের এই খামতি কেন?
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, বর্জ্য জল উৎপাদনের পরিমাণ দৈনিক ২৭ কোটি লিটার, যেখানে ১৫ কোটি লিটারের কাছাকাছি বর্জ্য জল পরিশোধনের পরিকাঠামো রয়েছে রাজ্যে। মহেশতলা, বরাহনগর-কামারহাটির মতো পুর এলাকায় বর্জ্য জল পরিশোধনের মাত্রা বাড়ানোর উদ্যোগ করা হয়েছে। কিন্তু পরিশোধন খাতে যতটা জোর দেওয়া হচ্ছে, নিকাশি ব্যবস্থা যেন ততটাই অবহেলার শিকার। ২০১৬ সালের একটি জাতীয় রিপোর্ট অনুসারে, রাজ্যবাসীর ত্রিশ শতাংশ এমন এলাকায় বাস করেন, যেখানে কোনও নিকাশি ব্যবস্থা নেই, যা বড় রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। এঁদের একটা অংশ বাস করেন অবৈধ বসতিতে, যার সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। অর্থাৎ, পয়ঃপ্রণালীর অভাবে পর্যাপ্ত বর্জ্য জলের জোগান পাচ্ছে না বহু বিনিয়োগে তৈরি বর্জ্য জল পরিশোধন কেন্দ্রগুলি। রাজ্যে মোট পরিশোধন ক্ষমতার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এর ফলে অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। রাজ্য সরকারের তথ্য, ১৯৮৩ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে তৈরি ১১টি বর্জ্য জল পরিশোধন কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় অর্ধেক এখন আর কাজ করে না।
হয়তো নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ার একটা কারণ, তার জন্য মাটি কেটে কাজ করতে হয়, অসন্তুষ্ট হন নাগরিকরা। উন্নত নিকাশি ব্যবস্থার সার্বিক সুফল পেতে সময় লাগে। তুলনায় শৌচাগার গঠন সহজ, তা চোখে দেখাও যায়। এই কারণেই হয়তো পুরসভার সদস্য বা কর্তারা নিকাশি ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে ইতস্তত করেন।
গত কয়েক দশক ধরে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনি কড়াকড়ি বেড়েছে। পরিবেশ বিধি মেনে চলতে গিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খরচ-সাপেক্ষ প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা বেড়েছে। আমরা যেন ভুলতে বসেছি কলকাতা শহরের পূর্বে জলাভূমির কথা, যেখানে শহরের প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে ন’কোটি লিটার বর্জ্য জল প্রাকৃতিক উপায়ে পরিস্রুত হয়। স্থানীয় চাষিরা সেই পরিষ্কৃত জল, মাছ আর আনাজ চাষে বহু দিন ধরেই ব্যবহার করেন। অন্য দিকে, পরিশোধন প্রকল্প থেকে পরিশোধিত জলের পুনর্ব্যবহার এখনও শুরু করা যায়নি। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সংরক্ষিত হলেও জমি–বাড়ি ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনে জলাধারগুলি ছোট হয়ে আসছে, কমে আসছে প্রাকৃতিক পরিশোধন ক্ষমতা। হিসাব বলছে, জলাভূমি না থাকলে ওই পরিমাণ বর্জ্য জল প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিশোধন করতে পুরনিগমের বাড়তি খরচ হবে বার্ষিক ৪৫০ কোটি টাকা। নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির পাশাপাশি চিরাচরিত পদ্ধতিগুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণের তথ্য অনুযায়ী, পুরসভাগুলি ৯৭ শতাংশ ঘর থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে। এই আবর্জনার প্রায় চল্লিশ শতাংশের বেশিই পচনশীল জৈব পদার্থ। তা থেকে জৈব সার (কম্পোস্ট) বা বায়োগ্যাসে তৈরি করার বরাত দেওয়ার চেষ্টা করছে পুরসভা। কিন্তু ১০ শতাংশেরও কম বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ চালু করা গিয়েছে। তার একটা কারণ, জৈব সারের বাজার সীমাবদ্ধ। মাটি ও ফসলের পক্ষে নিরাপদ হলেও, জৈব সার প্রয়োগে যথেষ্ট ফসল পেতে প্রায় দু’বছর লাগে। এ ছাড়া, জৈব সার উৎপাদন করা গেলেও তার মান কেমন হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আনাজের খোসার মতো পচনশীল আবর্জনার সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, নষ্ট বৈদ্যুতিন সামগ্রী বা প্লাস্টিক আলাদা করা রাখার কথা বলা হয়েছে কঠিন বর্জ্য সংক্রান্ত সরকারি বিধিতে, যাতে জৈব সার উৎপাদনের উপযোগী উপকরণ মেলে। কার্যক্ষেত্রে এখনও প্রায় ৭০ শতাংশ পুর এলাকায় আলাদা করা জঞ্জাল সংগ্রহ করার ব্যবস্থা চালু হয়নি। আগে আবর্জনার এই অংশগুলি বিক্রি করারসক্রিয় বাজার ছিল। কাগজকুড়ানি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট ফেরিওয়ালারা কাগজ, শিশি বা পুরনো কাপড় নিয়ে যেতেন। এখন তাঁরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছেন, কারণ পুরসভার পক্ষ থেকে বাড়ি-বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহ, এবং সেই আবর্জনাকে কম্প্যাক্টর মেশিনে পিষে ফেলে আয়তনে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। সেই মণ্ড থেকে কাগজ বা প্লাস্টিক সহজে উদ্ধার করা যায় না।
কিছু স্টার্ট-আপ সংস্থা এখন পুরসভার সহায়তায় অপচনশীল আবর্জনাকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প দ্রব্য তৈরি করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগের স্থায়িত্ব কত দিন? অসংগঠিত ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে পারিবারিক শ্রম ব্যবহার হয় বলে সামান্য মুনাফাতেও তারা কাজ চালিয়ে যেত। স্টার্ট-আপ উদ্যোগগুলি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে গেলে যতটা বিক্রি প্রয়োজন, বিকল্প দ্রব্যের বাজার কি তত দূর বিস্তৃত হতে পেরেছে?
জৈব সার বিক্রি না হলে, বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্প বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। শেষে আবর্জনা ফেলতে হবে খোলা জমিতে। শহরে স্থানাভাব, তাই আবর্জনা ফেলার জমিও এক সময় পাওয়া কঠিন হবে। স্থানীয় ভাবে এই জৈব সার ব্যবহার করার জন্য হাউজ়িং সোসাইটিগুলিকে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। আবাসনের সুবিধাজনক দিক হল, একটি নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে আবর্জনা জড়ো হয়, যা সহজেই সংগ্রহযোগ্য। আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ এবং তার পরবর্তী ব্যবহারের ভার যদি আবাসনের বাসিন্দাদের উপর ন্যস্ত করা যায়, তা হলে জৈব সারের চাহিদা-জনিত সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে।
আবর্জনা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ রাজপথ থেকে কাগজকুড়ানিদের সরিয়ে দিয়েছে। শহরের বাইরেটা উজ্জ্বল। কিন্তু নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি না হলে, এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণ করে পাওয়া দ্রব্য (যেমন জৈব সার) বাজারজাত করার উদ্যোগ না করলে, শহরের দৈন্যের চেহারাটা বেশি দিন চেপে রাখা যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy