Advertisement
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
KIBF

বইমেলা আর বাংলাদেশ

সাতচল্লিশের পূর্ব পাকিস্তান একাত্তরে হল বাংলাদেশ, পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তু-মনেও ঘটেছিল গর্বের রেখাপাত। সেই বাংলাদেশে ঘটেছে অন্য এক অভ্যুত্থান। তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।

অনিল আচার্য
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৮
Share: Save:

আমরা, যেখানে যত বাঙালি, গর্ব করে এত দিন বলে এসেছি, বাংলাদেশ আমাদের গর্বের সেই দেশ যার উৎসমূলে রয়েছে বাংলা ভাষা। সাতচল্লিশের পূর্ব পাকিস্তান একাত্তরে হল বাংলাদেশ, পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তু-মনেও ঘটেছিল গর্বের রেখাপাত। সেই বাংলাদেশে ঘটেছে অন্য এক অভ্যুত্থান। তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অবশ্যই লক্ষণীয়, দেশটির মধ্যে প্রবল অস্থিরতা বিদ্যমান, মৌলবাদী শক্তির দাপট ক্রমবর্ধমান। ফলে যুক্তিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই, রাজনৈতিক সঙ্কটের ঘাড়ে চেপে ঘনাচ্ছে সাংস্কৃতিক সঙ্কটের কালো মেঘ।

১৯৭৬ সাল থেকে কলকাতা বইমেলা বাংলা ভাষা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এতটাই যে, ১৯৯৬-এ বামফ্রন্ট সরকার কর্তৃক আয়োজিত বইমেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়, কলকাতা বইমেলা দেশের অন্যতম প্রধান বইমেলার স্বীকৃতি পায়। প্রচুর বাংলা বই এই মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ পেতে থাকে। আগে পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয়তৃতীয়া ছিল বই প্রকাশের ব্যবসায়িক দিন। বইমেলা উদ্বোধনের আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের দিনটি ক্রমে সেই জায়গা নেয়।

১৯৯৬-এ প্রথম বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত হয় একটি প্যাভিলিয়ন। বাংলাদেশ থেকে সরকারি উদ্যোগে প্রকাশকরা বই পাঠান, পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা বাংলাদেশের পুস্তকসম্ভারের সংস্পর্শে আসেন। দুই বাংলার গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় হয় ১৯৯৯-এ কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ ‘থিম কান্ট্রি’ হওয়ায়। সেই থেকে প্রতি বছর বইমেলার এই ক’দিনে দুই বাংলার সংস্কৃতির অসাধারণ সমন্বয় সাধিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা তাঁদের গ্রন্থসম্ভার নিয়ে প্রতিটি বইমেলায় থেকেছেন। বইমেলায় একটি দিন ‘বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। একই ভাষার দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের উপস্থিতি বইমেলায় যে গৌরব বহন করে, অন্য কোনও দেশের উপস্থিতি তা পারে না।

১৯৯৯-এ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রধান অতিথি, মেলা উদ্বোধন করেন কবি শামসুর রাহমান। দিল্লিতে তখন ক্ষমতায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকার। দিল্লি থেকে বিদেশমন্ত্রী স্বয়ং কলকাতা বিমানবন্দরে এসে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা করেছিলেন। তার পর থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতি কলকাতা বইমেলাকে সমৃদ্ধ করেছে।

সেই বাংলাদেশ আগামী বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়নি, তাই তারা যোগ দেবে না, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কলকাতার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ করা হয়নি, তাই তাঁরা আসতে পারছেন না। অন্য দিকে শোনা যাচ্ছে দু’টি কথা— বাংলাদেশ নাকি আগ্রহ দেখাচ্ছে না এবং এত দিন ধরে কলকাতা বইমেলা একতরফা ভাবে বাংলাদেশের প্রকাশকদের যে সুবিধা দিয়ে এসেছে, তার নিরিখে বাংলাদেশের বইমেলায় কোনও সদর্থক সহযোগিতা পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকরা পাননি। এই পরিস্থিতিতে এমন আশঙ্কা হচ্ছে, ২০২৫-এর বইমেলায় বাংলাদেশ হয়তো না-ও থাকতে পারে। আর এই অনুপস্থিতির ফলে দুই বঙ্গের প্রকাশনাক্ষেত্রে তো বটেই, দুই দেশের সম্পর্কেও অভিঘাত সৃষ্টি হতে পারে।

প্রথম কারণ হিসেবে এমনটা ভাবা যেতে পারে: বইমেলার পরিচালকরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। তাঁরা ভেবেছেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের এই অংশগ্রহণ কী ভাবে নেবে। তাঁরা ভেবে উঠতে পারছেন না, এ বিষয়ে ভারত সরকারের অনুমতির প্রয়োজন আছে কি না; বিশেষত আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে পুরো দায়িত্ব তাঁরা নেবেন কি না। বইমেলায় কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোলযোগ হলে তার দায়িত্ব কে নেবে? ফলে আমন্ত্রণ জানাতে তাঁরা গড়িমসি করে অস্বস্তি কাটাতে চাইছেন। আসলে তাঁরা কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না। আমন্ত্রণ না জানালে বাংলাদেশই বা যোগ দেবে কী ভাবে? প্রতি বছরই আমন্ত্রণ জানানো হয়, এ বার ব্যতিক্রম কেন?

ভালই ছিল সব, গোলমাল হয়ে গেল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে। কিন্তু আমন্ত্রণ জানাতে অসুবিধা একটাই। বইমেলা এখন মূলত সরকারনির্ভর: পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকার এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলবে না, বলছে-ও না। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্যোক্তারা এই আবহে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবেন, ঝুঁকি নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

‘ব্যালান্স অব ট্রেড’ বিবেচনা করলে কলকাতার প্রকাশকদের ক্ষতি হবে বেশি। শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা, সেই সঙ্গে টিভি, ট্যাব, মোবাইলের মারাত্মক মনন-অনুপ্রবেশে বইয়ের হাল খুবই খারাপ। সরকার পাঠ্যপুস্তকের দায়িত্ব নিয়েছে, সেই কারণে পাঠ্যপুস্তকের রমরমা ব্যবসা আর নেই; পাঠ্যপুস্তক ব্যবসায়ীরা অসহায়। বাংলা গল্প উপন্যাস কবিতা-সহ সাহিত্যজগতের চিত্রটিও খুব সুখকর নয়: ভারতের এই কোণে বাংলা ভাষা এই বাংলায় পিছু হটছে। তেরো-চোদ্দো কোটি বাসিন্দার এই পশ্চিমবঙ্গে মিশ্র-জনগণযোগে ‘ধ্রুপদী’ তকমাপ্রাপ্ত আহ্লাদি বাংলা ভাষার প্রকাশনা বড় জোর পাঁচশোর বেশি কোনও ‘টাইটল’ ছাপে না। তবু তারা বেশ কিছু পাঠক এত দিন পেয়ে এসেছিল বাংলাদেশের সতেরো কোটি বাঙালির মধ্যে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, ভারতের তেল-কয়লা-পেঁয়াজ ইত্যাদি সে দেশের মানুষের যতটা দরকার, বাংলা বই ঠিক ততটা দরকারি হতেই পারে না। তাই কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ না এলে ক্ষতি হবে কলকাতার প্রকাশকদের। অবশ্য বইমেলার কর্মকর্তাবৃন্দ, বা দলীয় রাজনীতিপীড়িত পশ্চিমবঙ্গ বা কেন্দ্রের তাতে কী-ই বা যায় আসে?

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Book Fair 2024 Kolkata International Book Fair Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy