মাস কয়েক আগেই সংবাদমাধ্যমের একাংশ পূর্বাভাস দিয়েছিল, আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত আবার গর্ভপাত নিষিদ্ধ করতে চলেছে। কথাটি এতটাই যুগ-অনুপযোগী যে, বিশ্বাস করতে মন চায়নি। তা ছাড়া গত পাঁচ বছরে চারটি দেশ আয়ারল্যান্ড (২০১৮), আর্জেন্টিনা (২০২০), মেক্সিকো (২০২১) এবং কলম্বিয়া (২০২২) গর্ভপাত আইন অনেক শিথিল করেছে। কিন্তু দেখা গেল, সেই চলতি হাওয়ার বিপ্রতীপে গিয়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট সত্যিই গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করল। সারা পৃথিবীর মুক্তমনা মানুষদের দীর্ঘশ্বাস ভাষা পেয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কণ্ঠে, আজ দেশের এক দুঃখের দিন; এই সিদ্ধান্ত কখনওই এই বিষয়ে শেষ কথা হতে পারে না। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, আজ সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের পুরনো একটি রায়কে শুধু উল্টিয়েই দিল না, নাগরিকের অতীব ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে নির্বাসিত করল।
রো বনাম ওয়েড মামলায় (১৯৭৩) জেন রো ছদ্মনামধারিণী টেক্সাসের এক অবিবাহিতা তরুণী তৃতীয় বারের জন্য গর্ভধারণ করেন। টেক্সাসে তখন গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়। মরিয়া রো আদালতের দ্বারস্থ হন। রাষ্ট্রীয় আইনের পক্ষে সওয়াল করেন অ্যাটর্নি হেনরি ওয়েড। সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘ দিনের আইনি অচলাবস্থা ভেঙে বেরিয়ে এসে রো-এর গর্ভপাতের পক্ষে যখন রায় দেয়, তত দিনে রো তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ব্যক্তির প্রয়োজন ছাপিয়ে এই রায় এক বৃহৎ সমষ্টিগত উদ্যাপনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই ১৯৭৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট মতামত দিয়েছিল, সংবিধানে আলাদা করে গর্ভপাতের অধিকার উল্লিখিত না থাকলেও মহিলার ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারের ভিত্তিতে ধারণা করাই যায় যে, গর্ভপাতের অধিকার নিশ্চয়ই সংবিধান স্বীকৃত। অর্ধশতক পর সেই একই কোর্ট তাদের এক প্রজন্ম আগের বিচারপতিদের স্বচ্ছ যুক্তিবুদ্ধিকে অস্বীকার করল, নারীদের হাত থেকে গর্ভপাতের রক্ষাকবচ আইন করে কেড়ে নেওয়া হল।
এই হরণের কাহিনি অবশ্য নতুন কথা নয়। আধুনিক মানব সভ্যতা কখনওই নারীকে এই অধিকার খোলা মনে দিতে চায়নি। ক্যারল স্মিথ রোজ়েনবার্গ ডিসঅর্ডারলি কনডাক্ট: ভিশনস অব জেন্ডার ইন ভিক্টোরিয়ান আমেরিকা বইতে বলেছিলেন, “ব্যক্তিগত ও শারীরবৃত্তীয় ব্যাপারে রাজনৈতিক খবরদারির এক বড় উদাহরণ হল গর্ভপাত। গর্ভপাত তাই একান্ত ব্যক্তিগতের সঙ্গে প্রকাশ্য রাজনীতির এক মেলবন্ধন ঘটায় সর্বস্তরেই, গর্ভপাত নিয়ে আলোচনার অর্থ ক্ষমতায়নের কথা বলা।” পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি বংশবৃদ্ধি, মানবজন্ম ইত্যাদি স্পর্শকাতর ক্ষমতায়নের বিষয়ে নারীর আধিপত্যকে কখনওই স্বীকার করেনি, করতে পারে না। ধর্মগ্রন্থ তার এক শক্তিশালী ছুতোমাত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স নিখুঁত ভাবে নির্ধারণ করার কোনও উপায় ছিল না— মা যখন থেকে পেটে বাচ্চার নড়াচড়া বুঝতে পারতেন, তখন থেকেই ভ্রূণের জীবন সম্ভাবনা আছে বলে ধরা হত। তার আগে গর্ভ নষ্ট হলে কোনও ধর্মমতের কোনও ধ্বজাধারীই তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন স্পষ্ট হল, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে সৃষ্ট কোষ বিভাজিত হতে হতে পূর্ণ জীবদেহের রূপ পায়, তখন থেকেই ধর্মীয় তথা রাষ্ট্রনেতারা গর্ভপাত নিয়ে গোঁড়ামি শুরু করলেন, যা আজও অব্যাহত। আমাদের দেশে গর্ভপাত আইন এখনও নারীর সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য করে, কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীবিশেষের ক্ষেত্রে এই গোঁড়ামি অবশ্যই মাথাচাড়া দেয়।
বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই ধারণা করছেন, এই রায়ের ফলে আমেরিকায় ধনীদের মধ্যে শিথিল-আইনের-রাষ্ট্রে গিয়ে গর্ভপাত করে আসার প্রবণতা বাড়বে— এর মধ্যেই যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গর্ভপাত পর্যটন’। আর অপেক্ষাকৃত নিরুপায় দরিদ্র মহিলারা প্রতি বছর যত অনভিপ্রেত সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হবেন, তার সংখ্যা নাকি দাঁড়াবে ষাট হাজারের কাছাকাছি। নিরুপায়তার হিসাবটা হয়তো একটু সরলীকৃত হল। কারণ, এই রায় অনিবার্য ভাবে ‘অ্যাবরশন বটিকা’ বা ওরাল অ্যাবরটিফেশ্যান্টস-এর হাতুড়ে ব্যবহার ও কালোবাজারিকে উৎসাহিত করবে। ফলে, বাড়বে সেই সংক্রান্ত মারাত্মক নানা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট করা দরকার। এই রায়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, তা কিন্তু সার্বিক ভাবে গর্ভপাতের পক্ষে নয়। বর্তমানে প্রচলিত নানা বৈজ্ঞানিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং প্রয়োগ থাকলে গর্ভপাতের প্রয়োজন হওয়ারই কথা নয়। গর্ভপাত হল জমাট ডিফেন্সের পিছনে তেকাঠির নীচে দাঁড়ানো নির্ভরযোগ্য গোলকিপার। কোনও কারণে রক্ষণের সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে এটি এক আপৎকালীন ব্যবস্থা। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য, কোনও রাষ্ট্রশক্তির অঙ্গুলিহেলনে এই গোলকিপার যেন মাঠ থেকে বেরিয়ে না যায়, নারী তাঁর চরম বিপদের মুহূর্তে যেন তাকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। গর্ভপাতের অধিকারের মূল কথাটিই হল, নারীর নিজের জরায়ু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে— সঙ্গে থাকবে তাঁর শুভবোধ, শুভাকাঙ্ক্ষী আপনজন এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী—কিন্তু আর কেউ নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy