২০৪০। ‘আর্যাবর্ত’ নামের সুরক্ষিত, নিরাপত্তাবেষ্টিত, প্রযুক্তিপূর্ণ এক নগর-রাষ্ট্রের দৃশ্য। তার বাইরের মানুষরা পরিষ্কার পানীয় জলের অধিকার-বঞ্চিত। মাঝে-মাঝে অবশ্য আর্যাবর্ত তাদের উপর হামলা চালায়, কিন্তু কোনও কিছুর অধিকার দেয় না। জল যেটুকু পাচ্ছে তা অপরিষ্কার, কখনও এমনই কালো-কর্দমাক্ত যা খাওয়া যায় না, তা দিয়ে স্নান করা যায় না। শুধু যে জলের জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে তা-ই নয়, মুক্ত বাতাসও অকুলান। অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন অগণিত মানুষের সেই আর্যাবর্ত-বহির্ভূত বস্তিসদৃশ গলিময় বাসভূমির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আর্যাবর্ত নামের নগর-পরিসরটি তার বিলাসবহুল বেঁচে থাকাকে সুনিশ্চিত করার জন্য বাকি মানুষদের ‘আখের মতো চিবিয়ে ফেলে দিয়েছে’। এই চিবিয়ে ফেলা শোষণের যন্ত্রণা কেবল আর্যাবর্তের বাইরের মানুষদের সইতে হয় তা-ই নয়, আর্যাবর্তের ভিতরের মানুষদেরও, যারা আর্যাবর্তের নীতির বিরোধী তাদের, সইতে হয়। সেই সব হিন্দু-মেয়ে যারা বিয়ে করেছিল ভালবেসে ভিন্ন ধর্মে তাদের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে ‘শুদ্ধিব্রত’। মিশ্ররক্তের সন্তানকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে আর্যাবর্ত, তার পরে জননীকে পাঠিয়েছে নজরদারিপ্রখর ক্যাম্পে। সেখানে প্রতিমুহূর্তে ঘোষিত হচ্ছে আর্যাবর্তের জয়গান— পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করবার উপায় নারী-পুরুষ কারও নেই। আর্যাবর্তের পুরুষ-রক্ষকদের উচ্ছিষ্ট পাতের উপর দিয়ে দণ্ডি কাটার মতো ভঙ্গিতে গড়াগড়ি দিতে হয় শুদ্ধিব্রতী রমণীদের। তাদের সর্বাঙ্গে পুরুষের এঁটো— আর্যাবর্তের কথা না শুনলে এঁটো হয়ে যেতে হয়।
কোথায় ঘটছে এই সব? আপাতত ঘটছে একটি ওয়েব সিরিজ়ে— সাম্প্রতিক নয়, কিছুকাল আগের। কোথায় ঘটবে? ঘটবে সেখানেই যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পুঁজিবাদের সঙ্গে হাত মেলাবে, ফ্যাসিবাদের অঙ্গীকার নেবে সেখানেই এই সমস্ত ঘটনার আত্মপ্রকাশ সম্ভব। সে ধর্মের নাম হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান যা খুশি হতে পারে। এমনকি বামপন্থার কৌশলী, আমানবিক, যান্ত্রিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রয়োগ থেকেও জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদের বীজ।
দীপা মেহতা পরিচালিত এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী ওয়েব সিরিজ়টি প্রয়াগ কাশ্যপের ডিসটোপিয়া লয়লা অবলম্বনে নির্মিত। দেখতে বসে কিন্তু মনে হয় না এ-সব আবার হয় নাকি? ২০৪০ আসতে তো আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। জলের মারাত্মক আকালের কথা তো এখনই খবরে উঠে আসে। এক দিকে মুম্বইয়ের বিলাসবহুল বহুতল বাড়িতে সুইমিং পুলের নিতান্ত ব্যক্তিগত জলকেলি, অন্য দিকে জলের অভাবে এখনই তো বস্তিবাসী বহুসংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রা বিশুষ্ক। সন্তানের জন্মের পর তার রক্ত ‘বিশুদ্ধ’ কি না তার জন্য এখনই এ দেশে রাষ্ট্রশক্তি কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা করছে না বটে কিন্তু ‘লাভ জেহাদ’ চেনা শব্দবন্ধ হয়ে উঠেছে। বন্ধুদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে জানি, মুসলমান বন্ধু হিন্দু বান্ধবীকে বিবাহ করলে বাড়িভাড়া পেতে অসুবিধে হয়েছে নিকট অতীতে, এখনও হয়। লয়লা-তে দীপা রাষ্ট্র-পোষিত একটি বিদ্যালয়ের ছবি তুলে ধরেছেন। সেই বিদ্যালয়ে প্রতি মুহূর্তে আর্যাবর্তের জয়গান ঘোষিত হয়। তারস্বরে প্রতি দিন বিশেষ ভঙ্গিতে আর্যাবর্তের জয় ঘোষণা করতে করতে ছোট্ট মিষ্টি ছেলেমেয়ের দল যন্ত্রবৎ কঠোর হয়ে ওঠে। তাদের শরীর-মগজ বিশেষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যায়— আর্যাবর্ত তাদের মা এই বিশ্বাসে ছিলাটান তাদের মন-মগজ, আর সব ঝুট হ্যায়। আর্যাবর্তে তাদের চোখের সামনে সর্বত্র সর্ব-শক্তিমান ফ্যাসিস্ট নেতার সুবিশাল মূর্তি।
দীপা মেহতার এই ভয়ঙ্কর ‘ডিসটোপিয়া’ দেখতে দেখতে অনেক বাঙালি পাঠকের দু’টি রবীন্দ্র-নাটকের কথা মনে পড়ে যাবে কি— মুক্তধারা আর রক্তকরবী। মুক্তধারা প্রকাশের শতবর্ষ অতিক্রান্ত। রক্তকরবীর পত্রিকা প্রকাশের শতবর্ষ আসন্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ যখন এই নাটক দু’টি লিখছিলেন তখন তারই সমসময়ে বাংলা সাহিত্যের এক দল যুবক-যুবতী কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে নতুন বাস্তব সাহিত্য রচনায় ব্রতী। তাঁরা বস্তির খবরে, দরিদ্র মানুষের বিবরণে, যৌনবাসনার প্রকাশ্যতায় বাস্তবকে বুঝতে চাইছিলেন। তাঁদের কাছে এগুলি বাস্তবের সর্বগ্রাসী চিহ্ন— আর রবীন্দ্রনাথের কাছে এগুলি বাস্তবের উপসর্গ যার অন্তরালে রয়েছে গভীর ব্যাধি। সেই ব্যাধির স্বরূপ খুঁজতে চাইছিলেন তিনি। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বযুদ্ধ যে আর এক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে পৃথিবীকে, আর সেই পৃথিবী যে কেবল পাশ্চাত্যে সত্য ও বাস্তব নয় যে-কোনও সময়ে যে-কোনও ভূখণ্ডে বাস্তব, তা বুঝতে পারছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাটক দু’টিকে রূপক-প্রতীক ইত্যাদি বলে আমরা দীর্ঘদিন দূরে রেখেছিলাম। শম্ভু মিত্র নির্বাসিত রক্তকরবী-র শাপমুক্তি ঘটিয়েছিলেন। তবে তাঁর পক্ষেও রবীন্দ্রনাথের নাটকটির সমস্ত সম্ভাবনা মঞ্চে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নিয়ো-লিবারাল অর্থনীতির দাপট, পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তির নির্লজ্জ নৃত্য ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে তার আলিঙ্গন এখন আমাদের সহজেই বুঝিয়ে দেয় এগুলি কেন ‘আধুনিক’ ডিসটোপিয়া। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য দেশজ পুরাণ আর মহাকাব্যের উপাদান দিয়ে নিজের শিল্পনির্মাণ করেছিলেন। এ কালের আর্যাবর্তবাদী হিন্দুত্বপন্থীরা ভারতীয় পুরাণ আর মহাকাব্যকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র নির্মাণের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে চান আর রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় পুরাণ-মহাকাব্যের উপাদানকে কাজে লাগান পুঁজির প্রতাপের বিরোধিতা করার জন্য। এ এক আশ্চর্য কৃষ্ণকৌতুক!
দীপার আর্যাবর্তের নির্মাণে যেমন রাষ্ট্র-পোষিত বিদ্যালয়ের ভূমিকা খুব প্রবল, তেমনই রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা-তেও আছে একটি বিদ্যালয়ের কথা। সেই বিদ্যালয়ে মাস্টারমশাই যা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদে, তা খুবই ভয়ঙ্কর। “...দিজ় ভেরি বয়েজ় উইল ওয়ান ডে বি আ টেরর টু অল দোজ় হু হ্যাভ দ্য মিসফরচুন টু বি বর্ন আউটসাইড আওয়ার বাউন্ডারিজ়।” আর্যাবর্তের বাইরের মানুষদের জীবনকে নরক করে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ নাগরিকেরা। মুক্তধারার মতোই প্রয়াগের আখ্যান আর দীপার নির্মাণ জল নিয়ে কথা বলে— জল এই প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার এক দলের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার যন্ত্র বানানো হয়েছিল রবীন্দ্র-নাটকে। প্রাকৃতিক জলসম্পদকে মানুষের যন্ত্র, পুঁজির বাণিজ্য কৌশল ব্যক্তিগত রাষ্ট্রসম্পদ করে তোলে।
না, প্রয়াগ-দীপার আখ্যানের সঙ্গে পদে-পদে রবীন্দ্র-রচনাকে মেলানোর দরকার নেই। স্বাধীন ভাবে রবীন্দ্র-রচনা পড়লে বোঝা যায় এই মানুষটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্রকে খুব ভিতর থেকেই চিনতে পেরেছিলেন সংবেদী মনের তাগিদে। এল্মহার্স্টের সঙ্গে রেড অলিয়েন্ডারস (রবীন্দ্রনাথকৃত রক্তকরবী-র ইংরেজি অনুবাদ) নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ এল্মহার্স্টকে জানিয়েছিলেন লাগামছাড়া লোভ থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম। সেই লোভ কেমন? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘গ্রিড ফর থিংস, ফর পাওয়ার, ফর ফ্যাক্টস’। বস্তুলোভ, ক্ষমতালোভ তো বোঝা গেল, কিন্তু তথ্যের প্রতি লোভ! রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, এরই উপর কিন্তু নির্ভর করছে আধুনিক কর্পোরেট পুঁজি-তাড়িত রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্র। প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত যাপনকে তথ্যবিচারের আওতায় নিয়ে এসে তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র তার ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম করতে চায়। রক্তকরবী নাটকে নন্দিনী আর সর্দারের সংলাপ মনে পড়ে।
সর্দার। ওদের আমরা বলি ‘রাজার এঁটো’।
নন্দিনী। মানে কী?
সর্দার। মানে এক দিন তুমিও বুঝবে, আজ থাক।
নন্দিনী। কিন্তু এ-সব কী চেহারা! ওরা কি মানুষ! ওদের মধ্যে মাংসমজ্জা মনপ্রাণ কিছু কি আছে!
সর্দার। হয়তো নেই।
নন্দিনী। কোনও দিন ছিল?
সর্দার। হয়তো ছিল।
নন্দিনী। এখন গেল কোথায়?
সর্দার। বস্তুবাগীশ, পারো তো বুঝিয়ে দাও, আমি চললুম।
আমরাও কি বুঝতে পারি? রাষ্ট্র, পুঁজিতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত আর্যতন্ত্র-প্রত্যাশী রাষ্ট্র, প্রতিটি নাগরিকের অস্তিত্বকে বস্তুগত তথ্যে রূপান্তরিত করতে চায়। সেই তথ্যটুকু রেখে মনের অতিরিক্তটুকু তারা বাদ দেবে। তারা শুধু জানতে চায় তুমি নারী না পুরুষ, হিন্দু না মুসলমান, উচ্চবিত্ত না মধ্যবিত্ত, তোমার কী খেতে কী কিনতে ভাল লাগে বা লাগে না— ইত্যাদি। তার পর সেই তথ্য বর্গীকৃত করে তারই জালে রাষ্ট্রের সামান্য এঁটো হিসাবে আটকে ফেলে মানুষকে। এই তথ্যজালের বাইরে যাওয়ার আর উপায় থাকে না।
এ সব কল্পনা নয়, সব সত্য— চার পাশে ঘটে যাওয়া সম্ভাব্য বাস্তব। সেই আর্যতন্ত্র-প্রত্যাশী রাষ্ট্রের কাছে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মূর্তিমান বিপদ— তাই কখন যে কোন লেখা বাদ দেওয়ার, মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলবে, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy