Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Literature

অন্য এক ভারতকে চেনা হল

বিদেশি সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যতটা ওয়াকিবহাল, তার দশ শতাংশও খবর রাখি না পাশের রাজ্য বিহারে এখন কী কবিতা লেখা হচ্ছে সে বিষয়ে।

প্রবালকুমার বসু
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২২ ০৫:১৪
Share: Save:

শিমলা পাহাড়ে তিন দিন ব্যাপী সাহিত্য উৎসব হয়ে গেল, সাহিত্য অকাদেমির আয়োজনে, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সহযোগিতায়। ২০০২-এ আইসিসিআর আয়োজিত ‘অ্যাট হোম উইথ দ্য ওয়র্ল্ড’ বা এখনকার জয়পুর সাহিত্য উৎসব মাথায় রেখেই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, চারশোরও বেশি লেখককে নিয়ে এত বড় সাহিত্য উৎসব এ দেশে আগে হয়েছে কি? ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত একটা দেশে এতগুলো কলম উৎসবে যোগ দিলে একটা আলো জ্বলে ওঠে। আশার আলো, বিবিধের মাঝে মহান মিলনের আলো।

এমন সাহিত্য উৎসবে ভিন্ন ভাষার নানান জনের বক্তব্য বা লেখা শোনা ছাড়াও অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়, বই দেওয়া-নেওয়া, বন্ধুত্বও হয়। মেঘ, রোদ্দুর আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির আবহাওয়ায় গোটা ভারত যেন হাজির শিমলার ‘গেয়টী থিয়েটার’-এ (ছবিতে)। স্থান নির্বাচন অভিনব: একই জায়গায় একাধিক মঞ্চ, আলোচনাকক্ষ, কবিতা পড়ার জায়গা। এক-একটি কক্ষের আলাদা নাম। প্রতিষ্ঠিত, নামী লেখকদের পাশাপাশি নবীনরাও— তাঁদের মধ্যে কেউ যুব সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, অনেকেই তা পাননি— কিন্তু তাঁদের কাজের বিশেষত্ব নজর এড়ায়নি অকাদেমির। এই মুহূর্তে ভারতীয় সাহিত্যে হয়তো সর্বজনমান্য, একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় কোনও মুখ নেই, যেমন ছিলেন নির্মল বর্মা, অনন্তমূর্তি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শঙ্খ ঘোষ। চুরানব্বই বছরের জয়ন্ত মহাপাত্র অবশ্যই আছেন, কিন্তু তিনি আর কোথাও যান না। অন্যান্য সাহিত্য-সমাবেশে দেখা যায় কয়েক জন লেখক বা কবিকে নিয়েই মূল অনুষ্ঠান, এখানে তা ছিল না। তাই সব অনুষ্ঠানে, সব কবিতাপাঠের আসরেই শ্রোতার উপস্থিতি। আরও প্রাপ্তি ছিল তথাকথিত অনগ্রসর সম্প্রদায়ের, এবং ট্রান্সজেন্ডার লেখক-কবিদের উপস্থিতি— সম্মেলনকে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য উচ্চতায়। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। এ যেন এক নতুন ভারতকে অবিষ্কার। ‘গ্ল্যামার’ও ছিল, গুলজার সাহেবের সিনেমা নিয়ে আলোচনা বা কবিতা নিয়ে বিশাল ভরদ্বাজের সঙ্গে কথোপকথন, গুলজারজির কবিতা বিশালের কণ্ঠে গান হয়ে ওঠা, এগুলোও অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী গীতাঞ্জলি শ্রীকে দেখার বা তাঁর বক্তব্য শোনার আগ্রহও কম ছিল না।

বিদেশি সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা যতটা ওয়াকিবহাল, তার দশ শতাংশও খবর রাখি না পাশের রাজ্য বিহারে এখন কী কবিতা লেখা হচ্ছে সে বিষয়ে। উৎসবে আসা এত জন লেখককে ছ’-সাতটা রিসর্ট আর হোটেল মিলিয়ে রাখা হয়েছিল। যে রিসর্টটিতে ছিলাম সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজিভাষী কবি অশ্বিনীকুমার, গুজরাতের প্রবোধ পারিখ, তামিলের সালমা। সান্ধ্য আড্ডায় আসতেন কন্নড় ভাষার কবি শিবপ্রকাশ, মরাঠি কবি হেমন্ত দিভাতে, বর্ষীয়ান হিন্দি কবি অরুণ কমল। অরুণ কমলের কবিতা আগে অনুবাদে পড়েছি, কিন্তু কবিকণ্ঠে ঘরোয়া পরিবেশে কবিতা শোনা অন্য অভিজ্ঞতা। এক সান্ধ্য আসরে অপূর্ব গজল শোনালেন কবিতা পড়তে আসা মৃত্যুঞ্জয় সিংহ। পেশায় তিনি পুলিশের বড় কর্তা, কিন্তু যেমন কলম তেমন কণ্ঠ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক সালমার নাম শোনা, কিন্তু পরিচয় ছিল না। অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এক দিন হাঁটতে হাঁটতে ওঁর জীবনকাহিনি শুনে চমকে উঠেছিলাম। মাদুরাইয়ের কাছে এক গ্রামে মুসলমান পরিবারে জন্ম তাঁর, যে গ্রামে মেয়েরা ‘বড়’ হলে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, বাড়ি থেকে বেরোনোও বন্ধ, এমনকি এমন একটা ঘরে থাকতে দেওয়া হয় যেখানে জানলাও নেই। তার পর দেখেশুনে গ্রামেরই কোনও ছেলের সঙ্গে বিয়ে। সালমারও তা-ই হয়েছিল। স্বামী ওঁকে লিখতে দেখলে লেখার ডায়েরি কাগজ ছিঁড়ে ফেলে দিতেন। লুকিয়ে লেখা, এক স্নেহশীলা বয়স্কার সহযোগিতায় লেখা পাঠানো, নিজের নাম পাল্টে ছদ্মনাম সালমা নেওয়া যাতে কেউ ওঁকে চিনতে না পারে, এই সব দুর্যোগ পেরোতে হয়েছিল তাঁকে। নিজের প্রথম বই বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেননি। সে সব অতিক্রম করে এক সময় রাজনীতিতে আসা ওঁর, এখন ডিএমকে পার্টির মুখপাত্র আর ডেপুটি সেক্রেটারি। এও তো আমাদেরই ভারত!

আমারই সঙ্গে কবিতা পড়েছিলেন নাসিম শাফায়ে। ২০১১ সালে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে, কাশ্মীরি মহিলা হিসেবে প্রথম। সত্তরের কাছাকাছি বয়সি কবির দীপ্য পাঠে উঠে এল গত কয়েক দশকের বিধ্বস্ত কাশ্মীরের কথা— এক মহিলার দৃষ্টিকোণ থেকে। ওঁর কবিতায় আবিষ্কার করি খবরের অন্তরালে থাকা অন্য এক কাশ্মীরকে, আমাদের অনুসন্ধিৎসাও যেখানে পৌঁছতে পারে না। একটি পর্বে ছিল এলজিবিটি লেখকদের লেখার অভিজ্ঞতার কথা, মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে। যে সংগ্রামের কাহিনি উঠে আসছিল সকলের বক্তব্যে, মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ভারতীয় সাহিত্যের সাবঅল্টার্ন ইতিহাস। সাহিত্যই তো আসল ইতিহাস ধরে রাখে! বহুবর্ণ, বহুস্তরীয় এক অখণ্ড ভারতের সেই ইতিহাস বুকে নিয়ে পাহাড় থেকে ফিরলেন এক দল লেখক।

অন্য বিষয়গুলি:

Literature festival Shimla
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy