Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Rituparno Ghosh

ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছার উড়ান

চিত্রাঙ্গদা-র গোড়ায় একটি সংলাপ ছিল, “চিত্রাঙ্গদা একটা ইচ্ছের গল্প, দ্যাট ইউ ক্যান চুজ় ইয়োর জেন্ডার।”

An image of Rituparno Ghosh

ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রয়াত হন ২০১৩-র ৩০ মে। ফাইল চিত্র।

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ ০৬:১০
Share: Save:

ঋতুপর্ণ ঘোষ (ছবি) প্রয়াত হন ২০১৩-র ৩০ মে। এই দশ বছরে তাঁকে ঘিরে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলি বৃহদর্থে ঠিক কেমন? তিনি লিখেছেন, “আমার স্বভাবপ্রণোদিত ‘অস্বাভাবিকতা’ নিয়ে আমি বাস করেছি আমার একাকিত্বের বন্দিজীবনে— আর আমার সামনে ছিল সমাজের এক বিরাট কারাগার। যেখানে ঐতিহাসিক ভাবে যে কোনও নতুন প্রথাকেই প্রবেশ করতে হয়েছে দণ্ডিত বিদ্রোহীর মতো, অনেক হিংসা এবং রক্তপাতের মূল্যে।” সেই ‘নতুন প্রথা’ বা ‘অস্বাভাবিকতা’ আসলে কী? নিজের যৌনপরিচয় নিয়ে অকপট ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ভারতে যৌনতা বিচারের সন্ধিক্ষণে তাঁর শেষ দিকের ছবিগুলি (আরেকটি প্রেমের গল্প, মেমোরিজ় ইন মার্চ, চিত্রাঙ্গদা) নিঃসন্দেহে বড় ‘স্টেটমেন্ট’। বহু পুরস্কার ও প্রতিষ্ঠা পেলেও তাঁর বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকারে ছড়িয়ে রয়েছে এই স্বীকারোক্তি— আজীবন তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে সমাজের অশিষ্ট কৌতূহল ও অপমান। তার প্রত্যুত্তরে সব সময় দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু শুধু এটুকুই তাঁর শিল্পসত্তার সর্বাত্মক উন্মোচন নয়।

তিতলি-র দু’টি দৃশ্য মনে করা যাক। পাহাড়ের ঢালে চিত্রতারকা রোহিত রায় ও নিজের মায়ের কথোপকথন থেকে তিতলি জানতে পারে, যার প্রেমমুগ্ধতায় সে ডুবে রয়েছে তিনি আসলে তার মায়ের প্রাক্তন প্রেমিক। ছবির এক দৃশ্যে হঠাৎ মায়ের রাতপোশাকের আবরণ সামান্য খসে পড়তেই মায়ের শরীরের দিকে তাকায় তিতলি, ‘মা’ হিসাবে নয়, একই প্রেমসম্পর্কের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে! চরিত্রের মনের এই সূক্ষ্ম আচরণ বার করে আনাই ছিল ঋতুপর্ণের প্রধান শক্তি। এ ছবিতে ঊর্মি প্রথমে ‘মা’, পরে নিজের মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, শেষে তিতলির সঙ্গে তার এক সখীসম্পর্ক জন্ম নেয়। রোহিতের ইচ্ছে, সিনেমা থেকে অবসরের পর পাহাড়েই ঊর্মির বাড়ির কাছে জমি কিনে থাকবে। সেই ইচ্ছে-মুহূর্তেই ঊর্মির গলায় শোনা যায় কবিতা, “আমরা দু-জন একটি গাঁয়ে থাকি...” ছবির শেষে এই উচ্চারণ পরিচালক ফিরিয়ে আনেন অন্য দ্যোতনায়। যখন রোহিতের বিয়ের খবর এসে পৌঁছয়, যখন মা-মেয়ে দু’জনের মনের বিরহ এক, তিতলি মায়ের কাছ থেকে সেই কবিতাটি আর এক বার শুনতে চায়। শোনেও। কবিতায় প্রথম বার ‘আমরা দু-জন’ কথাটির অর্থ জুড়ে ছিল ঊর্মি ও রোহিতের পুরনো সম্পর্ক, এ বার সেখানে তিতলি ও তার মা। একটি পুরুষকে না-পাওয়ার ভিতরে মা-মেয়ের একত্র বসবাস।

আবহমান ছবিতে অসুস্থ পরিচালক অনিকেত ও তার ছবির অভিনেত্রী শিখার সম্পর্ক নিয়ে ছেলে অপ্রতিম সিনেমা তৈরির কথা ভাবে। অনিকেত বলে, “তোমার ছবিতে আমাকে নেবে? তোমার সঙ্গে আমিও বানাব। একটু তুমি বানালে। একটু আমি বানালাম। তার পর আবার তুমি বানালে। আবার আমি বানালাম... তোমার মা একটু বানাবে, আমার মা একটু বানাবে। তার পর ধরো শিখা একটু বানাল। ওর বোন লেখা একটু বানাল।” তাঁর ছবিতে এত বিরাট নাচের সেট কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয় লীলা ভন্সালী বলেছিলেন, ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁদের ছোট্ট ঘরের মধ্যে ঘুঙুর পরে নাচতেন। ছবি বানানোর সময় এখন তিনি নাচের দৃশ্যের দেওয়ালগুলো হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে সেই ঘরটা বড় করে নেন। আবহমান-এর এই সংলাপের অর্থও দেওয়াল ঠেলে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। অনিকেতের মা, স্ত্রী, শিখা, শিখার বোন, এদের এক সঙ্গে ছবি বানানো অসম্ভব। কিন্তু ছবিটি অনিকেতের জীবন নিয়ে, যে জীবন এদের সবার মধ্যেই খণ্ড-খণ্ড ছড়িয়ে। সেই যুক্তিতে এরাও ছবিটি বানাতে পারে বইকি!

চিত্রাঙ্গদা-র গোড়ায় একটি সংলাপ ছিল, “চিত্রাঙ্গদা একটা ইচ্ছের গল্প, দ্যাট ইউ ক্যান চুজ় ইয়োর জেন্ডার।” ব্যক্তির ইচ্ছেই তার যৌনপরিচয়, তাকে সামনে রেখে বাঁচার সমস্ত অধিকার তার আছে। আজ এ দেশে যখন সমলিঙ্গবিবাহ নিয়ে আইনি লড়াই চলছে, তখন এগারো বছর আগে তৈরি এ ছবিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, “‘পুরুষ’ এবং ‘নারী’ এই দু’টি বিপরীত শব্দের মাঝখানে এক অসীম প্রান্তর, যেখানে বসবাস করেন অর্ধনারীশ্বরতার নানা প্রতিভূ।” চিত্রাঙ্গদা-য় সেক্স চেঞ্জ অপারেশনের আগে রুদ্র তার কাউন্সেলর শুভকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, আমি তো কাল অপরেশন টেবিলে মারাও যেতে পারি!” “যেতে পারি কেন? যাবে। ইউ ওয়াকড ফর আ নিউ লাইফ! দুটো জীবন তো এক সঙ্গে থাকতে পারে না! এখন তোমাকে ডিসাইড করতে হবে তুমি কী ভাবে বেঁচে থাকতে চাও?” রুদ্র নিজেকেই জিজ্ঞেস করে, “এক জন ভাইভেসিয়াস এনারজেটিক নৃত্যশিল্পী হয়ে?” “না কি চিত্রাঙ্গদা? সুরূপা?” “কিন্তু সেটাও তো পার্মানেন্ট নয়।” তা হলে ‘পার্মানেন্ট’ কী? চিত্রাঙ্গদা জানায় কোনও নির্মাণই সম্পূর্ণ নয়, সবটাই প্রবহমান।

এক সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, “আমি নিপীড়িত, আমি অবহেলিত, আমি প্রান্তিক, আমি মনে-মনে কখনও আমার এই অবস্থানটাকে ঠাঁই দিইনি, বা সমর্থনও করিনি।” তাঁর ছবি সম্পর্কে ভাবার সময়ে তাঁর প্রান্তিক অবস্থানকে মুখ্য না করে, তাঁর শিল্প-অস্তিত্বকে বোঝার চেষ্টা করলেই তাঁর চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ভাবনার সার্বিক বিচার বোধ হয় সম্ভব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy