দেবী কালী।
মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর নিদ্রিত পঞ্চপুত্র-সহ বহু যোদ্ধাকে রুদ্রাস্ত্র ও খড়্গের আঘাতে হত্যা করেন। ওই সময় পাণ্ডব শিবিরের রক্ষীরা রক্তবদনা রক্তবসনা রক্তমাল্যধারিণী পাশহস্তা কালরাত্রিরূপা কালীকে দেখতে পেলেন। কালী গান করছেন এবং মানুষ, হাতি, ঘোড়াদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন। রক্ষীরা ইতিপূর্বে প্রতি রাতে কালীকে এবং হত্যায় উন্মত্ত অশ্বত্থামাকে স্বপ্নে দেখতেন। চিরজীবী অশ্বত্থামা শিবের অবতার।
মহাভারত থেকে প্রতীয়মান, কালী রক্তপিপাসু এক দেবী, তিনি মৃত্যুস্বরূপা। বহু পণ্ডিত, বিশেষ করে প্রতীচ্যের ভারততত্ত্ববিদরা কালীকে অন্ধকার, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবী বলে ভাবেন। কিন্তু কালীকাহিনি এত সরল ও একরৈখিক নয়। কালী প্রতীচ্যের ভাল বনাম মন্দের ন্যারেটিভে পড়েন না, তিনি উভয় ধারণাকে অতিক্রম করে একটি তত্ত্বে পরিণত হন।
১৮৯৮ সালে কাশ্মীরের ডাল লেকে স্বামী বিবেকানন্দ ‘কালী দ্য মাদার’ নামে একটি ইংরেজি কবিতা লিখেছিলেন, পরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার বাংলা অনুবাদ করে নাম দেন ‘মৃত্যুরূপা মাতা’। এই কবিতায় বিবেকানন্দ কালীর ভয়ানক রূপ বর্ণনা করেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন কালীর ভয়াবহ প্রলয়নাচের মঞ্চ। কিন্তু যিনি মা, তিনি কেন ভীষণ হবেন, ভয়ঙ্করীই বা হতে যাবেন কোন অভিপ্রায়ে?
এই প্রশ্নের জবাব আছে শ্রুতি ও পুরাণসমূহে। কারও মতে কালী ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তে আছেন। ভগিনী নিবেদিতা ঋগ্বেদের উচ্চ সৃষ্টিসঙ্গীতে কালীর মূর্তির পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের একটি ঋকে কালীপ্রতিমার সঙ্কেত আছে বলে ভেবেছিলেন। অথর্ববেদে কালীকে সুস্পষ্ট ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে তিনি দেবী নন— উগ্র কালো জিহ্বা, অগ্নির সপ্ত লেলিহান জিহ্বার অন্যতম। অথর্ববেদের অন্তর্গত মুণ্ডকোপনিষদে অগ্নির সাত জিহ্বার নাম আছে। একটি হল কালী—যা কাল নির্ধারণ করে, নির্ধারিত সময়। আর একটি করালী— যা মহাপ্রলয় সৃষ্টি করে। দেবীকে করালীও বলা হয়, সে কথা বলছে মার্কণ্ডেয় পুরাণ। দেবীর বাহন কোথাও শিবা, কোথাও শিব, আবার কখনও শব। শিবা মানে শৃগাল। দেবীর শৃগালরূপেরও উল্লেখ আছে হরিবংশ ও বিষ্ণুপুরাণে। দেবীর বাহন যখন শিব তখন সেই শিব ‘পুরুষ’ যা তন্ত্র ও সাংখ্যমতে নিষ্ক্রিয়, শবতুল্য। দেবী তাই শবারূঢ়া বা শিবারূঢ়া। তাঁর হাতে নরমুণ্ড, গলায় মুণ্ডমালার হার, দুই শিশুর শব দুই কর্ণের কুণ্ডল। তিনি রক্তপানকারিণী। তাঁর চক্ষুদ্বয় পিঙ্গল, আলুলায়িত কেশ, মদ-মাংস বাম হাতে, দক্ষিণ হস্তে মানুষের কর্তিত মাথা, দেবী হাসিমুখে নরমাংস খাচ্ছেন— শ্মশানকালীর এ চিত্র তন্ত্রশাস্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়।
এই দেবীই উঠে এলেন বাঙালি হিন্দুর অন্দরমহলে, হয়ে উঠলেন দয়াময়ী জননী। সেই বিবর্তনের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। অষ্টাদশ শতকের আগে দেবী কালী ছিলেন বিমূর্ত। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নামের নবদ্বীপের এক তন্ত্রসাধকের চেষ্টায় বিমূর্ত কালীর মূর্তি হল বাংলায়। এর আগে যন্ত্রে বা শিলাখণ্ডে দেবীর পূজা হত, তাও হত শ্মশানে কিংবা নদীতীরে। আগমবাগীশের প্রচেষ্টায় দেবী ঘরে উঠে এলেন। স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ষোড়শ শতাব্দীর মানুষ, তিনি এই অমাবস্যার নিশিতে লক্ষ্মী ও কুবেরের আরাধনার কথা বলেছেন। লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী ও রাবণের ভ্রাতা কুবের হলেন সম্পদের দেবতা, তাঁর বাহন মানুষ। মানুষ জীবনভর যক্ষরাজ কুবেরের সম্পদ বয়ে চলে। স্মার্ত পণ্ডিত কাশীনাথের লেখা গ্রন্থে কালীপূজার বিধান প্রথম পাওয়া যায়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গুরু ছিলেন আগমবাগীশ। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজার প্রচলন হয়। সাধক রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করেন। উনিশ শতকে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের জন্য কালীপূজা জনপ্রিয় হয়। এক গোপ/ সাঁওতাল/বাগদি রমণীর আদলে তৈরি আগমবাগীশের কালীমূর্তি। এই কৃষ্ণা নারীকে তিনি ঘুঁটে দিতে দেখেন। তাঁর বাম হাতে গোবরের তালের পরিবর্তে উঠে এল খড়্গ, ঘুঁটে দেওয়া ডান হাতে উঠে এল বরাভয়। সেই গেরস্ত নারী আগমবাগীশকে দেখে জিভ কেটেছিলেন, ঘামে তাঁর সিঁদুর টিপ এমন আকার ধারণ করেছিল, তা-ই হয়ে উঠল চন্দ্রসুধা।
কালীর কালো রূপ দেখে স্বয়ং শিব নাকি বলেন, তুমি যখন আমার শুভ্রকান্তি দেহ আলিঙ্গন করো, তখন তোমাকে কৃষ্ণসর্পের মতো লাগে। কালী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যায় বসেন, ব্রহ্মার বরে গৌরাঙ্গী হয়ে ওঠেন, তাই তাঁর অন্য নাম ‘কৌশিকী’। নারীবাদী পুরাণজ্ঞরা মনে করেন, কালীর কৃষ্ণা থেকে গৌরী হওয়ার তপস্যা হল পিতৃতন্ত্রের নির্মাণ। পিতৃতন্ত্র এত জটিল, গূঢ়, বৈচিত্র্যময়, বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট ধারণ করতে অক্ষম, তাই এমন একরৈখিক ভাবনা তার।
ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তে আছে, রাত যেমন উষাকে গ্রহণ করে আলোর উদয় ঘটায়, কালীও অশিবকে নাশ করে মানুষকে জ্ঞানবর্তিকার পথে নিয়ে যান। মৃত্যুরূপা কালীর ‘মৃত্যু’ আসলে মোক্ষ। মা সন্তানকে জঠরে ধারণ করে প্রসব করেন বা মুক্তি দেন, দেবীও তেমনই সন্তানকে দেন অবিদ্যার গর্ভ থেকে মুক্তি। মৃত্যুভয় বা বন্ধনের কারণ হল আসক্তি, কালী সেই আসক্তি দূর করেন। মৃত্যুভয় মূলাধার চক্রের প্রধান নিরাপত্তাহীনতা। কালী সেই মহাবিদ্যা যিনি এই নিরাপত্তাহীনতা, অবিদ্যা, আসক্তি দূর করেন। কালীতত্ত্ব বুঝতে গেলে কালীর জন্মবৃত্তান্তে যাওয়া দরকার। একটি মতে, তাঁর আবির্ভাব শিব থেকে, আবার সেই শিব সন্তান হয়ে তাঁর স্তন্যপান করছেন। একই শিবকে আবার কালীর পায়ের নীচে শবরূপে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে বিরুদ্ধতা নেই। ‘কালী’ হলেন নির্ধারিত বা ব্যবহারিক সময়। ‘কাল’ অর্থাৎ শিব হলেন অতিবর্তী সময় যার বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে দিগম্বরী কালী বা ব্যবহারিক সময়, যেখানে লোকোত্তর সময় শবদেহ। কালীর অম্বর (পোশাক) হল দিক বা স্পেস। সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করেন বলে তিনি করালবদনা। তাঁর ত্রিনয়ন ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। প্রাচীন কবিরা কালীকে বলাকিনী (স্ত্রী-বক) বলেন: বলাকিনীর ওড়ার ক্ষমতাই মোক্ষের প্রতীক।
১৯০৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দ-র ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ কবিতায় কালী থেকে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মের সন্ধান আছে, যার শেষ বাক্য: “চূর্ণ হোক্ স্বার্থ, সাধ, মান হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy