Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Utensils

বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি

খাগড়াই কাঁসার বাসন কথাটা খুব শোনা যেত। খাগড়া মুর্শিদাবাদের একটি জায়গা, যার খ্যাতি কাঁসার বাসনের জন্যে।

আধুনিক রান্নাঘরে হারিয়ে গেছে অনেক শব্দ।

আধুনিক রান্নাঘরে হারিয়ে গেছে অনেক শব্দ। ফাইল চিত্র।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২২ ০৬:২৬
Share: Save:

মুনেশ্বর বলিল— হুজুর, আমায় একখানা লোহার কড়া কিনে দেবার হুকুম যদি দেন মুহুরী বাবুকে।

— কি হবে লোহার কড়া?

মুনেশ্বরের মুখ প্রাপ্তির আশায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে বিনীত সুরে বলিল— একখানা লোহার কড়া থাকলে কত সুবিধে হুজুর। যেখানে সেখানে সঙ্গে নিয়ে গেলাম, ভাত রাঁধা যায়, জিনিসপত্র রাখা যায়, ওতে করে ভাত খাওয়া যায়, ভাঙবে না। আমার একখানাও কড়া নেই। কতদিন থেকে ভাবছি একখানা কড়ার কথা— কিন্তু হুজুর, বড় গরিব, একখানা কড়ার দাম ছ-আনা, অত দাম দিয়ে কড়া কিনি কেমন করে? তাই হুজুরের কাছে আসা, অনেক দিনের সাধ একখানা কড়া আমার হয়, হুজুর যদি মঞ্জুর করেন, হুজুর মালিক।” (আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

কড়াই যে শুধু গরিব মুনেশ্বরের থাকে না, তা নয়, বিলিতি সাহেবদেরও থাকে না। কারণ, তারা কড়াইতে রান্না করে না। তাই বিলেতের প্রবাসী বঙ্গবালা কলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে যায় একখানা কড়াই। তা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় তার কলকাতার গৃহ পরিচারিকা।

“আমি একটা নতুন কেনা অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই সুটকেসে ভরছিলাম। বকুল ভারি অবাক।

— সে কী? বিলাতে কড়াই পাওয়া যায় না?’

— নাঃ

— তাহলে আবার কেমনধারা বড়লোকের দেশ? ভিখারি নাই বললেন যে?

— গরিব বড়লোকের ব্যাপার নয় রে বকুল। সেখানকার লোকেরা কড়াইয়ে রান্না করে না’।

বিলেতের লোকেরা কড়াইয়ে রান্না করে না শুনে থ মেরে গেছিল বকুল। ওর হাত থেকে ঝাঁটাটা খসে পড়েছিল।” (নোটন নোটন পায়রাগুলি, কেতকী কুশারী ডাইসন)

এখন বিলেত আর বাংলার রান্নাঘরে তফাত নেই বললেই চলে। মডিউলার কিচেন, ইন্ডাকশন, মিক্সার-শোভিত রান্নাঘরের চেহারায় আর উপাদানে ধাতব কাঠিন্য। আগে বাঙালির বাসনে ছিল মাটি, কাঠ, পাথরের বাসন। ছিল বাঁশ আর বেতের ব্যবহার। খাওয়া হত পদ্মপাতা, কলাপাতা বা শালপাতায়। পচনশীল উপাদানগুলো পচে মাটিতে মিশে যেত। এখন পিকনিক স্পট বা বিয়েবাড়িতে উচ্ছিষ্ট থার্মোকলের প্লেট যেমন কুৎসিত, তেমনই পরিবেশের পক্ষে চরম ক্ষতিকর। তীর্থ বা কাজেকর্মে গেলে ভরসা ছিল মাটির হাঁড়ি। অনেক সময় রান্নার পর না ফেলে ধুয়ে নেওয়া হত। কুমোরপাড়ার গরুর গাড়িতে তাই বোঝাই করা কলসি, হাঁড়ি থাকতেই হত। গরিব মানুষের ঘরে অবশ্য অনেক দিন অবধি ধাতু ঢোকেনি। “ঘরে পেতল-কাঁসার সংস্পর্শ নেই-মাটির কলসি, মাটির হাঁড়ি সরা, মাটির ডাবর, মাটির ভাঁড়ে জল রাখা আছে। ভাত খায় কলার পাতায়, নয়তো চামটার বিলের পদ্মপাতায়” (‘আমার ছাত্র’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। খাগড়াই কাঁসার বাসন কথাটা খুব শোনা যেত। খাগড়া মুর্শিদাবাদের একটি জায়গা, যার খ্যাতি কাঁসার বাসনের জন্যে। খুব বেশি দিনের কথা নয়, যখন বিয়েতে মেয়েকে দানসাজ দেওয়া হত কাঁসার বাসন।

আমাদের কথ্য ভাষায় আজও অনেক শব্দ মিশে আছে, যাদের উৎস অজানা। যেমন, মুখ গোমড়া করে থাকলে বলা হয় ‘মুখখানা তোলো হাঁড়ির মতো করে আছিস কেন?’ ‘তোলো’ এসেছে তৈলপাচনিক থেকে, যার মানে তেল দিয়ে রান্না করা। তৈলপাচনিক থেকে তেলানি হাঁড়ি। এই হাঁড়িতে তেল দিয়ে রান্না করা যায় কড়াইয়ের মতো। নীচটা বেশ ভারী হয় যাতে পুড়ে না যায়। আগে হাঁড়ির নীচে কড়াইয়ের মতো অংশটাই শুধু ছিল, পরে কাঁধের অংশ যোগ হয় তাপের অপচয় কমাতে, কানা জোড়া হল ফ্যান গালবার সুবিধের জন্য। ভারতের যে সব অঞ্চলে ভাতের ফ্যান গালা হয় না, সেখানে হাঁড়ির ধারণা অন্য। (বাঙ্গালির বাসনকোসন, নৃপেন ভৌমিক)

আধুনিক রান্নাঘরে হারিয়ে গেছে অনেক শব্দ। যেমন, তিজেল হাঁড়ি, তই, চুমকি ঘটি, ছান্তা, বেড়ি, বিড়ে, ঘুঁটনি বা ডালের কাঁটা, পাটা, সরা, চুপড়ি, ডাবু, ডাবর রেকাবি। এই সব শব্দের খোঁজ পাওয়া যায় শুধু পুরনো সাহিত্যে আর সিনেমায়। প্রবাদ প্রবচনও কম নেই কিছু বাসনকোসন নিয়ে— ‘বারো কাওরার তেরো হাঁড়ি, কেউ যায় না কারও বাড়ি’, ‘যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’, ‘ঘটি ছিল না ঘটি হল/ জল খেতে খেতে পরান গেল’ (বোঝা যায় একটা ঘটি কেনাও কত কঠিন ছিল)।

‘মড়িঘাটের মেলায়’ শহুরে উচ্চবর্ণের লোকেরা বুনো সাধুর আশ্রমে রান্না করতে গিয়ে দেখলেন “…অনেক কিছুই আনা হয়নি বাড়ি থেকে। ...হাতা আনতে ভুল হয়েচে, জল রাখবার বালতি বা ঘড়া নেই, ডাল ঢালবার পাত্র নেই…।” বুনো সাধুর আশ্রমের রান্না করা খাবার খেতে আপত্তি থাকলেও পালি ভর্তি মুড়কি বা ঠাকুরকে নিবেদন করা মালশা ভোগ খেতে আপত্তি হল না ব্রাহ্মণ অতিথিদের। মনে রাখতে হবে জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ির খাদ্যাভ্যাসে এই হাঁড়ি, পালি আর মালশা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চরিত্র। যেমন, বিধবার জন্য নির্দিষ্ট শ্বেতপাথরের থালা।

এটাও দেখেছি, বাড়ির গিন্নির ব্যক্তিত্বের প্রভাব পড়ত বাসনের উপর। আমার সূক্ষ্মরুচি সম্পন্ন, অন্তর্মুখী স্বভাবের দিদা পছন্দ করতেন ছোট বাসন, আর তাঁর মেয়ে, মজলিশি মানুষ আমার মা, তাঁর বাসনপত্র বেশ বড় ছিল। এক-একটা বাসনের পিছনে ছিল আবার এক-একটা গল্প। ছিল একটা অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো গামলা, আনাজের খোসা জমানো থাকত তাতে। মায়ের সদ্য পাতা অসচ্ছল সংসারে ওতে নাকি মাংস ম্যারিনেট করা হত। তাই প্রাণে ধরে ফেলা যায়নি। নোটন নোটন পায়রাগুলি-তে যেমন মৃত মায়ের কেটলিটা দেখলেই এরিকার মনে পড়ত মা সবার জন্যে চা ঢালছেন।

বাসনের বাসনা ছেলেদের কি থাকতে নেই? বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী-তে দিগ্‌গজ বেরোবার সময় বলেছিল, “তৈজসপত্র রহিল যে।” বিমলা আশ্বস্ত করে বলেছিল, “ও সব তোমায় কিনে দিব।”

অন্য বিষয়গুলি:

Utensils Food
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy