গোলাপবাগের ‘মিনি জ়ু’। ফাইল ছবি
ব্যস্ত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে দক্ষিণে দিলখুশা অ্যাভিনিউ ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই সবুজে মোড়া অন্য এক বর্ধমান। ডান হাতে ছিমছাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। অন্য দিকে, রমনাবাগান জুলজিক্যাল পার্ক। যেখানে প্রতি বছরে ছোট্ট এই চিড়িয়াখানাটিতে আনন্দ উপভোগ করতে হাজির হন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। আর আছে এই সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজনের স্মৃতি, শ্রীসঙ্গম রায় এবং তাঁর বংশধরেরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে আসার অনেক আগে সুদূর পঞ্জাব থেকে এসে যাঁরা এই বর্ধমানের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন নিজেদের জমিদারি।
১৮০৯ সাল। রাজা কীর্তিচাঁদ, চিত্রসেন, তিলকচাঁদের যুগ শেষ হয়েছে। বর্ধমানের শাসনভার তখন রাজা তেজচাঁদের হাতে। ব্যক্তিগত জীবনে রাজা বেপরোয়া। কিন্তু প্রজাবৎসলও বটে। তাই তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজের তালিকাটিও দীর্ঘ। ইতিমধ্যেই বন্যা কবলিত গ্রামগুলিকে রক্ষা করতে তিনি মেরিয়াট সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে নির্মাণ করিয়েছেন দামোদরের উভয় তীরের বাঁধ। যাতায়াতের উন্নতির জন্য বানিয়েছেন তেইশটি লাল মোরামের রাস্তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক দাতব্য চিকিৎসালয়। তৈরি হয়েছে অবৈতনিক বিদ্যালয়ও। গরিবদের জন্য অন্নসত্র। পানীয় জল সরবরাহের জন্য সরোবর। শুরু হয়েছে রাজ কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজও। আর তার সঙ্গে অতি শখের বাগান।
‘গোলাপবাগ’। সযত্নে পরিখা দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত সবুজের গালিচা। রাস্তার দুই পাড়ে সার বেঁধে অশোক, বকুল, নাগেশ্বরী, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া আর মেহগনিদের চোখজুড়ানো ভিড়। সঙ্গে যত্নে তৈরি করা মরসুমি ফুলের গাছ। আর গোলাপের বাগান। আর বাগানের ঠিক মাঝে রাজার প্রিয় বাহারি মাছেদের জন্য মানস সরোবর এবং একটি পশুশালা। কি না ছিল সেই সংগ্রহে! সিংহ, চিতা, বাঘ, ভাল্লুক, নীলগাই, নানা জাতের হনুমান। ভারত ও তৎকালীন ব্রহ্মদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ময়ূর, কাকাতুয়া, চন্দনা, ময়না পাখি, হরিণদের জন্য পাকা পাঁচিলে ঘেরা আস্তানা। আর কুমিরদের জন্য ঘাট বাঁধানো পুকুর। তবে এই সব কিছু রাজা তেজচাঁদ কিন্তু কখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে রাখেননি। তখনও বাংলায় আলিপুর চিড়িয়াখানা তৈরি হয়নি। তাই বিনা টিকিটে রাজার সাজানো এই চিড়িয়াখানা দেখতে দূর, দূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন বহু মানুষ।
তবে গোলাপবাগের এই চিড়িয়াখানার বৈচিত্র্য এবং খ্যাতি শীর্ষে পৌঁছেছিল তেজচাঁদের দত্তকপুত্র মহতাবচাঁদের আমলে। বহু ব্যয়ে দেশ, বিদেশ থেকে নানা প্রজাতির গাছ এবং পশুপাখি আনিয়ে তিনি ঢেলে সেজে ছিলেন বাগানটিকে। সেই সময় সুনাম এতটাই ছড়িয়েছিল যে সেই সময় কলকাতা থেকে আসা বহু ইংরেজ পর্যটক কেবলমাত্র রাজার তৈরি এই বাগানটিকে দেখতেই ছুটে আসতেন বর্ধমানে। ১৮৫৫ সালে ঠিক এই ভাবেই কলকাতা থেকে রানিগঞ্জ যাওয়ার পথে এসেছিলেন ‘কলকাতা রানিগঞ্জ ট্যুর গাইড’-এর প্রণেতা স্যান্ডার্স সাহেব। তিনি জানাচ্ছেন, রাজার বাগানে সে সময় শোভা পাচ্ছে প্রায় হাজারেরও বেশি প্রজাতির গাছ। প্রায় প্রতি মাসে আট হাজার টাকা ব্যয় করে রাজা সেগুলির পরিচর্যা করান। যদিও উপযুক্ত ছায়ার অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু দামি অর্কিড। আর চিড়িয়াখনার দেশি জীবজন্তুর পাশাপাশি, চার বছরে প্রায় তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে রাজা আনিয়েছেন নানা বিদেশি পশুপাখি। নেপাল থেকে এসেছিল কাঠবিড়ালি, শ্রীলঙ্কা এবং বোর্নিও থেকে বিশেষ প্রজাতির বাঁদর, সদ্য কিনে নিয়ে এসেছেন হাজার টাকা জোড়া উত্তর আমেরিকার বিশেষ প্রজাতির কাকাতুয়া। এবং আটশো টাকা জোড়া মেরু অঞ্চলের পেলিকান পাখি। এ ছাড়াও আফ্রিকান শকুন, টাইগার ক্যাট, এমু পাখি, উটপাখি, হায়না, নেকড়ে, ভাল্লুক, কাশ্মীরী পায়রা এবং ওরাং-ওটাং তো ছিলই। আবার ১৮৪৫ সালে বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ জোসেফ ডাল্ট হুকারের বিবরণ থেকে জানা যায়, সে সময় নাকি রাজার বাগানে দেখা মিলত একজোড়া অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙারুর। কিন্তু বছরখানেক পরে স্যান্ডার্স সাহেব কেন সেই ক্যাঙারুর দেখা পাননি তা আজকের দিনে বলা মুশকিল।
তবে রাজা মহতাবচাঁদের গোলাপবাগের চিড়িয়াখানার সুনাম যে সে সময় বিদেশেও ছড়িয়েছিল এর সব থেকে বড় প্রমাণ লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘স্যাটার ডে রিভিউ’ এর ১৮৭২ সালের ১৬ মার্চ তারিখে প্রকাশিত হওয়া একটি প্রবন্ধ। সেখানে ফলাও করে লেখা হয়েছিল মহারাজার তৈরি করা এই বাগান এবং তাঁর উটপাখির প্রতি বিশেষ ভালবাসার কথা। আর শুধুই কি গোলাপবাগ? মহারাজার পশুপ্রেমের আর একটি বড় নিদর্শন কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা। ১৮৭৬ সালে সেই চিড়িয়াখানা তৈরির সময় যে তিন জন ভারতীয় জমিদার এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম রাজা মহতাবচাঁদ। আজও আলিপুর চিড়িয়াখানার সিংহদের থাকার জন্য তৈরি ‘বর্ধমান হাউস’ সেই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
মহতাবচাঁদের পরবর্তী সময় রাজা আফতাবচাঁদ এবং বিজয়চাঁদের আমলেও বেশ ভাল ভাবেই চালু ছিল গোলাপবাগের চিড়িয়াখানা। এর পরে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ার কমিটি’র সভাপতি হিসেবে রাজা বিজয়চাঁদ গোলাপবাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় সৈন্যদের শিবির স্থাপনের জন্য ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ায় বাধ্য হয়ে এই পশুশালার প্রায় সব পশু, পাখিগুলিকে দান করে দেওয়া হয় আলিপুর চিড়িয়াখানায়। এখানেই চিড়িয়াখানা হিসেবে গোলাপবাগের পথ চলা শেষ। ১৯৫৯ সালে দেশ থেকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে মহারাজা তেজচাঁদ, মহতাবচাঁদের শখের সেই বাগানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ। রঙিন মাছেদের মানস সরোবরের চারদিকে ঘিরে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এবং নানা বিভাগের কেন্দ্র। আর চিড়িয়খানা? না একেবারে মুছে যায়নি। মহারাজা মহতাবচাঁদের তৈরি রমনার বাগের মাত্র ১৪ হেক্টর জমিতে ‘ভারতীয় বন দফতর’ ও ‘সেন্ট্রাল জ়ু অথরিটি’র উদ্যোগে ১৯৬০ সাল থেকে রয়েছে ‘মিনি জ়ু’। গ্রীষ্মের বিকেল হোক বা রোদ ঝকঝকে বড়দিনের দুপুর— রমনাবাগের গাছ এবং পশুপাখিগুলি এখনও হাজির হওয়া দর্শকদের শুনিয়ে যায় রাজপরিবারের প্রকৃতিপ্রেমের কথা।
তথ্যসূত্র: ১। ‘বর্ধমান রাজ’: শ্রী নীরদবরণ সরকার, ২। ‘দ্য রেল অ্যান্ড ইটস লোকালিটিজ়’: স্যান্ডার্স কোন অ্যান্ড কোং, ১৮৫৫, ৩। ‘হিমালয়ান জার্নাল অর নোটস অব দ্য ন্যাচারিলিস্ট ইন বেঙ্গল’, জেডি হুকার
লেখক পলসোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy