Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

একতার প্রতীক শৈবতীর্থ এক্তেশ্বর

‘শিবরাত্রি ব্রত’ রাঢ়বঙ্গের এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব। শিবরাত্রিতে ব্রতীরা উপবাস করেন। রাতে তাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এক্তেশ্বর নাগমণি মহাদেবের জয়ধ্বনি। এই মন্দিরের উদ্ভব ইতিহাস এবং পারিপার্শ্বিক নিয়ে লিখছেন বিপ্লব বরাট‘শিবরাত্রি ব্রত’ রাঢ়বঙ্গের এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব। শিবরাত্রিতে ব্রতীরা উপবাস করেন। রাতে তাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এক্তেশ্বর নাগমণি মহাদেবের জয়ধ্বনি।

এক্তেশ্বর মন্দিরের শায়িত শিবলিঙ্গ। নিজস্ব চিত্র

এক্তেশ্বর মন্দিরের শায়িত শিবলিঙ্গ। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০১:২৭
Share: Save:

শাস্ত্রে বলে, ইন্দ্রিয়বৃত্তিই অসুর। এই অসুরই বন্ধনের কারণ। আর এই বন্ধন হতে মুক্তি অর্থাৎ, মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষাতেই একেশ্বরের আরাধনা।

লোকশ্রুতি রয়েছে, ‘অন্ধ গ্রাম’ অর্থাৎ, আজকের ওন্দা, ভাদুল, বীরসিংহপুর, ভীমপুর, তপোবনের অধিবাসীরা হিন্দু জীবনশৈলি সমন্বিত অসুর সম্প্রদায়ের অথবা জনগোষ্ঠীর অংশ ছিলেন। প্রাচীন যুগে সমস্ত কোল গোষ্ঠীর মানুষ ‘অসুর’ অর্থাৎ শক্তি-সম্পন্ন নেতা নামে অভিহিত হতেন। তাঁরা নিজেদের সূর্যের সন্তান বলে প্রচার করতেন। এই আদিবাসীরা ছিলেন একেশ্বরবাদী।

এখন প্রশ্ন, এই একেশ্বর থেকেই কি এক্তেশ্বর শব্দের উৎপত্তি! তা অবশ্যই আলোচনা তথা অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে।

এই নিবন্ধে আলোচনার বিষয়—বাঁকুড়ার উপকণ্ঠে অবস্থিত এক্তেশ্বরের মন্দির।

প্রাচীন কাল থেকেই বাঁকুড়ায় শিব সাধনার ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে। বাঁকুড়া শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের বাম তীরে পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন মন্দিরগুলির অন্যতম এই শিবমন্দির। এটি এক্তেশ্বরের মন্দির নামেই জনমানসে পরিচিত।

এই প্রাচীন শৈবতীর্থে এক্তেশ্বর শিব স্বয়ম্ভু। বাঁকুড়ায় শতাধিক শিবমন্দির রয়েছে। মল্লেশ্বর, বহুলাড়াতে সিদ্ধেশ্বর, জয়পুরে গন্ধেশ্বর, ভুবনেশ্বর, পাত্রসায়রে কালঞ্জয় শিব বিখ্যাত। শৈবতীর্থ এক্তেশ্বরে প্রতিদিনই পুজো হয়। ফাল্গুন মাসে, শিব চতুর্দশী তিথিতে এক্তেশ্বর মন্দিরে শিবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে কয়েক হাজার নরনারীর সমাগম হয়।

‘শিবরাত্রি ব্রত’ রাঢ়বঙ্গের এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব। শিবরাত্রিতে ব্রতীরা উপবাস করেন ও আগের দিন নখ কেটে নিরামিষ আহার করেন। রাতে মহাসমারোহে এক্তেশ্বরে ব্রতীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এক্তেশ্বর নাগমণি মহাদেবের জয়ধ্বনি। রাত্রে ব্রতীরা মন্দিরের আটচালায় সারারাত জেগে কাটান। শিবরাত্রিকে কেন্দ্র করে মেলাও বসে। আগত দর্শকমণ্ডলীর সমাগমে একই সঙ্গে বাউল গান, রামায়ণ গান শোনা যায়।

শৈবতীর্থ এক্তেশ্বর নিয়ে আলোকপাতে প্রথমে যে কথা বলা চলে তা হল— আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির পর্যবেক্ষণ। তিনি জানাচ্ছেন, ‘বেদে এক পাদেশ্বরের উল্লেখ আছে। যে নামটি অপভ্রংশ এক্তেশ্বরে এসে দাঁড়িয়েছে’।

মন্দিরের কুণ্ডের মধ্যে যে শিবলিঙ্গটি রয়েছে, সেটি নাকি দেখতে অনেকটা মানুষের পায়ের মতো। জনশ্রুতি রয়েছে, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজার সঙ্গে ছাতনার সামন্তভূমের রাজার রাজ্য সীমানা নিয়ে বিবাদ হলে, তার মীমাংসা করেন স্বয়ং শিব। দুই সীমানার সংযোগস্থলে একতার প্রতীক হিসেবে এই এক্তেশ্বর মন্দির স্থাপিত হয়। বিদ্যানিধি মহাশয়ের মতে, এক্তেশ্বর মন্দিরের শায়িত শিবলিঙ্গ বাঁকা ভাবে অবস্থিত হওয়ায় এই স্থানের নাম হয়ে থাকতে পারে বাঁকুড়া। বিদ্যানিধি মহাশয়েরই অন্য মতে ‘বাম কুণ্ড’ (বাম দিকের ঝর্না জলধারা) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে এই ভূমের নাম ‘বাঁকুড়া’ হয়েছে। তবে বর্তমানে বাঁকুড়া মৌজায় এমন কোনও ঝর্না বা জলধারার বর্তমানে অস্তিত্বই নেই। কিন্তু ক্ষেত্রনুসন্ধান করে জানা যায়, প্রাচীন কালে জলধারার নিদর্শন ছিল।

এক্তেশ্বরে পাথরের শিব মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। এটি পশ্চিমমুখী। ল্যাটেরাইট (মাকড়া) প্রস্তর দ্বারা সুন্দর ও সুগঠিত। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের রিপোর্টের অষ্টম খণ্ডে জে.ডি. বেগলার লিখেছেন, এক্তেশ্বরের মন্দিরটি অন্তত তিন বার সংস্কার হয়েছে। মন্দিরের শিখর এক সময় ভেঙে পড়েছিল। তার পুনর্নির্মাণের সময় উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মন্দিরটি একাধিক বার সংস্কারের ফলে সাবেক রেখদেউলটি বর্তমানে ‘পীঢ়া’ বা ভদ্রদেউলের আকার নিয়েছে। প্রাঙ্গণে ছোট ছোট উপমন্দিরের মধ্যে, এক ভগ্ন বাসুদেব মূর্তির নিম্নাংশ রয়েছে। চার ফুট উচ্চতা ও আড়াই ফুট প্রস্থের এক দ্বাদশভূজ লোকেশ্বর বিষ্ণু মূর্তি। সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা এবং পৌনে দু’ফুট প্রস্থের এক গণেশ মূর্তি ও একটি নন্দী-বৃষের মূর্তি আছে। উপমন্দির প্রাঙ্গণে একটি দু’ফুটের চণ্ডী নামে পূজিত মূর্তি দেখা যায়। সব কটি প্রাচীন মূর্তিই পাথরের এবং সুন্দর। অনুমান হয় আদিতে এ বিগ্রহগুলি সাবেক মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে (অধুনা শূন্য) কুলঙ্গিগুলিতে রক্ষিত ছিল।

এক্তেশ্বরে দ্বাদশভূজ লোকেশ্বর বিষ্ণু মূর্তিটি লৌকিক দেবী মনসা ও খাঁদা রানি নামে পূজা পাচ্ছেন। তাঁর ডান পায়ে সামান্য ফাটল লক্ষ্য করা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণে খোলা আকাশের নীচে, অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে মাটির বেদিতে মাটির হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে দু’টি পাথরের পা ও প্রত্নবস্তুগুলি অবহেলায় পড়ে আছে। এই প্রত্নমূর্তিগুলি গৌরবের স্মারক। এগুলি যত্ন সহকারে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

শিবমন্দির চত্বরে পিছনের পূর্ব কোণে সামান্য দূরে সূর্য মন্দির (‌সোনাতপলের দেউলটি) অবস্থিত ছিল। বন্যার ফলে দ্বারকেশ্বর নদের গতি পরিবর্তন এক্তেশ্বর শিব মন্দির ও সোনাতপলের সূর্য মন্দিরকে আলাদা করেছে।

লেখক ক্ষেত্রসমীক্ষক, বাঁকুড়া

অন্য বিষয়গুলি:

Ekteswar Siva temple Shiv ratri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy