সমষ্টির অর্থ নূতন করিয়া শিখাইতেছে কোভিড-১৯। মানবেতিহাসে সংক্রামক মহামারি নূতন নহে, রোগব্যাধিজনিত সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক দূরত্বও একবিংশ শতকীয় এক ভাইরাসের কারণেই প্রথম ঘটিল, তাহাও নহে। সামাজিকমাধ্যমে বা চারিপার্শ্বে তাকাইলে মারিপীড়িত রোগী, তাঁহাদের পরিবার বা চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী বা প্রশাসকের বিরুদ্ধেও ভীতিজনিত অসূয়ার প্রকাশ দেখা যাইতেছে। কিন্তু তাহাই সার্বিক চিত্র নহে। সামগ্রিক সত্যও নহে। চার মাস ধরিয়া চলা সামগ্রিক বা আংশিক লকডাউনের মধ্যে, রোগাক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িয়া চলার আবহেও মানুষ সহনাগরিকের পাশে দাঁড়াইয়াছেন, এখনও দাঁড়াইতেছেন, তাহাই আশা জোগাইতেছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলিতেছেন, সঙ্কটকালে নাগরিকের এই যূথবদ্ধতা মনে করাইয়া দিতেছে প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম মূল্যবোধ ‘কমিউনিটাস’-এর কথা, ‘কমিউনিটি’ বা গোষ্ঠীধারণার মূলে নিহিত সমানুভূতির ভাব যাহার অন্তঃসার।
বস্তুত করোনা-অতিমারি ও আমপানের ন্যায় দুর্যোগ দেখাইয়া দিয়াছে, প্রশাসন বা সরকারের সমান্তরালে সমান বা তদধিক কাজ করিয়াছে সাধারণ নাগরিকদের সাহায্য-শৃঙ্খল। ঘরে ফিরিতে পথে নামা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য গৃহবন্দি চিত্রতারকা বা সম্পন্ন ব্যবসায়ী অর্থ বা বাহনের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছেন। তরুণ যুবা ছাত্রছাত্রীরা সমাজমাধ্যম ও প্রযুক্তির সাহায্যে শ্রমিকদের ফিরিবার পথ নিরুপদ্রব করিয়াছেন। আমপানের পরে বা দীর্ঘ লকডাউনে বিপন্ন নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষের সহায় হইয়া দাঁড়াইয়াছেন অগণিত নাগরিক। শহর ত্রাণ লইয়া গ্রামে হাজির হইয়াছে, অনেকগুলি স্থানে খুলিয়া গিয়াছে গণরন্ধনশালা বা ‘কমিউনিটি কিচেন’, রোজ বিনা পয়সায় বা নামমাত্র মূল্যে ক্ষুধার্ত মানুষ সেখানে খাইয়া বাঁচিতেছেন। বয়স্ক, অসুস্থ নাগরিকের ঔষধ বা প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর সংস্থান নাই, খবর পাইয়া তাঁহার বাড়িতে সব জিনিসপত্র লইয়া ছুটিয়াছেন সম্পূর্ণ অচেনা অথচ সহমর্মী মানুষ। অবসাদ ও একাকিত্ব পাইয়া না বসে, তাই সমাজমাধ্যমে রাশি রাশি বই ও চলচ্চিত্রের হদিশ দিয়াছেন অগণিত জন। বিদেশে ছোট-বড় শহর বা শহরতলিতে কেহ প্রতিবেশীকে বাগানের আনাজ-ফলমূল উপহার দিতেছেন, ঘরে বানানো খাদ্যসামগ্রী গৃহদ্বারে রাখিয়া যাইতেছেন কেহ। অনলাইন আড্ডায় সাময়িক লাঘব হইতেছে দূরে থাকা বন্ধু-পরিজনদের মনের ভার।
যে নাগরিক নিঃস্পৃহতা একবিংশ শতকের নগরজীবনের অমোঘ পরিচায়ক, তাহা কি তবে এই অতিমারির সময়ে দূর হইয়া যাইতেছে? মানুষ সামাজিক জীব অথচ এই যুগে তাহার আচার-ব্যবহার নিতান্ত অ-সামাজিক, এই অভিযোগের কি তবে দিন গিয়াছে? ভয়ঙ্কর রোগ-দুর্যোগের ভ্রুকুটির সম্মুখে, সামাজিক দূরত্বে থাকিবার বাধ্যবাধকতায় পড়িয়া তবে সে বুঝিল, মানুষে মানুষে বাঁধিয়া থাকিবার অর্থ কী? সমষ্টির মধ্যে বাস করিয়াও নাগরিকের জীবন ছিল একান্ত আত্মকেন্দ্রিক, আজ সে বুঝিল যূথবদ্ধতার গুরুত্ব। আজ সময়ঘোড়া ছুটিতেছে না, জীবনে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ব্যবধানটুকু বোধগম্য হইতেছে। অচেনা সহমানুষও যে সহমর্মী হইতে পারে, এই আশ্চর্য আবিষ্কারের মধ্য দিয়া সে রোজকার বাঁচিয়া থাকায় সহমর্মিতা ও সমানুভূতির বোধ অর্জন করিল। অতিমারির মূল্যে হইলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy