Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Environment

প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে চিরসবুজ ডুয়ার্স

রাজ্যের ফুসফুস উত্তরের বনাঞ্চল লকডাউনে ফিরে পেয়েছে তার নিজের ছন্দ। জঙ্গল, বন্যপ্রাণ নির্ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। লকডাউন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই ছবিই বজায় রাখা যাবে তো? না কি আবার দূষণের কবলে গ্রস্ত হবে এই অরণ্যভূমি, এই নদী? জঙ্গলে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হল। মানুষ পিছু হটল। এমনটা যে হতে পারে, ভাবেনি কেউই।

সব্যসাচী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২০ ০৪:৪৫
Share: Save:

গরুমারা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়া ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে ফি-বছর ১৫ শতাংশ হারে যান চলাচল বাড়ছিল। জঙ্গলের ভিতরে পর্যটনের মাত্রাতিরিক্ত চাপকে মোকাবিলা করতে চারটি শিফটে পাঁচটি নজরমিনারে ছুটত জিপসির দল। আরও দুই শিফটে বাফার জঙ্গল এলাকায় জঙ্গল সাফারির চলমান ভ্রমণ ছিল। কাঁচা-পাকা রাস্তায় জঙ্গলের ভিতরে পেট্রোল জিপের আনাগোনা নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে ফেলত ময়াল, ময়ূর, চিতাবাঘ, বাইসন, গন্ডার, হাতিদের। মানুষ যে বিষম প্রাণী, তা বুঝেই যতটা ঘাপটি মেরে থাকা যায়, সে ভাবেই লুকোতে চাইত ওরা। নিজেদের সাম্রাজ্য গরুমারায় মানুষের কোলাহলে উঁচু ডালটিতে বসেও কি শান্তি পেত পাখিরা? অতি বড় অরণ্যাচারীও মনে মনে বন্যপ্রাণীদের এই বিপন্নতা স্বীকার করেন।

কিন্তু সব ছবি বদলে গেল। জঙ্গলে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম হল। মানুষ পিছু হটল। এমনটা যে হতে পারে, ভাবেনি কেউই। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হল মানুষ। প্রথম কিছুদিন বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল ওরা। জঙ্গলের মধ্যে মানুষের তৈরি মহাকালধাম, আসলে যা পরবর্তী সময়ে পুজো কম সেল্ফি পয়েন্ট বেশি হয়ে গিয়েছিল, সেখানেও মানুষ নেই! কেন এমন হল? সেটা হয়তো ওরা ওদের মতো করে বুঝে নিয়েছিল। আর নিয়েছিল বলেই জঙ্গলের পথ, লাগোয়া জাতীয় সড়ক— সর্বত্র ওদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়।

গাড়ি নেই, গাড়ির হর্ন নেই, ধোঁয়া নেই আর তাতেই বাহারি ঠোঁটের ধনেশ পাখিও রাস্তার ধারেই নিশ্চিন্তে বসেছে। রেললাইনে ট্রেন নেই। সেখানেও তাই মেঘলা আকাশ দেখে মনের সুখে পেখম মেলে ধরেছে ময়ূর। তথ্য বলছে, মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত লকডাউনে ৩০ শতাংশ কমে এসেছে। হাতির হানায় মৃত্যু হয়নি মানুষের। পিচের রাস্তার দু’ধারের গাছপালায় যেন আরও সবুজ। এ তো গেল শুধু গরুমারার কথা। সামগ্রিক ডুয়ার্সের দূষণ নিয়েও অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে পরিবেশপ্রেমীদের মধ্যে।

ডুয়ার্সের ওদলাবাড়ি একটি উল্লেখযোগ্য বাজার বা গঞ্জ। দু’ধারে দুই নদী চেল ও ঘিস। এই দুই পাহাড়ি নদী থেকে বৈধ ও অবৈধ নানা ভাবে দিনভর শতাধিক ট্রাক ও হাজারেরও বেশি শ্রমিক বালি, পাথর তুলে নিতেন। বালি, পাথর খাদানের পাশাপাশি নদীর ঘাড়েই পাথরগুড়োর ক্রাশার মেশিনও প্রচুর রয়েছে সেখানে। লকডাউনে সেখানেও অন্য ছবি। নদীতে ট্রাক নেই, মানুষ নেই। ক্রাশার মেশিন বন্ধ। যেন নতুন করে প্রাণ পেয়েছে চেল ও ঘিস। নদীতে মাছও মিলছে দেদার।

ডুয়ার্সের এথেলবাড়ি এলাকা যেন ছোট শিল্পাঞ্চল। ইট, সিমেন্টের নানা আসবাব তৈরির কারখানা এই এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে। স্বভাবতই কালো ধোঁয়া সঙ্গী হয়েছে সেখানে। সেই ধোঁয়া উধাও হয়ে মেঘমুক্ত আকাশে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে নিতে স্থানীয় বাসিন্দা পরমেশ্বর সিং বললেন, “জানি, মানুষের টাকার লোকসান হচ্ছে। কিন্তু প্রাণবায়ু সতেজ হচ্ছে, জীবন চিন্তা ও দূষণমুক্ত হয়েছে।”

রাতের ডুয়ার্সের আকাশ এখন এতটাই নির্মল যে, ৫০ কিলোমিটার দূরের ঝান্ডি পাহাড় থেকে এখন মালবাজার, শিলিগুড়ি দেখার প্রবণতা বেড়েছে। ডুয়ার্সের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা কমে যাওয়ায় দৃশ্যমানতা বেড়ে গিয়েছে। এমনই জানালেন ঝান্ডি তথা ডুয়ার্সের পর্যটন ব্যবসায়ী রাজেন প্রধান। তিস্তা, জলঢাকায় মাছের চাহিদা কমায় বরোলির মতো দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠা মাছের বংশবৃদ্ধিও গতি পাচ্ছে। একই সঙ্গে নদীয়ালি মাছের উৎপাদনও স্বাভাবিক হচ্ছে।

নির্মল এই পরিবেশের আবেশ গায়ে মেখে নিতে ভোরবেলার প্রভাতফেরিতে যোগ দেওয়ার প্রবণতা এই লকডাউনে বেড়ে গিয়েছে। মালবাজার শহরের চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপে দল তৈরি করে পরস্পর পরস্পরকে তাগাদা দিয়ে ভোরের নির্মল বাতাসে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ছেন। দেবায়ন মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ দত্তের মতো অনেকেই লকডাউনে শহর ছাড়িয়ে চা-বাগানের পথে হাঁটতে যান। প্রথমে কষ্ট হলেও এখন এই ডুয়ার্সের বদলে যাওয়া স্বচ্ছ পরিবেশে হাঁটার লোভ ছাড়তে পারছেন না বলেই জানালেন তাঁরা।

ডুয়ার্সের প্রবীণ নাগরিকেরা আক্ষেপের সুরে বলতেন যে, ডুয়ার্সে তাঁদের যৌবনে সারা বছর রাতে কম্বলের প্রয়োজন হত। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় হলং বেড়াতে এসে ডুয়ার্সের বৃষ্টি দেখেছিলেন। তিনি ডুয়ার্সের বৃষ্টি নিয়ে লিখেছিলেন— ‘বৃষ্টি পরে এখানে বারো মাস, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে।’ সেই মুষল বৃষ্টিও আর নেই বলে দুঃখ ছিল। কিন্তু লকডাউনে ডুয়ার্সের আবহাওয়া যেন অনেকটাই অতীতের স্মৃতি ফেরাতে শুরু করেছে। রাতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠতেও ফ্যান চালিয়ে রাখলে শীত-শীত ভাব অনুভূত হচ্ছে। বয়স্কেরা খুশি। তাঁরা যেন তাঁদের ছোটবেলার স্মৃতি ফিরে পাচ্ছেন!

তবে, সবই কি ভাল? আশঙ্কা কি নেই কোথাও এতটুকু? এত মাস্ক, গ্লাভসের ব্যবহার এখন। সে সব ব্যবহারের পর ইতিউতি ছুড়ে ফেলাও হচ্ছে। আবর্জনা সাফ করার আজও কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। তাই প্রশ্ন— সব স্বাভাবিক হলে ফের আগের ছবিতে ফিরে যাবে না তো? না কি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারব রাজ্যের ফুসফুস এই সবুজ ডুয়ার্সকে? তা নিয়ে সন্দিহান সকলে।

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Duars Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy